1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
  3. [email protected] : wp-needuser : wp-needuser
শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ০৬:৫৫ পূর্বাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

দুনিয়াজুড়ে নিষেধাজ্ঞার মার্কিন রাজনীতি

  • আপডেট সময় বুধবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

সুনামকণ্ঠ ডেস্ক ::
বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক তৎপরতা দিনকে দিন বাড়ছে। র‌্যাব সদস্যদের ওপর নিষেধাজ্ঞার ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি ভিসা নিষেধাজ্ঞারও প্রয়োগ শুরু করেছে বাইডেন প্রশাসন। ওয়াশিংটন বলতে চাইছে, এই তৎপরতা বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে। তবে আজ থেকে অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় আগে বাংলাদেশ যখন পাকিস্তানের অংশ ছিল; সে সময় ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় পাওয়া আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করা পাকিস্তানি নেতৃত্বের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (আজকের বাংলাদেশ) মানুষের গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ১৯৭১ সালের পাকিস্তানি গণহত্যা ত্বরান্বিত করতে সম্ভাব্য সবকিছু করেছিল তৎকালীন নিক্সন প্রশাসনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার। মানুষের গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষার বিপরীতে অবস্থান নেওয়ার আরও বহু নজির রয়েছে ওয়াশিংটনের।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই ‘অস্ত্র’ ব্যবহার করা হয়েছে ওয়াশিংটনের ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থে। নিষেধাজ্ঞার বলি হয়েছে বিভিন্ন দেশের সাধারণ মানুষ। এসব নিষেধাজ্ঞার ক্ষেত্রে কখনো কখনো আন্তর্জাতিক আইনকে লঙ্ঘনও করা হয়েছে।
একাত্তরে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে প্রখ্যাত মার্কিন বুদ্ধিজীবী নোম চমস্কির অভিমত : ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তানের নৃশংসতাকে আধুনিক সভ্যতার গুরুতর অপরাধ মনে করেন খোদ যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম নেওয়া ভাষাতাত্ত্বিক ও দার্শনিক অধ্যাপক নোম চমস্কি। ২০২১ সালের জুনে বাংলাদেশি তরুণ তানভীরুল মিরাজ রিপনের সঙ্গে এক ফেসবুক লাইভে এই মার্কিন বুদ্ধিজীবী বলেন, ১৯৭১-এর ওই নৃশংসতা ত্বরান্বিত করতে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার সম্ভাব্য সব কিছুই করেছিলেন। তিনি পাকিস্তানের আক্রমণ, হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসযজ্ঞকে সমর্থন করেন। ভারত যখন হস্তক্ষেপের চেষ্টা করেছিল তখন তিনি ভারতের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকি দিয়েছিলেন, বঙ্গোপসাগরে নৌবহর পাঠিয়েছিলেন। নৃশংসতা ত্বরান্বিত করতে কিসিঞ্জারের পক্ষে যা করা সম্ভব তিনি তার সবই করেছিলেন।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক মার্কিন তৎপরতা ও ‘সরকার বদল’ প্রশ্ন :
