মৃত্যু চিরসত্য। মানুষের শেষ গন্তব্য মৃত্যু। মৃত্যুকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। চিরাচরিত পন্থায় প্রত্যেক মানুষকে মৃত্যুর স্বাদ নিতে হবে। কিছু মৃত্যুতে তেমন কিছু আসে যায় না। তবে কিছু কিছু মৃত্যুতে পরিবার ও সমাজের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যায়। মো. আব্দুল গফুর চৌধুরীর মৃত্যুতে হলো এক অপূরণীয় ক্ষতি। তাঁর মৃত্যুতে আমরা হারালাম কর্ম, সততা ও ন্যায়পরায়ণ এক অভিভাবককে।
তিনি সততা, কর্মনিষ্ঠা ও আন্তরিকতায় সৌম্যকান্তি মানুষের এক বুদ্ধিদীপ্ত মুখচ্ছবি ছিলেন। তাঁর শারীরিক সৌন্দর্য, আচার-আচরণ, কথাবার্তা, সততা, ন্যায়পরায়ণতা ও পরিশীলিত সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের মধ্য দিয়ে স্বাতন্ত্র বজায় রেখেছেন সবসময়। সুনামগঞ্জ শহরের ষোলঘর মহল্লায় এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে ৩০ এপ্রিল তাঁর জন্ম। তাঁর পিতা মরহুম মো. ইসমাইল আলী চৌধুরী ধর্মপ্রাণ ছিলেন। মাতা মরহুমা মোছা. ছবুরা খাতুনও পীর বংশীয় ছিলেন। আরবি, উর্দু ও ফার্সি জানা একজন বিদূষী রমণী হিসেবে তাঁর পরিচিতি ছিল। তিনি গ্রামের ছেলে-মেয়েদেরকে আরবি, ফার্সি শিক্ষা ও ধর্ম উপদেশ দিতেন।
মো. আব্দুল গফুর চৌধুরী ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে সুনামগঞ্জ সরকারি জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয় হতে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে চাকরি নেন। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজ থেকে অনিয়মিত পরীক্ষার্থী হিসেবে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। তিনি তহসিলদার পদে ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে চাকরিতে যোগদান করেন। ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক কার্যালয়ে নি¤œমান সহকারী পদে যোগদান করেন। তারপর সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে উচ্চমান সহকারী ও প্রধান সহকারী পদে পদোন্নতি পেয়ে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে অফিস সুপারিনটেনডেন্ট পদে পদোন্নতি পেয়ে সুনামমগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে যোগদান করেন। ১৯৯০ সালে ভারপ্রাপ্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে সুনামগঞ্জ জেলা কালেক্টরেট অফিসে পদায়িত হন। অত্যন্ত কর্মদক্ষতা, সততা ও নিষ্ঠার সাথে ওই পদে থেকেই ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে সরকারি চাকরি থেকে যথানিয়মে অবসরগ্রহণ করেন। অবসরগ্রহণের পর সুনামগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির কার্যালয়ে অফিস সুপারিনটেনডেন্ট হিসেবে ৯ বছরের অধিক সময় নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন।
তিনি একজন পরিচ্ছন্ন মানবিক মানুষ ছিলেন। তাঁর মধ্যে সামাজিক দায়বোধও ছিল অনেক। তিনি বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ মিনিস্ট্রিসেল কল্যাণ সমিতি সুনামগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি, সুনামগঞ্জ জেলা কেন্দ্রীয় মসজিদ কমিটির সদস্য, জেলা চাঁদ দেখা কমিটির সদস্য, জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সদস্য, সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সহ-সভাপতি ও ষোলঘর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সহ-সভাপতি হিসেবে নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন।
এছাড়াও তিনি আমৃত্যু ষোলঘর জামেয়া হাফিজিয়া দরগাহে শাহ আছদ আলী (রহ.) মাদ্রাসার কার্যকরী কমিটির সভাপতি এবং ষোলঘর পুরাতন জামে মসজিদ কমিটির সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বাংলাদেশ অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী কল্যাণ সমিতি সুনামগঞ্জ জেলা শাখা, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি সুনামগঞ্জ জেলা ইউনিট, সুনামগঞ্জ শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি পাবলিক লাইব্রেরির আজীবন সদস্য ছিলেন।
সামাজিক ও মানবিক কাজে অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ২০১৪ সালে তিনি শাহ আছদ আলী পীর (রহ.) ফাউন্ডেশন সম্মাননা পদক লাভ করেন। ২০১৪ সালে সুনামগঞ্জ জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি সিলেট বিভাগের শ্রেষ্ঠ জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় কমিটির অন্যতম সদস্য হিসেবে দুর্নীতি প্রতিরোধে প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখায় তাঁকে সম্মাননাপত্র প্রদান করা হয়। সামাজিক উন্নয়নমূলক কর্মকা- এবং অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীদের কল্যাণে কাজ করার স্বীকৃতি স্বরূপ ২০১৭ সালে বাংলাদেশ অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী কল্যাণ সমিতি সুনামগঞ্জ জেলা শাখা কর্তৃক সম্মাননা পদকে ভূষিত হন।
