1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
সোমবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৩, ০২:১৯ অপরাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

অর্থনীতির নতুন দিগন্ত- পায়রা সমুদ্র বন্দর: মিনার সুলতান

  • আপডেট সময় শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

বাংলাদেশে পণ্য পরিবহনের জন্য জাহাজ আসা-যাওয়া শুরু সেই ১৮শতকের শেষদিকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে। তখন যাত্রা শুরু করে চট্টগ্রাম বন্দর, যেখানে বাষ্পীয় ইঞ্জিনচালিত জাহাজ থেকে পণ্য পরিবহণ শুরু হয়। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় একদিকে যেমন পণ্য পরিবহনের ব্যস্ততা বেড়েছে, তেমনি পরিবর্তন হয়েছে পণ্য পরিবহণের সাথে জড়িত জাহাজের ধরন।
গভীর সমুদ্র বন্দর কেন প্রয়োজন? :
বর্তমানে কন্টেইনার বা কার্গো পরিবাহী সরাসরি জাহাজ, যাকে বলা হয় মাদার ভ্যাসেল; এর জন্য প্রয়োজন সর্বোচ্চ ২৫ মিটার গভীরতার চ্যানেল, যেদিক দিয়ে বড়ো জাহাজ পোর্টের প্লাটুনে ভিড়ে পণ্যবাহী কন্টেইনার খালাস করবে। কিন্তু বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দরের গভীরতা সর্বোচ্চ ৯.৫ মিটার। যে কারণে বড়ো কার্গোবাহী জাহাজ গভীর সমুদ্রে অবস্থান করে ছোটো লাইটার এংকারেজ জাহাজে পণ্য স্থানান্তরিত করে কম ড্রাফটের জাহাজে পাঠায় চট্টগ্রাম বন্দরে। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে বড়ো মাদার ভ্যাসেল বঙ্গোপসাগরে আসেই না, সেটা সিঙ্গাপুরের গভীর সমুদ্র বন্দরে থাকে এবং সেখান থেকে ১৫ হাজার টনের লাইটার জাহাজে করে পণ্য বাংলাদেশের সমুদ্র বন্দরে পাঠায়। এই ট্রান্সশিপমেন্টের কারণে পণ্য পরিবহনের খরচ অনেক বেড়ে যায়। বর্তমানের প্রতিযোগিতাপূর্ণ আন্তর্জাতিক বাজারে এই অতিরিক্ত খরচের কারণে বাজার হারাচ্ছিল বাংলাদেশ।
আরেকটি কারণ হচ্ছে- সময়। এইভাবে দুইবারে জাহাজ পরিবর্তনের কারণে দেখা যেত বাংলাদেশ থেকে ছেড়ে যাওয়া পণ্য গন্তব্যে পৌঁছাতে ৪০ থেকে ৬০ দিন সময় লেগে যেত। অথচ গভীর সমুদ্র বন্দর যাদের আছে তারা ১২-১৫ দিনে পণ্য গন্তব্যে পৌঁছে দিতে পারে। আর বড়ো পণ্যবাহী জাহাজকে নোঙরের সুবিধা না দিতে পারার কারণে অনেক রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছিল বাংলাদেশ।
বাংলাদেশে গভীর সমুদ্র বন্দরের উপযোগিতা :
বাংলাদেশে পণ্য আমদানি-রপ্তানি গতিশীল করতে একটি গভীর সমুদ্র বন্দরের প্রয়োজনীয়তা দীর্ঘদিনের। সময়ের প্রয়োজেনই বাংলাদেশ থেকে রপ্তানির গার্মেন্টস বা অন্যান্য পণ্য সরাসরি গভীর সমুদ্রের জাহাজের মাধ্যমে কম সময়ে ও কম খরচে ইউরোপ-আমেরিকায় পৌঁছানোর অর্থনৈতিক তাগিদ রয়েছে। একইভাবে জ্বালানি তেল বা এলএনজি আমদানির জন্য যে ওয়েল ট্যাংকারগুলো আসা-যাওয়া করে, বা কয়লা-পাথরসহ অন্যান্য নির্মাণসামগ্রী পরিবহণের জাহাজগুলো যেন সরাসরি বাংলাদেশের ভূ-খ-ে পণ্য খালাস করতে পারে, তার উদ্যোগ নেওয়ার দরকার থাকলেও কোনো সরকারই এ নিয়ে ভাবেনি। এত বেশি ধারণ ক্ষমতাস¤পন্ন জাহাজগুলোতে ১ থেকে ৩ লক্ষ মেট্রিকটনের মতো পণ্যের ধারণ ক্ষমতা থাকে, যার জন্য প্রয়োজন ১৪ মিটার থেকে সর্বোচ্চ ২৫ মিটার গভীরতা স¤পন্ন চ্যানেল এবং প্লাটুন।
