বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতির মৌলিক কথা- ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়’ এবং ‘বন্ধুত্বপূর্ণ সহাবস্থান’-এর ওপর ভিত্তি করেই বর্তমান বাংলাদেশের সব কূটনৈতিক প্রয়াস প্রবহমান। বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে কারামুক্ত হয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। বুকের ভেতর পুঞ্জীভূত সব বেদনা, যন্ত্রণাকে শক্তি করে লাখো শহীদের রক্তে সিক্ত বাংলার মাটিতে দ-ায়মান থেকে স্বদেশিকতার সুদৃঢ় ব্রতে উজ্জীবিত সেই আত্মপ্রত্যয়ী ও দূরদৃষ্টিস¤পন্ন মহান নেতা, দেশ বিনির্মাণ করার অভীষ্ট লক্ষ্যে নেমে পড়লেন। দ্রুততম সময়ের মধ্যেই সমাপ্ত করলেন সংবিধান সৃজনের কাজটি। একই সাথে প্রণীত হলো বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি। বাংলাদেশ সংবিধানের ২৫-এর ১ ও ২ নম্বর অনুচ্ছেদে বর্ণিত রয়েছে, অপর রাষ্ট্রের প্রতি বাংলাদেশের কূটনৈতিক আচরণ, আন্তর্জাতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তি, জাতিসংঘ সনদের প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা, মুসলিম দেশগুলোর সাথে সুস¤পর্কসহ আরও অন্যান্য বিষয়।
২০০৯ সাল থেকে অদ্যাবধি ধারাবাহিক এবং সুশৃঙ্খলভাবে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে আসছেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শে আদর্শিত এবং সুযোগ্য উত্তরসূরী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরতœ শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন, অধিক জনপ্রিয় আওয়ামী লীগ সরকার। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির আজকের এই জনপ্রিয়তা বা উৎকর্ষতার মূলে রয়েছে, শেখ হাসিনা সরকারের সুদক্ষ নেতৃত্ব, কূটনৈতিক দূরদর্শিতা, বিশ্বনেতাদের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত স¤পর্ক উন্নয়নের ধারাবাহিকতা, বিশ্বের বিভিন্ন সমস্যায় বলিষ্ঠ ভূমিকা এবং বৈশ্বিক বিষয়ে তাঁর একনিষ্ঠ প্রজ্ঞা। তিনি শুধু বঙ্গবন্ধু কন্যা হিসেবেই নন, একজন সৎ দেশপ্রেমিক এবং সাধারণ মানুষের আস্থাভাজন বা বিশ্বস্ত নেতা হিসেবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়নে যোগ করেছেন এক অনন্য মাত্রা। ফলশ্রুতিতে উক্ত কাজটি হয়েছে আরও শক্তিশালী, টেকসই, সম্প্রসারিত ও অর্থবহ। যে কারণে বর্তমান সময়ে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের সামাজিক অবস্থান অনেক সুদৃঢ় এবং অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থানও বেশ সম্মানজনক অবস্থানে উন্নীত হয়েছে। বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের এক রোল মডেল হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
শুধু বহুপক্ষীয় ক্ষেত্রেই নয়, দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক বা উপ-আঞ্চলিক ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের চলমান অবস্থান ও ভাবমূর্তি যে উচ্চতায় আসীন হয়েছে তার পেছনে রয়েছে, শেখ হাসিনার দৃঢ়তা, আলাপ-আলোচনা ও সমঝোতা স্থাপনে পারঙ্গমতা। তিনি অন্য রাষ্ট্রের সাথে সুস¤পর্ক নিশ্চিত করেছেন পার¯পরিক সম্মান, শ্রদ্ধা ও ভ্রাতৃত্ববোধকে মূল্যায়ন করে। এর মূলে ছিল, ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়’ পররাষ্ট্রের এই মৌলিক নীতির ওপর প্রগাঢ় বিশ্বাস ও আস্থা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একনিষ্ঠ ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের অর্জনগুলো নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় অবস্থানে স্থান পেয়েছে। বহুপক্ষীয়, আঞ্চলিক ও দ্বিপক্ষীয় ক্ষেত্রে বাংলাদেশের এমন উল্লেখযোগ্য অর্জন বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধুর পর বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার