শামস শামীম ::
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড ইউনিটের সাবেক সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মজিদ ১৯৭১ সনে ছিলেন দেশপ্রেমে টইটম্বুর টগবগে এক কিশোর। সুনামগঞ্জের সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মসূচির একজন পরিচিত মুখ তিনি। অস্ত্রহাতে দেশ স্বাধীন করার পর দেশ গঠনে আত্মনিয়োগ করেন। যুদ্ধাপরাধীর বিচার কার্যকরের দাবিতে নতুন প্রজন্মকে নিয়ে রাজপথে নামেন। মুক্তিযুদ্ধের অবমাননাকারী দেশদ্রোহীদের বিরুদ্ধে বরাবরই উচ্চকণ্ঠ তিনি। এখন সহযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের সুখ দুখে মিশে আছেন। তাদের উপকার করতে পারলেই তিনি সুখ অনুভব করেন।
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের আওয়ামী লীগ সরকার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগকে স্মরণ করে তাদের সম্মান, মর্যাদা বৃদ্ধিসহ সরকারি ভাতার সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টির পর থেকেই আব্দুল মজিদ সহযোদ্ধাদের জন্য অক্লান্ত কাজ করছেন। এলাকায় স্কুল-মাদরাসা প্রতিষ্ঠা ও নানা সামাজিক কার্যক্রমে যুক্ত থেকে জনসেবার কাজও করছেন। তার এই মূল্যায়ন গত ইউনিয়ন নির্বাচনে দিয়েছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। তাকে ইউনিয়ন পরিষদে নৌকা প্রতীকে মনোনয়ন দিয়েছিলেন। কিন্তু রাজনৈতিক কূটচালে তাকে পরাজিত করা হয়েছিল বলে মনে করেন এলাকাবাসী।
অসহায়, দুঃস্থ ও অসচেতন সহযোদ্ধাদের পাশাপাশি প্রয়াত সহযোদ্ধার পরিবারকে খুঁজে বের করে সরকারি সুযোগ-সুবিধাপ্রাপ্তিতে সহযোগিতাসহ তাদেরকে সামাজিকভাবেও নানাভাবে সহযোগিতা করছেন তিনি। তার প্রতিদিন শুরু হয় সহযোদ্ধা ও তাদের পরিবারকে নানামুখি সহযোগিতার মাধ্যমে।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার রঙ্গারচর ইউনিয়নের বিরামপুর গ্রামের সিকান্দার আলী ও জয়গুন বিবির চার পুত্রের মধ্যে তৃতীয় পুত্র আব্দুল মজিদ ছিলেন ডানপিঠে স্বভাবের। যুদ্ধ শুরুর সময় তিনি সুনামগঞ্জ সরকারি জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। তার বয়স ছিল তখন ১৪ বছর ৮ মাস। তার পরিবার আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত থাকায় স্থানীয় রাজাকারদের রোষানলে পড়ে। ভয়-ভীতি ও হুমকি ধমকি দেওয়া হয়। তাই বাবা ও মা পরিবারের নিরাপত্তার কথা ভেবে বাড়ি ছেড়ে সীমান্ত এলাকার রংপুর শারপিনটিলায় চলে যান। কিশোর আব্দুল মজিদ দেখেন তাদের মতো এলাকার অনেক মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে সীমান্তের দিকে চলে যাচ্ছে। এই দৃশ্য কিশোর মনে দারুণ প্রভাব পড়ে। রক্তে উন্মাদনা দেখা দেয়। পাকিস্তানি জল্লাদ বাহিনীর প্রতি দলা পাকানো ঘৃণা ছুড়েন। তখনই সিদ্ধান্ত নেন যুদ্ধে যাবেন। কিন্তু বয়স কম থাকায় এবং পরিবারের আদরের সন্তান হওয়ায় সুযোগ পাচ্ছিলেন না। এক রাতে ছপেরগাঁও থেকে মামাতো ভাইকে সঙ্গে নিয়ে বনগাঁও, আশাউড়ার দুর্গম এলাকা পাড়ি দিয়ে ভারত মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুট ক্যাম্পে রওয়ানা দেন। মা-বাবা ও পরিবারকে কিছু না জানিয়ে তুমুল যুদ্ধের সময় সেপ্টেম্বর মাসে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য রওয়ানা দিয়েছিলেন। ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত হয়ে পৌঁছান মৈলাম রিক্রুট ক্যাম্পে। সেখানে ইয়ুথ ক্যাম্পে সপ্তাহখানেক অবস্থান করেন। তিনি ইকোওয়ান ট্রেনিং সেন্টার, আগতরতলা চা বাগান ও শিলচর লোহারবন ট্রেনিং সেন্টারে সব মিলিয়ে ২৮ দিনের প্রশিক্ষণ নেন। তখন হাওরাঞ্চলসহ সারাদেশে তুমুল যুদ্ধ চলছে। অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধারা প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে নাস্তানাবুদ করছেন হানাদারদের। এমন সময়ে নভেম্বরের শুরুর দিকে আব্দুল মজিদ ট্রেনিং সম্পন্ন করে ৪নং সেক্টরে সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হন। তবে বয়স কম হওয়ায় সহযোদ্ধারা তাকে অগ্রভাগে না রেখে একটু পিছনে রাখতেন।