পায়রা বন্দরের সমীক্ষা ও সরকারের প্রশাসনিক বিচক্ষণতা :
বিভিন্ন উপকূলীয় অঞ্চল নিয়ে সমীক্ষা শেষে দ্বিতীয় বন্দর হিসেবে মংলা বন্দর চালু হয়, যার চ্যানেলের গভীরতা মাত্র ৬.৫ মিটার। কিন্তু গভীর সমুদ্র বন্দর তৈরির জন্য সেটা যোগ্য কোনো স্থান ছিল না। মংলা বন্দর দক্ষিণাঞ্চলে চিটাগাং পোর্টের বিকল্প একটা পোর্ট শুধুমাত্র, যার কারণে পণ্য খালাসের পর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে আভ্যন্তরীণ পণ্য পরিবহন সহজতর হয়েছে। কুতুবদিয়া, সোনাদিয়া চ্যানেল সমীক্ষা শেষে গভীর সমুদ্র বন্দরের জন্য পায়রা চ্যানেলকে নির্বাচিত করা হয়। কিন্তু সমস্যা হয়ে যায় এ চ্যানেলে পায়রা নদীর মাধ্যমে এসে জমা পলির পরিমাণ।
জার্মানি, বেলজিয়াম ও বাংলাদেশের ৫ গবেষকের সমন্বয়ে পায়রা বন্দরের ওপর গবেষণামূলক একটি সমীক্ষায় দেখা যায়, প্রতি বছর মেঘনা অববাহিকা দিয়ে বঙ্গোপসাগরে ১১০ কোটি ঘনমিটার পলি এসে পড়ে। যার মধ্যে ৪০ কোটি ঘনমিটার শুধু পায়রা নদীর আশেপাশে এসে পড়ে। এই পলি অপসারণ করে পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দরের ড্রেজিংয়ের জন্য দরকার ৮ হাজার থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা। আর সেই চ্যানেলকে গভীরতাস¤পন্ন জাহাজের আসা-যাওয়ার জন্য উপযুক্ত রাখতে প্রতিবছর ড্রেজিং করতে হবে, যার জন্য ফি বছর হাজার কোটি টাকা খরচ হবে। এ কারণেই সরকার অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে এর সার্বিক প্রকৌশল কাঠামোতে বাংলাদেশের গবেষকদের যুক্ত করে এবং বাংলাদেশের পলি ব্যবস্থাপনা রীতি অনুসরণ করে তার পরিকল্পনার প্রয়োজনীয় সংশোধন আনে।
পায়রা বন্দরের সুবিধা :
তিন স্তরের পরিকল্পনায় বন্দরকে কেন্দ্র করে নির্মাণ হয়েছে কনটেইনার, বাল্ক, সাধারণ কার্গো, এলএনজি টার্মিনাল, পেট্রোলিয়াম ও যাত্রী টার্মিনাল। দক্ষিণাঞ্চলের উন্নতির জন্য তৈরি হচ্ছে অর্থনৈতিক অঞ্চল। যেখানে তৈরি পোশাক শিল্প, ওষুধশিল্প, সিমেন্ট শিল্প, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মৎস্য প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল, সার কারখানা, তেল শোধনাগার, বিমানবন্দর ও জাহাজ নির্মাণ শিল্পসহ আরও অনেক শিল্পকারখানা গড়ে তোলা হচ্ছে। দক্ষিণাঞ্চলের সাথে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি হয় পদ্মা সেতু আর ভাঙ্গা হাইওয়ের কারণে, যার ফলে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সাথে সড়ক ও রেল পরবিহণের মাধ্যমে পণ্য পরিবহণব্যবস্থার উন্নতি হয়। এর ফলে পায়রা বন্দরের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা আরো বেড়ে গেছে। পুরো দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পন্নায়নে ভূমিকা রাখবে পায়রা সমুন্দ্রবন্দর। উন্নয়ন প্রকল্পে যুক্ত হয়েছে আটটি জাহাজের নির্মাণকাজ। এর মধ্যে সাতটি জাহাজ বাংলাদেশের বিভিন্ন শিপইয়ার্ডে তৈরি। এই জাহাজ দিয়ে পায়রা বন্দরে এককভাবে বিদেশি জাহাজ হ্যান্ডেলিংয়ের কাজ করা হবে।