যে যুক্তরাষ্ট্র ৭০ দশকে বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানি গণহত্যাকে সমর্থন করেছিল; তারাই আজ বাংলাদেশে ‘গণতন্ত্রের স্বার্থে’ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের আধা-সামরিক বাহিনী র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) এবং র‌্যাবের বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় ওয়াশিংটন। ‘সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে’ বাংলাদেশে মার্কিন দূতাবাসের তৎপরতাও দিনকে দিন বাড়ছে। চলতি বছরের মে মাসে নির্বাচনি প্রক্রিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এমন কর্মকা-ে জড়িত থাকলে বাংলাদেশি নাগরিকদের বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকিও দেয় তারা। কদিন আগে তারা জানিয়েছে, সেই নিষেধাজ্ঞার প্রয়োগ শুরু হয়েছে। এর আগেই চলতি বছরের এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সরকার পরিবর্তনের চেষ্টার অভিযোগ তোলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ওয়াশিংটন চাইছে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে সরিয়ে নতুন এমন একটি সরকারকে সামনে আনতে যাদের কোনো গণতান্ত্রিক সত্তা নেই।
সাংবাদিক ও বিশ্লেষক সাগরিকা সিনহা ভারতীয় স¤প্রচারমাধ্যম এনডিটিভির অনলাইন ভার্সনে লেখা সা¤প্রতিক এক নিবন্ধে বলেছেন, বিশ্বজুড়ে আমেরিকার সাম্প্রতিক ‘কালার রেভ্যুলেশন’ (সরকার পরিবর্তনে ভূমিকা রাখা) অন্যতম আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। গণতান্ত্রিক দেশগুলোতেও এমন হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। সাগরিকার অভিমতের প্রমাণ মিলেছে বিকল্প ধারার মার্কিন সংবাদমাধ্যম ইন্টারসেপ্টের সা¤প্রতিক এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনেও। গত আগস্ট মাসে প্রকাশিত সেই প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইমরান খানকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য ইসলামাবাদকে চাপ দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। ইন্টারসেপ্টের হাতে আসা পাকিস্তান সরকারের ওই নথি অনুসারে, ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের বিষয়ে নিরপেক্ষ অবস্থান নেওয়ায় ইমরান খানকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে অপসারণ করার জন্য মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট ২০২২ সালের ৭ মার্চ এক বৈঠকে পাকিস্তান সরকারকে ‘উৎসাহিত’ করেছিল। আর এই মাসে প্রকাশিত ইন্টারসেপ্টের আরেক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইউক্রেনকে অস্ত্র দেওয়ার শর্তেই আইএমএফের ঋণ পায় পাকিস্তান।
দেশে দেশে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ও এর রাজনীতির বলি পশ্চিমবিরোধীরা :
দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্রদের সঙ্গে নিয়ে নতুন অর্থনৈতিক বাস্তবতার জন্ম দেয়। আইএমএফ, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে তারা। অর্থনীতিকে উদারীকরণের রূপ দেওয়া হয়। সব মিলে বিশ্বজুড়ে প্রতিষ্ঠিত হয় মার্কিন অর্থনৈতিক কর্তৃত্ব, কিংবা ডলারের আধিপত্য।
২০২১ সালে গ্লোবাল ইকোনমিক রিভিউয়ে প্রকাশিত ইউএস ইকোনমিক স্যাংশন : অ্যা কন্ট্রোভার্সিয়াল ফরেন পলিসি টুলস ইন ইন্টারন্যাশনাল পলিটিক্স শিরোনামের এক প্রবন্ধে নিরমা ইফরান, মাদিহা নওয়াজ ও সোবাই জামিল বলছেন; এরপর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র সুপার পাওয়ার হিসেবে পশ্চিমা ধারার গণতন্ত্র ও পুঁজিবাদের পক্ষে গোটা বিশ্বকে শামিল করার চেষ্টা শুরু করে। রাশিয়ার সঙ্গে ¯œুয়ুযুদ্ধেও তারা নিষেধাজ্ঞাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। প্রতিদ্বন্দ্বীদের ওপর যেন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা যায়, সে জন্য প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা বাড়ানোর অনুমোদন দেওয়া হয় পার্লামেন্টে। পশ্চিম