সচ্ছল পরিবারের সন্তান আব্দুল মজিদ ট্রেনিং সেন্টার ও যুদ্ধকালীন সময়ের খানাপিনার কথা স্মরণ করে জানান, মোটা সিদ্ধ চালের ভাত, ডাল ছিল একমাত্র খাবার। তাও নিয়মিত পাওয়া যেতনা। নষ্ট হয়ে যেতো। তাই অভুক্ত পেটেই টহলে থাকতে হতো। সকল যোদ্ধাদেরই একই অবস্থা ছিল। তাছাড়া পরিবারও তার সম্পর্কে কিছু জানতোনা। তিনি বেঁচে আছেন না মরে গেছেন তাও জানতোনা কেউ। তার জন্য অনেকে কেঁদেছেন মা। দেশ স্বাধীন করে বাড়ি ফেরার পর মায়ের অশ্রুসিক্ত আলিঙ্গনের উষ্ণতা এখনো অনুভব করেন তিনি।
কিশোর আব্দুল মজিদ কম্পানী কমান্ডার আবুল কালাম ও প্লাটুন কমান্ডার আব্দুল মান্নানের অধীনে সেকশন কমান্ডার হিসেবে যুদ্ধ করেন। বয়সে ছোট হওয়ার কারণে তার রাইফেল অনেক সময় পজিশন নিতে গিয়ে মাটিতে লেগে যেতো। তারপরও যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন পজিশন ঠিক রাখতে। ডিসেম্বরে বিজয়ের প্রাক্কালে সিলেট চা বাগানে সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। অনেকক্ষণ ফায়ার করেছেন শত্রুর নিশানায়। এই যুদ্ধই তার শেষ ও দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ। এখানে কয়েকজন সহযোদ্ধা শহিদ হন এবং অনেকে আহত হন। তবে মনোবল না হারিয়ে শেষ পর্যন্ত অস্ত্রহাতে যুদ্ধ চালিয়ে যান আব্দুল মজিদ। সিলেট অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা শত্রুমুক্ত হলেও সিলেট শহরের বিভিন্ন এলাকায় অনড় পকিস্তানিরা যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিল বলে তারা খবর পান। তাই তাদেরকেও সাবধানে থাকতে হয়েছিল। তবে বেশিক্ষণ তারা টিকে থাকতে পারেনি। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তাদেরকে নাস্তানাবুদ হয়ে পালাতে হয়েছিল বা অনেকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল। যুদ্ধ শেষে সবাই বাড়ি ফিরলে বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মজিদ জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে বাড়ি ফেরেন। এর আগে সহযোদ্ধাদের সাথে সিলেট জামেয়া স্কুলে অস্ত্র সমর্পণ করেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মজিদ বলেন, বাড়িতে এসে দেখি মা কাঁদছেন। বাবাও নির্বাক। ভাইয়েরা হতাশ। আমাদের বাড়িঘর লুটপাট হয়েছে। নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর কাজ শুরু করি আমরা। পচাত্তরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পরে আবারও আমাদের দুর্যোগ নেমে আসে। মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় গোপন করে চলাচল করি। ঘাতক দালাল ও রাজাকাররা আবারও সামনে চলে আসে বুক ফুলিয়ে চলে। আমরা আড়ালে চলে যাই। সারাদেশে তখন অনেক মুক্তিযোদ্ধা লাঞ্ছিত হন, অনেককে হত্যা করা হয়। তিনি বলেন, ১৯৯৬ সনের নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর আমরা আবারও উজ্জীবিত হই। সংগঠিত হই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে কাজ করার সুযোগ পাই। এসময়ই আমাদের মর্যাদা ও আর্থিক সুরক্ষার উদ্যোগ নেন আমাদের নেতা বঙ্গবন্ধু কন্যা জননত্রেী শেখ হাসিনা। তিনিই মুক্তিযোদ্ধাদের হারানো মর্যাদা, সম্মান ও আর্থিক সম্মানীর ব্যবস্থা করেছেন। আমরা তার কাছে ঋণী। এখন জীবনের শেষ বেলায় দেখে যেতে চাই মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে। জীবিত ঘাতক দালালদের বিচার দেখে যেতে চাই। আর স্বীকৃতি না পাওয়া সহযোদ্ধাদের স্বীকৃতি ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ও ইতিহাস সংরক্ষণের দাবি জানাই।
যোদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা ছলিম উল্লাহ বলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মজিদ একজন অক্লান্ত যোদ্ধা। এখনো সহযোদ্ধাদের অধিকার আদায়ে, সম্মান ও মর্যাদা রক্ষায় কাজ করছেন। সারাদিনই তার মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কাজ আর কাজ। মুক্তিযোদ্ধাদের সমস্যায় ছুটে গিয়ে তা সমাধান করা, সহযোগিতা করাই তার কাজ। এ কারণে সব মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের কাছে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা পান তিনি।