সততা ও নিষ্ঠার মূর্তপ্রতীক মো. আব্দুল গফুর চৌধুরী ২২ সেপ্টেম্বর ২০২২ খ্রিস্টাব্দে সিলেটের রাগীর রাবেয়া মেডিকেল কলেজ এন্ড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। চার ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। তাঁর ভাই মরহুম মাওলানা আব্দুর রহিম চৌধুরী ছিলেন শান্তিগঞ্জ উপজেলার দরগাপাশা আব্দুর রশিদ উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক। তাঁর ওপর দুই ভাই মরহুম আব্দুর রশিদ চৌধুরী ও মরহুম আব্দুর রাজ্জাক চৌধুরী খুব ধর্মপ্রাণ ছিলেন। চার ভাইয়ের মধ্যে তিন জনই নিঃসন্তান। তাঁর ভাই মরহুম মাওলানা আব্দুর রহিম চৌধুরীর এক পুত্র ও তিন কন্যা রয়েছেন। মরহুম মাওলানা আব্দুর রহিম চৌধুরীর একমাত্র পুত্র ও তাঁর ভাতিজা এমএমএ ফাত্তাহ চৌধুরী ফয়সল একজন সজ্জন ব্যক্তিত্ব। তিনি সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার মঈনুল হক কলেজ ও জগন্নাথপুর ডিগ্রি কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রাক্তন প্রভাষক। বর্তমানে তিনি যুক্তরাজ্য প্রবাসী। তিনি এনটিভি ইউরোপ যুক্তরাজ্যের নর্দামটনের একজন খ্যাতিমান সাংবাদিক।
মো. আব্দুল গফুর চৌধুরী খুব সুশৃঙ্খল জীবনযাপন করতেন। তাঁর মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ বক্তব্যে সনাকের সাবেক সভাপতি ও সুনামগঞ্জ কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের সাধারণ স¤পাদক নুরুর রব চৌধুরী বলেন, উনি অত্যন্ত ব্রিলিয়ান্ট ছিলেন। খান্দানি পরিবারের লোক ছিলেন। উনার কোনো ব্লেইম নাই, কমপ্লেইন নাই। উনি অত্যন্ত নির্লোভ মানুষ ছিলেন।
মদন মোহন কলেজ সিলেটের প্রাক্তন অধ্যক্ষ লে. কর্নেল আতাউর রহমান পীর বলেন, সবাই জানেন যে, উনি একজন সৎ ন্যায়পরায়ণ মানুষ ছিলেন। চাকুরি জীবনেও সততার উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। তিনি চাকুরি পরবর্তী জীবনেও যে সমস্ত জায়গায় কাজ করেছেন সেখানেও তাঁর সততার উদাহরণ রেখেছেন। সৎ জীবনযাপনের কারণে আমাদের মাঝে তাঁর স্মৃতি অম্লান থাকবে।
সাবেক জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, তিনি অত্যন্ত সৎ ছিলেন, কর্তব্য কর্মে তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠাবান ছিলেন। তিনি দাপ্তরিক কাজ গুরুত্ব দিয়ে করতেন। সরকারি যে বিধি বিধান আছে, আইন কানুন আছে সেই বিধি বিধানের মধ্য থেকে তিনি মানুষকে সেবা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। কখনো মানুষকে তিনি হয়রানি করেননি। সেটি শুনে আমার অনেক ভালো লেগেছে যে, আমার একজন প্রাক্তন সহকর্মী ভালো কাজ করেছেন। আমি আজকে তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। আল্লাহ তায়ালা যেন তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করেন।
সুনামগঞ্জ -৪ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ বলেন, মো. আব্দুল গফুর চৌধুরী সাহেব শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার মানুষ ছিলেন। তিনি প্রশাসনে কাজ করেছেন। প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে তিনি সততার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। আমি যখন ১৯৯৫ সালে সুনামগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতিতে আইনজীবী হিসেবে যোগদান করি তখন তিনি সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়ে জেলা আইনজীবী সমিতিতে কাজ করতেন। উনার এখানে গেলে আমাদের নবীন আইনজীবীদেরকে উৎসাহ দিতেন। অত্যন্ত ভালো একজন মানুষ ছিলেন। ভালো মানুষ হিসেবে উনার তুলনা হয় না। উনার মতো একজন ভালো মানুষকে হারিয়ে আমরা সুনামগঞ্জের মানুষ শোকাহত। এই ভালো মানুষটিকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যেন জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করেন।
আজ শ্রদ্ধাভাজন মো. আব্দুল গফুর চৌধুরী’র প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। তাঁর স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। তাঁর কর্ম ও কীর্তি উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। আল্লাহ আপনার বান্দাকে জান্নাতের মেহমান হিসেবে কবুল করুন। আমীন।
লেখক : প্রভাষক, বাংলা বিভাগ, জাউয়া বাজার ডিগ্রি কলেজ, ছাতক, সুনামগঞ্জ।