নির্মাণ হয়েছে ৬৫০ মিটার দীর্ঘ প্রথম টার্মিনাল যাতে ২০০ মিটারের ৩টি জাহাজ একসাথে ভিড়তে পারে। একইসাথে কন্টেইনারাইজড কার্গো ও বাল্ক কার্গো হ্যান্ডেল করা যাবে। পায়রা বন্দরে এতদিন নিজস্ব টার্মিনাল ছিল না। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে বিদেশি জাহাজ এই টার্মিনালে মাল খালাস করতে পারবে, তারপর সেগুলো বিভিন্ন প্রান্তে চলে যাবে, রপ্তানির কাজও হবে এই টার্মিনাল থেকে। জাহাজ থেকে খালাস হওয়া পণ্য পরিবহনের জন্য ছয় লেনের সংযোগ সড়ক ও আন্ধারমানিক নদীর ওপর পায়রা সেতু ইতোমধ্যে উদ্বোধন হয়ে গেছে ও যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয়েছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে বন্দরের সক্ষমতা কয়েকগুণ বেড়ে গেছে এবং আশা করা হচ্ছে মংলা ও চট্টগ্রাম বন্দরের চাপ অনেকটাই নিরসন হবে এর ফলে।
যেহেতু এর একপাশে মংলা আর একপাশে চট্টগ্রাম বন্দর। তাই পায়রা বন্দরের আলাদা গুরুত্ব আছে। এর সাথে বিভিন্ন বন্দরগুলোর যোগাযোগ বাড়াবে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক করিডোরের সাথে সংযুক্ত হবে পায়রা বন্দর। ভারত, ভুটান, নেপাল সবাই এটি ব্যবহার করে উপকৃত হবে। এখানে উল্লেখ্য যে, পাহাড়ঘেরা দেশ নেপাল ও ভুটানের এতদিন কোনো বন্দর ছিল না; পায়রা বন্দরের কারণেই তারা বন্দর সুবিধা ভোগ করতে পারবে। প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন হবে। নতুন শিল্প-কারখানা স্থাপন হবে, পর্যটনশিল্পের বিকাশ হবে। বহু কর্মসংস্থান হবে। বাংলাদেশে সামগ্রিক বাণিজ্যের ৯২% সমুদ্র বন্দর ও নদী পথে হয়ে থাকে। দেশটির আমদানি-রপ্তানি খাতে গতি আনতে পায়রা বন্দর বড়ো ভূমিকা রাখবে।
বর্তমানে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে রাবনাবাদ বন্দরে ৭৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ১০০ থেকে ১২৫ মিটার প্রশস্ত এবং ১০.৫ মিটার গভীর চ্যানেলের নির্মাণ করা হয়েছে। এতে বন্দরে ৪০ থেকে ৫০ হাজার মেট্রিক টন কার্গো বহনকারী জাহাজ ভিড়তে পারবে। চট্টগ্রাম বন্দরে ২০ হাজার থেকে ৩০ হাজার টনের একটি জাহাজ তার আকার-আকৃতির ভিত্তিতে ফুল লোডেড অবস্থায় প্রবেশ করতে পারে।
ধারণক্ষমতার বিবেচনায় বড়ো জাহাজ হলো ক্রুড বা অপরিশোধিত তেলের ট্যাংকার। সে হিসেবে পায়রা বন্দরে আসতে পারবে সবচেয়ে ছোটো সাইজের ক্রুড ট্যাংকার। আনুমানিক ১ লাখ টনের আফ্রাম্যাকস ট্যাংকার, যাদের ১৪ মিটারের মতো পানির গভীরতা প্রয়োজন হয়, সেই গভীর সমুদ্রবন্দরের লক্ষ্য এখনই পূরণ হচ্ছে পায়রা সমুন্দর বন্দরে।

 

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com