শেখ হাসিনা ছাড়া আর অন্য কোনো সরকার এনে দিতে সক্ষম হননি। শেখ হাসিনা বাংলাদেশের ঝুঁকিপূর্ণ ভৌগোলিক অবস্থানের প্রভাব স্বীকার করে জলবায়ু পরিবর্তনের গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলো মোকাবিলার জন্য সব সময় সতর্ক ও সোচ্চার থেকেছেন এবং অধিক সাবধানতা অবলম্বন করেছেন। টেকসই উন্নয়ন এবং জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতার প্রতি তাঁর প্রতিশ্রুতি বাংলাদেশকে জলবায়ু কূটনীতিতে বিশ্বনেতা হিসেবে স্থান দিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন কৌশল এবং কর্ম পরিকল্পনার মতো উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে তিনি জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব প্রশমিত করতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং আর্থিক সংস্থান সুরক্ষিত করার ওপর অধিক গুরুত্বারোপ করেছেন। এই বিরূপ প্রভাবকে প্রশমিত করতে শেখ হাসিনার কর্মদক্ষতা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করেছে এবং একজন দায়িত্বশীল বৈশ্বিক নেতা হিসেবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে উন্নীত করেছেন।
বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার যে স্বপ্ন ছিল, সেটার সাথে সামঞ্জস্যতা রেখে শেখ হাসিনা একটি শক্তিশালী অর্থ সংশ্লিষ্ট কূটনৈতিক কৌশল অবলম্বন করেছেন। বিদেশে বিনিয়োগ এবং বাণিজ্যের গুরুত্ব স্বীকার করে, তিনি সক্রিয়ভাবে বিশ্বের উন্নত ও স্বনির্ভর দেশগুলোর সাথে অংশীদারিত্ব স্থাপনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, টেক্সটাইল, ফার্মাসিউটিক্যালস এবং তথ্যপ্রযুক্তির মতো খাতের সম্প্রসারণের ফলে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছেন। শেখ হাসিনার কূটনৈতিক প্রচেষ্টার ফলে প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বাণিজ্য সম্পর্ক বৃদ্ধি পেয়েছে, যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে প্রত্যক্ষভাবে প্রভাব ফেলেছে।
শেখ হাসিনার পররাষ্ট্রনীতির মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি বঙ্গবন্ধুর সামাজিক ন্যায়বিচার ও সহানুভূতির আদর্শের সাথে অধিকতর প্রাসঙ্গিক। মিয়ানমার সরকারের নিপীড়নের শিকার হয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় প্রদানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ব্যতিক্রমী উদারতা এবং উন্নত মন-মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। আমাদের দেশের স¤পদের ওপর প্রচ- চাপ থাকা সত্ত্বেও, শেখ হাসিনা সরকার মানবাধিকার ও দেশের মর্যাদা সমুন্নত রাখার গুরুত্বের ওপর জোর দিয়ে বাস্তুচ্যুতদের আশ্রয় দিয়েছেন। রোহিঙ্গাদের প্রতি তাঁর অটল প্রতিশ্রুতি শুধু বাংলাদেশের মানবিক চেতনাকেই উপস্থাপন করেনি বরং মানবাধিকারের ক্ষেত্রেও দেশটি বিশ্বব্যাপী অকৃত্রিম সুনাম অর্জন করেছে।
মমতাময়ী সরকার, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরতœ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোতে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হচ্ছে। বহুপাক্ষিকতার তাৎপর্য স্বীকার করে, তিনি জাতিসংঘ (ইউএন) এবং অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশন (ওআইসি)-এর মতো বৈশ্বিক ফোরামের সাথে সক্রিয়ভাবে সংশ্লিষ্ট রয়েছেন। জাতিসংঘের ব্যানারে শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার্থে দেশটির অঙ্গীকারকে তুলে ধরেছে স্বমহিমায়। ইতোমধ্যে, শেখ হাসিনার একনিষ্ঠ কূটনৈতিক প্রচেষ্টার ফলে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোতে নেতৃত্বের ধারাবাহিকতায় প্রধান পদগুলো অর্জন করেছে, যা বিশ্ব মঞ্চে দেশের প্রভাব, সুনাম এবং গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করছে।