ইউরোপকে তারা তাড়িত করে, পশ্চিমবিরোধী চীন-ভিয়েতনাম-কিউবা-উত্তর কোরিয়া ও কলম্বিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে। ২০২১ সালে লেখা ‘অ্যা সেঞ্চুরি অব স্যাংশন’ বইতে ইতিহাসবিদ বেঞ্জামিন কোটস স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন; ৫০ দশকেই চীনা পণ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ শুরু হয়। ১৯৭৭ সালে জিমি কার্টারের প্রশাসনের সময় ‘ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক পাওয়ার অ্যাক্ট’ আনা হয়। এই আইন অনুযায়ী প্রেসিডেন্টকে যেকোনো দেশের বিরুদ্ধে যখন-তখন নিষেধাজ্ঞা আরোপের এখতিয়ার দেওয়া হয়। নিরমা ইফরান, মাদিহা নওয়াজ ও সোবাই জামিল তাদের প্রবন্ধে বলছেন, সেই সময় থেকেই নিজেদের কৌশলগত লক্ষ্য পূরণে‘‘নিষেধাজ্ঞা’কে ব্যবহার করছে যুক্তরাষ্ট্র। কখনো জাতিসংঘ ও মিত্রদের সঙ্গে নিয়ে, কখনো আবার একা একাই।
১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর ৫২ আমেরিকানকে জিম্মি করে তেহরান। প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার তখন ইরানে রফতানি নিষিদ্ধ করে এবং তেহরানের স¤পদ জব্দ করে। ১৯৯০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় মদদে জাতিসংঘের উদ্যোগে ইরাক ও কুয়েতের সব স¤পদ জব্দ করা হয়। ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব ম্যানুফ্যাকচারার্সের ১৯৯৭ সালের এক গবেষণা বলছে, ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৬ সময়কালে বিশে^র ৩৫টি দেশ মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় ছিল।
ইরাক, ইরান ও সিরিয়া এবং ভেনেজুয়েলায় মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ভয়াবহ প্রভাব :
হাজার হাজার সেনা পাঠিয়ে ইরাক ১৯৯০ সালের আগস্টে কুয়েত দখল করে নেয়। এরপর বাগদাদের ওপর নেমে এসেছিল ব্যাপক পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন শুরু হওয়ার কারণে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে এর স্থায়ী সদস্যদের ভেটো দেওয়ার ক্ষমতা কিছুটা অকার্যকর হয়ে পড়ে। আর এ সুযোগেই ১৯৯০ সালে ইরাকের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ। ইরাকের বিরুদ্ধে কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা চলেছে ২০০৩ সাল পর্যন্ত। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে চলা এই নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরাকে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছিল। জাতিসংঘের কূটনীতিক মাত্তি আহতিসারি ইরাকের তৎকালীন পরিস্থিতিকে ‘প্রায় মহাবিপর্যয়ের’ সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। বলেছিলেন যে, ইরাক আসলে ‘শিল্পযুগ-পূর্ববর্তী’ সময়ে ফিরে গেছে।
১৯৯৬ সাল পর্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞার ফলে মারা গিয়েছিল ৫ লাখ ইরাকি শিশু। সে সময় জাতীয় টেলিভিশনে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেডেলিন অলব্রাইটকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল : অবরোধের কারণে ইরাকে যে ৫ লাখ শিশু মারা গেল, এ নিয়ে আপনার অভিমত কী? অলব্রাইট বলেছিলেন, এটা খুব কঠিন একটা সিদ্ধান্ত। তবে যে লক্ষ্য পূরণে এই কাজ করা হচ্ছে, তার মূল্য হিসেবে এটা ঠিকই আছে।
