শামস শামীম: :
‘মৎস্য পাথর ধান / সুনামগঞ্জের প্রাণ’ সম্পদ ও সম্ভাবনার দিকে ইঙ্গিত করে এই প্রবাদটি প্রতিষ্ঠিত বলে মনে করেন সুধীজন। ধান ও পাথর তার মর্যাদা অক্ষুণœ রাখলেও দেশের সবচেয়ে সুস্বাদু মিঠাপানির মাছ আশঙ্কাজনকভাবে কমেছে হাওরে। যার ফলে হাওরের বাজারগুলোতে মাছের মূল্য চলতি বছর কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। উদ্বৃত্ত মাছের অঞ্চল হিসেবে দেশ-বিদেশে পরিচিত সুনামগঞ্জের সাধারণ মানুষের খাদ্য তালিকা থেকে বাদ পড়ছে দেশি মাছ। এই সুযোগে বাধ্য হয়ে হাইব্রীড মাছ খেতে হচ্ছে হাওরবাসীকে। তবে হাইব্রীড মাছের দামও অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছে বলে ক্রেতারা জানান। তাছাড়া প্রতি বছর মৎস্যবিভাগ মাছের যে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে বাস্তবতার সঙ্গে তার কোন মিল নেই বলে জানিয়েছেন হাওরের কৃষকরা।
সুনামগঞ্জ মৎস্যবিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরে জেলায় ১ লক্ষ ১৪ হাজার ৪৪৬ মে.টন মাছ উৎপাদন হয়েছে। এর মধ্যে জেলার চাহিদা ৫৬ হাজার ৩৭২ মে.টন। জেলায় উৎপাদিত মাছের অর্ধেকের বেশি ৫৮ হাজার ৭৪ মে.টন উদ্বৃত্ত থাকে। তবে মৎস্যবিভাগের এই হিসেবে মানতে নারাজ হাওরবাসী। তারা জানিয়েছেন মৎস্য বিভাগ গতানুগতিক এর আগের বছরের হিসেবের সঙ্গে মিল দেখিয়ে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার হিসেবে দেয়। যা বাস্তবতার সঙ্গে যায়না। তারা জানিয়েছেন চলতি বছর বাজারে গেলেই বুঝা যাচ্ছে হাওরের দেশি মাছ কম। মৎস্যবিভাগের মতে, হাওরে উৎপাদিত মাছের মূল্য প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা।
হাওরবাসী জানান, এবার হাওরে বিলম্বে এসেছে বর্ষা। যার ফলে ডিম ছাড়ার মওসুমে মাছ পানি পায়নি। ধান কাটার পরপরই বানের পানি আসলে মাছ ডিম ছাড়তে সুবিধা হয়। কিন্তু এবার আষাঢ় মাসের মাঝামাঝি সময়ে বিলম্বে বর্ষা এসেছে হাওরে। এই কারণে হাওরের বাজারে এখন মাছ কম। তাছাড়া প্রশাসনিক উদাসীনতায় মওসুমে কারেন্ট জাল, কোণা জাল (মশারি জাল) দিয়ে মাছ আহরণ এবং শুষ্ক মওসুমে ইজারাদাররা বিল সেচে মাছের বংশ নষ্ট করে মাছ আহরণের কারণে হাওরে মাছের উৎপাদন কমছে বলে নানা ফোরামে সচেতন লোকজন দাবি করে আসছেন। প্রতি বছর সরকার হাওরে পোনা অবমুক্ত করতে যে বরাদ্দ দেয় তার সিকিভাগও অবমুক্ত না করে বরাদ্দ নয়ছয় করা হয় বলে তাদের অভিযোগ। যার ফলে হাওরে মাছ বাড়ছে না। সরকারকে মৎস্য উৎপাদনের ভুল তথ্য দিয়ে এর আগের বছরের তথ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মনগড়া প্রতিবেদন দেওয়া হয় বলে হাওরবাসীর অভিযোগ।
হাওরের কৃষকরা আরো জানান, বড় বড় হাওরগুলোকে কেন্দ্র করে জেলায় ৯২টি মাছের আড়ত গড়ে ওঠেছে। তবে আড়তের প্রকৃত সংখ্যা হবে দুই শতাধিক। আড়তদাররা হাওরের মাছ ক্রয় করে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠিয়ে দেন। অনেকে বিদেশেও রপ্তানি করেন। যার ফলে হাওরের বাজারে দেশি মাছের সংকট দেখা দিয়েছে। তাছাড়া সম্প্রতি টাঙ্গুয়ার হাওরকে কেন্দ্র করে পর্যটকদের আনাগোনা বৃদ্ধি পাওয়ায় মাছের চাহিদা বেড়েছে। যা মূল্যবৃদ্ধির আরেক কারণ বলে মনে করেন হাওরবাসী।