ব্যক্তিগতভাবেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনা বিশ্বনেতাদের কাছে অধিকতর গ্রহণযোগ্য এবং সমাদৃত। যেটা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের সম্মানকে বাড়িয়ে তুলছে। তাঁর এই অসামান্য অর্জনের পেছনে রয়েছে আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে যথাযথ অনুধাবন, বিশ্লেষণ ও অনুসরণ। সর্বোপরি, পররাষ্ট্রনীতির কূটকৌশল সঠিকভাবে প্রয়োগ করা। এছাড়া আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তাঁর প্রজ্ঞা ও কূটনৈতিক বিশ্লেষণ ক্ষমতা এক্ষেত্রে এক অনন্য ভূমিকা পালন করেছে। তিনি ব্যক্তিগতভাবেও অনেক পুরস্কার, উপাধি আর খেতাবে ভূষিত হয়েছেন। জাতিসংঘের চলতি সাধারণ অধিবেশনে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অসাধারণ অবদান রাখার জন্য শেখ হাসিনাকে ‘এসডিজি অগ্রগতি পুরস্কার’-এ পুরস্কৃত করা হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশকে একটি উন্নয়নের রোল মডেল বানিয়েছেন। তিনি ১২ ডিসেম্বর ১৯৯৬ সালে হায়দরাবাদ হাউসে ৩০ বছরের গঙ্গা চুক্তি করে পৃথিবীতে এক বিরল ইতিহাস সৃজন করেছেন। এছাড়াও তিনি চট্টগ্রাম হিল ট্রাক্টসের (পার্বত্য অঞ্চল) শান্তিচুক্তি করেছেন (সিএইচটি একর্ড, ২রা জানুয়ারি ১৯৯৭)। ফলে মারামারি, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, রক্তপাত বন্ধ হয়েছে এবং অসাম্প্রদায়িকতা বজায় থাকছে। সেই শান্তিচুক্তি এখন বাস্তবায়িত হচ্ছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একটি কালজয়ী কৃতিত্ব হলো, স্বপ্নের পদ্মা সেতুকে বাস্তবে বিনির্মাণ করা। প্রকৃতপক্ষে, একটা দেশ আয়তনে যখন বিশাল হয়, তখন দরকার হয় সঠিক নেতৃত্বের। মার্কিন মুলুকে জর্জ ওয়াশিংটন না থাকলে ডিক্লারেশন অব ইনডিপেনডেন্স হতো না। আব্রাহাম লিংকন যদি চিফ জাস্টিস ট্যানির কথা শুনতেন (যেমন- পাওয়ার অব হেবিয়াস করপাস তুলে নিতে হবে, কোনো ব্যক্তিকে এরেস্ট করা যাবে না), তাহলে আজ এক বন্ধনে আমেরিকা থাকতো না। অনুরূপভাবে, নেপোলিয়ন এবং ডি গল দিয়েছেন আধুনিক ফ্রান্স আর মজ্জিনি ও গ্যারিবল্ডি দিয়েছেন ইতালি। ম্যাগনাকার্টা ব্রিটেনকে দিয়েছে আধুনিক দেশ, আইনের দেশ। মাও সে তুং দিয়েছেন উন্নত চীন। মহাত্মা গান্ধী ও নেহেরু সৃষ্টি করেছেন আধুনিক ভারত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দিয়ে গিয়েছেন স্বাধীন বাংলাদেশ। আর তাঁর যোগ্য উত্তরসূরী শেখ হাসিনা সেই যুদ্ধ-বিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশকে করছেন উন্নত এবং আধুনিক। পদ্মা সেতু বিনির্মাণ এবং নেতৃত্বদান ক্ষমতা, বুদ্ধিমত্তা ও মননশীলতা শেখ হাসিনাকে নিয়ে গিয়েছে এক অনন্য উচ্চতায়। তিনি বাঙালি জাতির উন্নতির মূখ্য অগ্রনায়ক হয়ে অমর হয়ে থাকবেন।
আঞ্চলিক নীতি, পররাষ্ট্রনীতি, দ্বিপক্ষীয় বা বহুপক্ষীয় নীতি, পরাশক্তির সাথে তাল মিলিয়ে চলার কার্যকরী নীতি- এসবই বাংলাদেশকে একটি বিশেষ স্থান দিয়েছে পৃথিবীতে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরলস ও বুদ্ধিদীপ্ত পরিশ্রমও বাংলাদেশকে দিয়েছে সুমহান মর্যাদা। আজ জার্মানির চ্যান্সেলর, সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী, মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের নাম উচ্চারিত হলে চলে আসে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকার বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য তনয়া দেশরতœ শেখ হাসিনার নামও। সর্বোপরি, স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা ‘স্মার্ট বাংলাদেশের কা-ারী’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে বীরদর্পে গর্ব করে বাঙালি জাতি।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক ও সাবেক বিভাগীয় প্রধান, মার্কেটিং বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।