সেই ১৯৭৯ সাল থেকেই মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কবলে রয়েছে তেহরান। ২০১১ সালে পারমাণবিক অস্ত্র ইস্যুতে আরেক দফায় ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্রকে সমর্থন দিতে কানাডা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নও নিষেধাজ্ঞায় শামিল হয়। আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয় ইরানি ব্যাংকগুলোকে। ২০১৮ সালে ডোনাল্ড ট্রা¤প প্রশাসন আরেক দফায় নিষেধাজ্ঞা দেয় ইরানকে। এর ফলে ২০১৯-২০ সালে ইরানের জিডিপি ৭.৬ শতাংশ নেমে যায়; যার বলি হচ্ছে সাধারণ মানুষ।
১৯৭৯ সালে সিরিয়ার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। ২০০৩ সালে বাড়ানো হয় সেই নিষেধাজ্ঞার পরিসর। ২০১৩ সালে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগ তুলে আরেক দফায় সিরিয়ায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। সেই ধারাবাহিকতায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন সিরীয় পণ্য নিষিদ্ধ করে। নিষেধাজ্ঞার উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়, বাশার আল আসাদকে ক্ষমতা থেকে হটানো ও একটি গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা কায়েম করা। তবে এখনও আসাদ বহাল-তবিয়তে ক্ষমতায় আছেন। তবে সিরিয়ায় ২০১০-১৫ সময়কালে জিডিপি কমে যায় ৭৫ শতাংশ। খাবার ও ওষুধের অভাবে মরতে থাকে হাজার হাজার বেসামরিক মানুষ।
মার্কিন নিষেধাজ্ঞাকে আন্তর্জাতিক নীতি ও মানবাধিকারবিরোধী আখ্যা জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞের :
গণতান্ত্রিক শাসন কায়েম থাকা সত্ত্বেও ক্ষমতার অপব্যবহারসহ নানা অভিযোগে গত ১৭ বছর ধরে ভেনেজুয়েলা রয়েছে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কবলে। সেন্টার ফর ইকোনমিক অ্যান্ড পলিসি রিসার্চের ২০১৯ সালের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, তখন পর্যন্ত ভেনেজুয়েলায় মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে খাদ্য ও চিকিৎসার অভাবে ৪০ হাজার মানুষের প্রাণহানি হয়।
২০১৯ সালের মে মাসে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল কর্তৃক নিযুক্ত একজন স্বাধীন বিশেষজ্ঞ যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক কিউবা, ভেনেজুয়েলা এবং ইরানের ওপর সাম্প্রতিক একতরফা জবরদস্তিমূলক পদক্ষেপের ওপর গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদক ইদ্রিস জাজাইরি সে সময় বলেন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার ব্যবহার মানবাধিকার এবং আন্তর্জাতিক নীতির লঙ্ঘন। এই ধরনের পদক্ষেপ অভূতপূর্ব মানবসৃষ্ট মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। তার মতে, কোনো দেশে আর্থিক ও মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করে, সাধারণ মানুষকে দুর্দশায় ফেলে এবং তাদের জিম্মি করে গুরুতর রাজনৈতিক মতপার্থক্য কখনই সমাধান করা উচিত নয়।
মার্কিন নীতির দ্বিচারিতার ইতিহাস :
গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের কথা বললেও সব দেশের জন্য মার্কিন নীতি একরকম নয়। ২০১৩ সালে মিসরে মোহাম্মদ মুরসির নেতৃত্বাধীন নির্বাচিত সরকারকে
উৎখাত করে ক্ষমতায় আসে জান্তা। অথচ তৎকালীন ওবামা প্রশাসন পরিস্থিতিতে নজর রাখা ছাড়া আর কিছুই করেনি।
