সুনামকণ্ঠ ডেস্ক ::
আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজপথে কোনো ধরনের অপ্রিতিকর ঘটনা এড়াতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। এর অংশ হিসাবে পুলিশের নষ্ট সরঞ্জামের বিপরীতে কেনাকাটার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। কারণ ২০২২ সালের আগস্ট থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বিএনপি ও তার সহযোগী দলগুলোর হামলায় পুলিশের অনেক টাকার মালামাল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ কারণে আগাম প্রস্তুতি নেয়া শুরু করা হয়েছে। প্রস্তুতি উপলক্ষে তারা আগের বরাদ্দের বাইরে বাড়তি আরও ১২২৫ কোটি ৯৯ লাখ, ৮৬ হাজার ৬১০ কোটি টাকার চেয়ে প্রস্তাবনা পাঠিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। যা যাচাই বাছাই পর্যায়ে রছেছে। এ দিকে নতুন করে মালামাল কেনার জন্য ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। যা এরই মধ্যে নীতিগত অনুমোদন হয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে দ্রুতই কেনাকাটা শেষ করতে চাই পুলিশ সদর দপ্তর। সূত্রমতে পুরোনো বরাদ্দ চেয়ে আবেদনে কেনাকাটার তালিকায় রয়েছে, ১৫৮ কোটি সাত লাখ ১৭ হাজার ২৫০ টাকার অস্ত্র ও গোলাবারুদ, ৭৭ কোটি ৫০ লাখ টাকার নিরাপত্তাসামগ্রী, যানবাহনের জন্য ২২৬ কোটি পাঁচ লাখ টাকা, অন্যান্য যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি ৫৪০ কোটি সাত লাখ, তথ্য যোগাযোগ ও প্রযুক্তিসামগ্রী কেনা জন্য ১২ কোটি, ক¤িপউটার ও আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র কিনতে ৪৪ লাখ, উন্নত মানের সফটওয়্যার বাবদ সাত কোটি ছয় লাখ ও নির্বাচনের সময়ের জন্য পেট্রোল, অয়েল ও লুব্রিকেন্ট জন্য ২০৪ কোটি ৮০ লাখ ৬৯ হাজার ৬১০ টাকার ব্যয় ধরা হয়েছে। নতুন বরাদ্দ চাওয়া ৫০০ কোটি টাকার মধ্যে অস্ত্র ও গুলি, টিয়ার শেল, রাবার বুলেট ও সাউন্ড গ্রেনেড রয়েছে কেনাকাটার তালিকায়।
জানা গেছে, ২০২৩ সালের শেষ কিংবা ২০২৪ সালের শুরুতে বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ হিসাবে নির্বাচনের আর মাত্র আড়াই মাস সময় বাকি রয়েছে। এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে বর্তমান পরিস্থিতির থেকেও বেশি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে বলে গোয়েন্দারা আশঙ্কা করছে। এ পরিস্থিতিতে যে কোনো ধরনের এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দ্বাদশ নির্বাচন ঘিরে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে আমাদের প্রস্তুতি চলছে। পুলিশের অপারেশন্স শাখা থেকে একটি রোডম্যাপ তৈরি করা হয়েছে। এতে কী আছে সে বিষয়ে এখনই বিস্তারিত বলা যাচ্ছে না। তবে এটুকু বলতে পারি, সব ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য আমরা প্রস্তুত আছি। পুলিশ একটি পেশাদার বাহিনী। পেশাদারিত্বের সঙ্গেই সব ধরনের অপতৎপরতা রুখে দেওয়া হবে। একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সামনের দিনগুলোতে আমাদের বিশেষ অভিযান জোরালো হবে।
জানা গেছে, চলমান আন্দোলনের বাইরে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো আগামীতে সরকার পতনের একদফা দাবিতে বড় সমাবেশ, মানববন্ধন অথবা অবস্থান কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে। পরবর্তীতে তারা আন্তঃজেলা বা বিভাগে রোডমার্চের মতো যুগপৎ কর্মসূচিও দিতে পারে। তবে আন্দোলনের নামে কেউ যাতে ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগের মতো পরিস্থিতি তৈরি করতে না পারে সেজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে।
পুলিশ সদর দফতরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আন্দোলনের নামে যদি কেউ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি ঘটানোর চেষ্টা করে তবে যাতে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া যায় এজন্য তোড়জোড় প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। তবে পুলিশ আশাবাদী, সব রাজনৈতিক দলগুলোই নিয়মতান্ত্রিকভাবে আন্দোলন কর্মসূচি পালন করবে; ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকবে। তবে কেউ যদি এ ধরনের অপচেষ্টা চালায় তবে পুলিশ বরাবরের মতো তা শক্ত হাতে দমন করবে।
