অনেকেই স্বীকার করেন দেশের উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু মূর্তনির্দিষ্ট উন্নয়নের বর্ণনা করতে গিয়ে বক্রবিবরণ উপস্থিত করে বলেন, ধন বেড়েছে, ধনী বেড়েছে, ধনবৈষম্য বেড়েছে এবং নিজেদের অজান্তেই ধনবৈষম্য নিরসনের প্রয়োজনীয়তাকে জাতীয় কর্তব্য রূপে হাজির করেন, যদিও ব্যতিক্রম বাদে তাঁরা কেউই তা চান না। প্রকারান্তরে সমাজতন্ত্রের প্রসঙ্গটি আলোচনার অনিবার্য উপজীব্য হয়ে উঠে। তা উঠে উঠুক, তাতে কীছু যায় আসে না। আপাতত সে আলোচনায় যাচ্ছি না।
ভাবনা হচ্ছে দেশের ভেতরে সংঘটিত হয়ে চলা অন্য একটি বিষয়বাস্তবতা নিয়ে। যে-বিষয়বাস্তবতাটিকে বলা যায়, দল বেঁধে লুটপাট। এই দেশে দল বেঁধে লুটপাটের ঘটনা ঘটছে, তার অনেক অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়। যেমন সম্প্রতি চক্রীয় চক্রান্তের গুণে ডিম বা আলুর দাম বেড়েছে ব্যাপকাকারে, কখনও কখনও মরিচ কিংবা আদার দাম বেড়ে যায়। ক্ষেত্রবিশেষে বাড়তে বাড়তে একবোরে ১০০ গুণ পর্যন্তও বাড়ে, সে-টা এতোই অকল্পনীয়। তেলের দাম তো বেড়েছে অনেক আগেই। এই তো কয়েক মাস আগেও সুনামগঞ্জ থেকে ঢাকা যেতে বাসভাড়া ছিল ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। এখন যেতে বাসভাড়া দিতে হয় ৮২০ টাকা। দপ্তরে দপ্তরে ঘুষের বাড়াবাড়ির প্রসঙ্গটি তো বলতে গেলে সনাতনী ব্যাপারস্যাপার। এমনতর বিষয়বাস্তবতা কারও কারও কাছে কাঠামোগত শোষণব্যবস্থা বলে প্রতিপন্ন হয়। এসব কেবল আমাদের দেশেই নয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এমন দলবেঁধে লুটপাট চলছে। যেমন চীনে এমন ঘটনা ঘটে চলেছে। বলা হচ্ছে : ১৯৮৯ সালে চীনে গণতন্ত্রের দাবিতে যে আন্দোলন শুরু হয়, তাতে দেশটির ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে গিয়েছিল। দাপ্তরিক নথিপত্র অনুসারে সে বছরের ১৮ মে চীনের ১৩২টি শহরে একযোগে ৬০ লাখ মানুষ প্রতিবাদ বিক্ষোভে অংশ নেয়। তিয়েনআনমেন স্কয়ারের সেই বিক্ষোভ কমিউনিস্ট পার্টি বল প্রয়োগে দমন করে। এরপর দলের ভবিষ্যৎ নেতাদের মধ্যে আনুগত্য পুনঃসৃষ্টিতে সব স্তরের নেতাদের রাষ্ট্রীয় স¤পত্তি লুটপাটের সুযোগ দেওয়া হয়। আর এভাবেই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জবাবে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় লুটপাটের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়, যার মাধ্যমে শুরু হয় ক্রোনি ক্যাপিটালিজম বা দল বেঁধে লুটপাটের পুঁজিবাদ। দ্য ইকোনমিস্ট ১-এর সংজ্ঞায় ক্রোনি ক্যাপিটালিজম হলো সেই বন্দোবস্ত, যার মাধ্যমে পুঁজিপতিরা রাজনীতিকদের কাছ থেকে মূল্যবান স¤পদ লাভ করে থাকে। আরেকটু বিস্তৃত করে বলা যায়, এটা পুঁজিপতি ও রাজনীতিকদের মধ্যকার বন্দোবস্ত, যার মাধ্যমে পুঁজিপতিরা বৈধ বা অন্য উপায়ে স¤পদ আহরণ করেন এবং রাজনীতিকেরা ক্ষমতা টিকিয়ে রাখে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, এই ক্ষেত্রে (অর্থাৎ ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের ক্ষেত্রে) চীন ও বাংলাদেশ এক কাতারেই অবস্থান করছে। পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশ বোধ করি তার ব্যতিক্রম নয়। একদা সুনামগঞ্জ তা ভালোভাবেই প্রত্যক্ষ করতে বাধ্য হয়েছে। বিস্তারিত ফিরিস্তিতে যাচ্ছি না। কেবল উল্লেখ করি যে, সুনামগঞ্জে ২০১৭ সালে যখন শতভাগ ফসলডুবি ঘটে তখন হাওরে ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণের প্রকল্পে ব্যাপক দুর্নীতি জনসমক্ষে প্রকাশিত হয়ে দল বেঁধে লুটপাটের বিষয়বাস্তবতাকে প্রতিপন্ন করে। তখন এই ফসলডুবির ঘটনা থেকে আমজনতা দল বেঁধে লুটপাটের বিষয়ে সম্যক ধারণা লাভ করেন। প্রতিকারের বিষয়ে আমরা কেবল এইটুকু বলতে চাই যে, যথাযথ কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে দেশের ভেতরে এই দল বেঁঁধে লুটপাটের ঘটনা প্রতিহত করা হোক।