শাল্লা উপজেলার বাহাড়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বিশ্বজিৎ চৌধুরী নান্টু বলেন, আমাদের চারদিকে হাওর। কিন্তু হাওরের মাছ খেতে পারিনা। বাজারেও হাওরের মাছ নেই। হাওরের বাজার ভরে গেছে হাইব্রিড মাছে। মাঝে-মধ্যে অল্প মাছ পাওয়া গেলেও এবছর দাম হয়ে গেছে দ্বিগুণ। তিনি বলেন, দেশি টেংরার কেজি এখন ৬০০-৭০০ টাকা। অথচ ৩০০-৪০০ টাকা কেজি ছিল এক বছর আগে। হাওরের পুকুরে চাষকৃত রুইয়ের কেজিও ৭-৮শ টাকা। দেশি কাইল্যাড়া মূল্য ৮০০ টাকা। দেশি বোয়াল ছোট ৮০০ টাকা। অথচ অন্য বছর ৩০০ টাকা কেজি ছিল। এভাবে এখন মাছের বাজারে আগুন।
দিরাই উপজেলার পেরুয়া গ্রামের কৃষক নেতা অমরচাঁন দাস বলেন, হাওরে পোনা অবমুক্ত করে সরকারের কোটি কোটি টাকা লোপাটের কোনও দরকার নেই। হাওরের মাছ যে ডিম পারে তার অর্ধেক মাছ রক্ষা করা গেলে হাওরে মাছের অভাব থাকবেনা। জ্যৈষ্ঠ থেকে আশ্বিন পর্যন্ত মৎস্য নিধন বন্ধ করা গেলে এবং ইজারাদারদের লাগাম টেনে বিল সেচা বন্ধ করা গেলে হাওরে মাছের অভাব হবেনা। হাওরে এখন মাছ নেই বলেই দাম বেশি। এরকম দাম নিকট অতীতে আমরা দেখিনি।
হাওরের কৃষি ও কৃষক রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্যসচিব অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন তালুকদার বলেন, কোণা জাল, কারেন্ট জাল অবাধে মাছ নিধন করা হয়। প্রকাশ্যে ইজারাদার বিল শুকিয়ে মাছ ধরলেও কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। এ কারণে প্রতিবছর দেশি মাছ সংকটে পড়ছে। মাছ উৎপাদন কমছে। এর প্রভাব পড়েছে বাজারেও। তাই হাওরবাসী আমিষ খাবার মাছ আগের মতো খেতে পারছেনা। আমিষ সংকটে ভোগছে হাওরবাসী।
তাহিরপুর উপজেলার পাটাবুকা গ্রামের পরিবেশকর্মী রিপচান হাবিব বলেন, হাওরের মৎস্যজীবীদের ঘরে এখন আগের মতো অভাব নেই। কিন্তু অতিরিক্ত আয়ের জন্য তারা লোভে অবাধে মাছ ধরছে। এতে দেশি মাছের সংকট পড়েছে। যার ফলে হাওরের বাজারেও মাছের মূল্য অত্যধিক। মাছ ধরার মওসুমে পুরো লকডাউন দেওয়া গেলে এক বছরেই হাওর মাছে ভরে যাবে। এসময় মৎস্যজীবীদের ভিজিএফ এর আওতায় আনা যেতে পারে।
মৎস্য ব্যবসায়ী সুয়েব আহমদ বলেন, অন্যান্য বছরের চেয়ে এবার হাওরের দেশি মাছ বাজারে কম আসছে। এ কারণে বাজারে দাম বেশি। তবে হাওরে পর্যটক বৃদ্ধি ও হাওরের মাছ অন্যান্য স্থানে আড়ত হয়ে চলে যাওয়ায় দাম আগের চেয়ে বেশি।
জেলা মৎস্য অফিসার মো. শামসুল করিম বলেন, আমরা বাজার ঘুরে দেখেছি এবার মাছের উৎপাদন কম। মৎস্যজীবী এবং কৃষকরাও সেটা বলছেন। এবার বিলম্বে পানি আসায় মাছ ডিম ছাড়তে পারেনি। তাই বাজারে মাছের দামও বেশি। হাওরে মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে সরকার নানা উদ্যোগ নিয়েছে।