পুলিশের এ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, একটি গণতান্ত্রিক দেশে কোনোভাবেই অস্থিতিশীলতা কাম্য না। দেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। উন্নয়নের এ যাত্রা যাতে অব্যাহত থাকে; বিদেশি বিনিয়োগ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, বিশ্বের কাছে যেন অস্থিতিশীল দেশের নমুনা হিসেবে ব্যবহৃত না হতে হয় সেজন্য পুলিশ প্রয়োজনীয় সবকিছুই করবে। কেউ যদি এমন কিছু করার চেষ্টা বা চক্রান্ত করে তার বিরুদ্ধে আইনগত কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ ক্ষেত্রে কাউকে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।
সংশ্লিষ্টরা জানান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বিরোধী দলগুলোর সব কর্মসূচি পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করতে বলা হয়েছে। নাশকতার জন্য কেউ মাঠে নামার আগেই প্রয়োজনে সারা দেশে সর্বাত্মক অভিযান চালানো হবে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, সম্প্রতি পুলিশের ত্রিমাসিক অপরাধ পর্যালোচনা সভাতেও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এসব বিষয়ে পুলিশ প্রধান সবাইকে সতর্ক থাকার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনাও দিয়েছেন। জামায়াত-শিবির কিংবা কোনো বিশেষ অপশক্তি রাজনৈতিক আন্দোলনের নামে যাতে তা-ব চালাতে না পারে সেদিকে সবাইকে সতর্ক দৃষ্টি রাখার তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, রাজধানী ঢাকাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে আগাম নিরাপত্তাব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে দেশের কোনো জেলাতেও যেন রাজনৈতিক কর্মকা-ের নামে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি কেউ তৈরি করতে না পারে সেজন্যও প্রয়োজনীয় নিরাপত্তাব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। কারণ ২০১৩ ও ২০১৪ সালে রাজনৈতিক কর্মসূচির সময় রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা তৈরি করা হয়েছিল। সে সময় দুষ্কৃতকারীদের হাতে একাধিক পুলিশ সদস্য আক্রান্ত হন। এ কারণে আসছে জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আগেভাগেই বিশেষ সতর্কতা জারি করা হয়েছে।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, সামনের দিনগুলোতে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে মনোবল ভাঙার জন্য পুলিশের ওপর আক্রমণ করতে পারে দুষ্কৃতকারীরা। নির্বাচনের বছরে সেই শঙ্কা থেকেও সতর্কতা জারি করা হয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যদের ব্যক্তি নিরাপত্তার পাশাপাশি যানবাহন, লজিস্টিকস, পুলিশি স্থাপনাগুলোতে নিরাপত্তা জোরদার করা হচ্ছে। একই সঙ্গে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় কোনো ধরনের আ্যাাকশনে না যাওয়ারও নির্দেশনা রয়েছে। পাশাপাশি পুলিশের টহল টিমের অস্ত্র-গোলাবারুদের নিরাপত্তা জোরদার করতে নির্দেশনাবলি যথাযথভাবে অনুসরণ ও প্রতিপালন করার বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে। থানার একাধিক টহল টিমের মধ্যে অন্তত একটি দল থানা বা ইউনিটের আশপাশের এলাকায় ডিউটিতে থাকবে, যাতে জরুরি মুহূর্তে তারা দ্রুত থানায় আসতে পারে। অনুরূপভাবে একটি ফুট প্যাট্রল টিম থানার সীমান্তবর্তী এলাকায় নিয়মিত দায়িত্বরত থাকবে। ডিভিশন অনুযায়ী ডিসি-এডিসি-এসিদের যে কোনো একজনকে সারা রাত এলাকার টহল ডিউটি তদারক করবেন।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান ও অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ বলেন, স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মকা-ে পুলিশ কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে না। কিন্তু রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে কেউ ফৌজদারি অপরাধের নীল নকশা তৈরি করে বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপচেষ্টা চালায় তবে পুলিশ কঠোরভাবে তা প্রতিহত করবে। তা-ব সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ করা হবে।
সূত্র আরও জানায়, জাতীয় নির্বাচনকেন্দ্রিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পর্যাপ্ত দাঙ্গা দমন ও অপারেশনাল সরঞ্জাম মজুতের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পুলিশের জন্য ২০-২২-২৩ অর্থবছরে যে বরাদ্দ ছিল সেই বরাদ্দের অতিরিক্ত হিসাবে সরকারের কাছে এক হাজার ২২৬ কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। গত সেপ্টেম্বরে পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত ডিআইজি আতিকুর রহমান স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত একটি বরাদ্দপত্র জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিবের কাছে দেয়া হয়। তবে এখনো সেটি অনুমোদন হয়নি। বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ সদর দপ্তর।