বিশেষ প্রতিনিধি ও জয়ন্ত সেন ::
অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে পার্বত্য এলাকা থেকে গত জুন মাসে স্ট্যান্ডরিলিজ হয়ে সুনামগঞ্জের দুর্গম উপজেলা শাল্লায় এসে দুর্নীতিতে জড়ানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে শাল্লা উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. আব্দুস সালামের বিরুদ্ধে। শিক্ষকদের নানাভাবে জিম্মি করে সুবিধা নেওয়া, স্লিপ, ক্ষুদ্র মেরামতসহ অন্যান্য প্রকল্পের নিয়মিত বরাদ্দ থেকে ঘুষ নিয়ে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছেন তিনি। তার ঘুষ চাওয়ার দুটি অডিও রেকর্ড এই প্রতিবেদকের কাছে সংরক্ষিত আছে। এদিকে লিখিত অভিযোগের পর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উপজেলা ভূমি কর্মকর্তাকে প্রধান করে তিন সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। কমিটিকে আগামী ৮ নভেম্বরের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমাদানের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
অন্যদিকে, একজন নারী শিক্ষকের অসুস্থতা জনিত ছুটিতে জটিলতা সৃষ্টি করে তার কাছ থেকে দালালের মাধ্যমে ২৮ হাজার টাকার চেক নিয়েছেন শিক্ষা অফিসার আব্দুস সালাম। এ ঘটনায় ওই শিক্ষিকার স্বামী শাল্লা উপজেলা শিক্ষা কমিটির সদস্য ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবরে গতকাল ৩১ অক্টোবর লিখিত অভিযোগ করেছেন।
লিখিত অভিযোগ থেকে জানা যায়, উপজেলার শাসখাই গ্রামের তন্ময় দেবের স্ত্রী অঞ্জলি রানী দাস আগুয়াই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছেন। গত ১৪ সেপ্টেম্বর ওই শিক্ষিকা অসুস্থ হলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন এবং চিকিৎসক তাকে কিছুদিন (৫ অক্টোবর পর্যন্ত) বিশ্রামে থাকার ব্যবস্থাপত্র দেন। ছুটি শেষে গত ৬ ও ৭ অক্টোবর সাপ্তাহিক ছুটি থাকায় ৮ অক্টোবর বিদ্যালয়ে যোগদান করেন তিনি। এসময় হিন্দু ধর্মাবলম্বী সরকারি চাকরিজীবীদের পূজার বোনাসসহ বেতনভাতা দেওয়া হলেও ওই শিক্ষিকা অসুস্থতা কাটিয়ে যোগদান করে জানতে পারেন তার বেতন ও বোনাস আটকে দিয়েছেন উপজেলা শিক্ষা অফিসার। এই অবস্থায় ওই শিক্ষিকা অফিসের জনৈক কর্মচারীর সঙ্গে যোগাযোগ করলে সরাসরি শিক্ষা অফিসারের সঙ্গে কথা বলার জন্য বলেন। ওই শিক্ষিকা অফিস কর্মচারীর পরামর্শে মোবাইল ফোনে শিক্ষা অফিসারের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি ঢাকায় আছেন বলে ওই শিক্ষিকাকে জানান এবং ঢাকা থেকে আসার পর সরাসরি এ বিষয়ে কথা বলার নির্দেশনা দেন।
অভিযোগ থেকে আরো জানা যায়, শিক্ষা কর্মকর্তা ঢাকা থেকে আসার পর গত ১৭ অক্টোবর শিক্ষিকা অঞ্জলি রানী দাস অফিসে গিয়ে দেখা করলে তিনি তার ছুটির জটিলতাকে পুঁজি করে ২৫ হাজার টাকা ঘুষ দাবি করেন। এসময় তিনি শিক্ষা অফিসার আব্দুস সালামকে জানান, তিনি ঋণ করে সম্প্রতি চিকিৎসা করিয়েছেন। তার কাছে টাকা পয়সা নেই এবং তিনি এত টাকা ঘুষ দিতে পারবেন না। এসময় তিনি চাকরিতে বিভাগীয় শাস্তির ভয় দেখিয়ে ওই শিক্ষিকাকে শিক্ষা অফিসারের ঘনিষ্ঠ লোক উজ্জ্বল মিয়া টাকা না থাকলেও শিক্ষকদের চেক নিয়ে সুদে ঋণ দেন বলে অবগত করে তাকে একটি চেক দেওয়ার নির্দেশনা দেন। ভয়ে ওই শিক্ষিকা শিক্ষা অফিসারের কাছে উজ্জ্বল মিয়ার নামে একটি চেক দিয়ে আসেন। বেতন ভাতা আটকে রাখায় ওই শিক্ষিকার পরিবার পূজার বোনাস পাওয়ার পরও শিক্ষা অফিসার আটকে দেওয়ার কারণে পরিবারকে নিয়ে আনন্দ উদযাপন করতে পারেননি। শারদীয় দুর্গোৎসবের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হন তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুস সালামের দুর্নীতির ঘটনা প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে তদন্ত হচ্ছে। গত ২৫ অক্টোবর সচিবালয়ে তার বিষয়ে শুনানিও হয়েছে। অধিদপ্তরের কয়েকজন দুর্নীতিবাজ পরিচালকের সঙ্গে আতাত করে তিনি দুর্নীতি করে পার পেয়ে যাচ্ছেন। যে কারণে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ডিডি ও ডিপিইওকেও তিনি পাত্তা দেননা। তাদেরকে পাশ কাটিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে দুর্নীতিবাজ শিক্ষক সিন্ডিকেটকে ম্যানেজ করে প্রকাশ্যে দুর্নীতি ও অনিয়ম করে যাচ্ছেন।
শিক্ষিকার স্বামী তন্ময় দেব বলেন, শিক্ষা অফিসার আব্দুস সালাম গত জুন মাসে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে পানিশমেন্ট বদলি হয়ে শাল্লায় আসেন। তিনি শিক্ষকদের দুর্বলতা খুঁজে খুঁজে তাদেরকে জিম্মি করে ঘুষ নেন। আমার স্ত্রীর ছুটিতেও জটিলতা সৃষ্টি করে তিনি পছন্দের লোককে দিয়ে ২৮ হাজার টাকার একটি চেক নিয়েছেন। আমি তার এই অনিয়ম ও দুর্নীতির ঘটনায় উপজেলা শিক্ষা কমিটির সদস্য উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে লিখিত অভিযোগ করেছি।
চেকগ্রহণকারী উজ্জ্বল মিয়ার মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি কল ধরেননি।
উপজেলা শিক্ষা অফিসার মো. আব্দুস সালাম বলেন, আমি ঢাকায় আছি। আমি কারও কাছ থেকে কোন টাকা পয়সা নেইনি। অভিযোগ সঠিক না।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মোহন লাল রায় বলেন, আমি এ ধরনের কোনও অভিযোগ পাইনি। তবে আমার কোন কর্মকর্তা বা কর্মচারী যদি দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ পাই অবশ্যই বিভাগীয় ব্যবস্থা নেব।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আবু তালেব বলেন, লিখিত অভিযোগ পাবার পর তিন সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করে দিয়েছি। তাদেরকে আগামী ৮ নভেম্বরের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দানের কথা বলেছি। এছাড়াও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্লিপ, ক্ষুদ্র মেরামত প্রকল্পের অনিয়মের অভিযোগ পাওয়ায় আরেকটি পৃথক তদন্ত কমিটি করে দিয়েছি।