মধ্যপ্রাচ্যে ইরানকে নিষেধাজ্ঞায় জর্জরিত রাখলেও সৌদি আরবের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ স¤পর্কের কথা সবারই জানা। সেখানে নারী অধিকার হরণ, শিয়াদের মানবাধিকারের বিপন্নতা, এমনকি চরম একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সমস্যা নেই। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিচ রিসার্চ ইনস্টিউউিটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী মার্কিন অস্ত্রের সবচেয়ে বড় ক্রেতাদের অন্যতম সৌদি আরব। মধ্যপ্রাচ্যে ইরানবিরোধী নীতিতে ইসরাইলের সঙ্গে সৌদি আরবকে সঙ্গে নিয়েই তাদের রাজনীতি। ওয়াশিংটন পোস্টের সাংবাদিক জামাল খাশোগির হত্যায় সৌদি যুবরাজের প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পেয়েও বলতে গেলে কিছুই করেনি যুক্তরাষ্ট্র। বাইডেন প্রশাসন ক্ষমতায় এসে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে একবার ‘অস্পৃশ্য’ বলেছিলেন। তবে কদিন আগের জি টোয়েন্টি সম্মেলনে সেই ‘অস্পৃশ্য’ যুবরাজের সঙ্গেই হাত মেলাতে দেখা গেছে তাকে।
মধ্যপ্রাচ্যের বর্ণবাদী রাষ্ট্র ইসরাইলও যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত ঘনিষ্ঠ মিত্র। সেখানে ক্ষমতাসীন বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সরকার সংবিধান সংশোধন করে ক্ষমতা পোক্ত করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্র এর বিপরীতে কোনো নিষেধাজ্ঞা দেওয়া তো দূরের কথা, তেমন কোনো বলিষ্ঠ অবস্থানও নেয়নি। দিনের পর দিন ফিলিস্তিনিদের হত্যা ও তাদের ভূমি দখলের বিরুদ্ধেও কার্যকর কোনো অবস্থান নেয়নি ওয়াশিংটন।
ভারতেও ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকারের মুসলিমবিরোধী নীতি নিয়ে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি ওয়াশিংটনকে। কূটনৈতিক সূত্রের বরাতে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে বলা হচ্ছে, মুখে এর বিরোধিতা করলেও এশিয়ায় নিজেদের বাণিজ্যিক ও ভূরাজনৈতিক এই মিত্রকে রুষ্ট করতে চায় না যুক্তরাষ্ট্র।
কী বলছেন বিশ্লেষকরা :
২০২২ সালে ‘দ্য ইকোনমিক উইপন : দ্য রাইজ অব স্যাংশন অ্যাজ অ্যা টুল অব মডার্ন ওয়্যার’ (অর্থনৈতিক অস্ত্র : আধুনিক যুদ্ধের উপাদান হিসেবে নিষেধাজ্ঞার উত্থান) নামে একটি বই প্রকাশ হয়েছে। লেখক নিউইয়র্কের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক নিকোলাস মালদার সেই বইতে বলেছেন, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা বিধ্বংসী অস্ত্র হতে পারে; তাদের মানবিক প্রভাব হতে পারে প্রচলিত অস্ত্রের মতোই। কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সংবাদমাধ্যম কর্নেল ক্রোনিক্যালকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি নিষেধাজ্ঞা ও যুদ্ধের মধ্যকার স¤পর্ক নিয়ে বলেন, উভয়েরই অন্তর্নিহিত লক্ষ্য একই; তা হলো শাসন পরিবর্তন করা (রেজিম চেঞ্জ) কিংবা প্রতিরোধকে গুড়িয়ে দেওয়া। বেসামরিক সমাজের ওপর এই দুইয়ের প্রভাবও এক : অনাহার, রোগ, দেউলিয়াত্ব। নিষেধাজ্ঞার পদ্ধতিগুলো এমন যার কার্যকারিতা এবং পরিণতি যুদ্ধের মতো। কেবল উপায় ভিন্ন।
এদিকে ইউনিভার্সিটি অব প্রেটোরিয়ার তিনাশি নায়ামুন্ডা ডেভেলপিং ইকোনমিকসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে একই রকম মত দেন। তিনি বলেন, নিষেধাজ্ঞা সামরিক সংঘাতের বিকল্প হিসেবে কাজ করে। এই পদক্ষেপ কোনো জীবন বা উল্লেখযোগ্য বস্তুগত স¤পদের ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই [লক্ষ্যবস্তু করা দেশগুলোকে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া দেশের ইচ্চাপূরণে] বাধ্য করার ইচ্ছা থেকে উদ্ভূত হয়। ইউক্রেন যুদ্ধকে ঘিরে রাশিয়ার ওপর দেওয়া সা¤প্রতিক নিষেধাজ্ঞা নিয়েও বলেন নায়ামুন্ডা। তার মতে, দিনশেষে এটি আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণের জন্য দেওয়া নিষেধাজ্ঞা।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com