জাহাঙ্গীর আলম ভুঁইয়া ::
গ্রামগুলোর চারপাশ টাঙ্গুয়াসহ বিভিন্ন হাওরবেষ্টিত। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হাওরপাড়ের বিনোদপুর, পনিয়াখালি, কান্দাপাড়া, রতনপুর গ্রামে নেই প্রাথমিক বিদ্যালয়। বর্ষায় নৌকা আর হেমন্তকালে হেঁটে যেতে হচ্ছে চার কিলোমিটার দূরবর্তী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। বাড়ি থেকে স্কুল দূরে থাকায় শিশুরাও স্কুলে যেতে চায় না। ফলে শিক্ষাজীবনের শুরুতেই শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে ওইসব গ্রামের কোমলমতি তিন শতাধিক শিশু।
গ্রামগুলোর অধিকাংশ মানুষই হাওর থেকে মাছ ধরে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। সন্তানদের শিক্ষা লাভের জন্য তীব্র আকাক্সক্ষা থাকা সত্ত্বেও সুযোগ ও সামর্থ্য না থাকায় সন্তানদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে শংকিত অভিভাবকরা। যুগ যুগ ধরে তাহিরপুর উপজেলার টাঙ্গুয়ার হাওর তীরবর্তী গ্রামগুলোয় এ দুরবস্থা। এখানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের দাবি দীর্ঘদিনের।
জানা গেছে, ৪টি গ্রামে প্রায় পাঁচ শতাধিক পরিবারের বসবাস। পরিবারগুলোয় ৫ থেকে ১০ বছর বয়সী শিশু রয়েছে প্রায় তিন শতাধিক। গ্রামগুলোর পশ্চিম-উত্তরে চার কিলোমিটার দূরে বীরেন্দ্রনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পশ্চিমে টাঙ্গুয়ার হাওর অন্য পাড়ে প্রায় ৬ কিলোমিটার দূরবর্তী ইন্দ্রপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পূর্বদিকে এরালিয়াকোণা হাওরের অপর পাড়ে মন্দিয়াতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং পূর্ব-উত্তর দিকে ৫ কিলোমিটার দূরবর্তী রঙ্গাছড়া নদীর অন্য পাড়ে সোনাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
এই অবস্থায় চার গ্রামের প্রায় শতাধিক শিক্ষার্থী দীর্ঘদিন ধরে দূরবর্তী বিদ্যালয়ে গিয়ে লেখাপড়া করলেও শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে যাওয়ার অনীহা দিন দিন বাড়ছে। এতে অভিভাবকরা সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন।
এলাকাবাসী জানান, বিনোদপুর গ্রামের এনামুল হক ২০০৪ সালের ৪ সেপ্টেম্বর তেত্রিশ শতক দানকরা জায়গায় গ্রামবাসীর উদ্যোগে এনামপুর ও বিনোদপুর বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নামকরণ করা হয়। ২০০৫ সালের ১ জানুয়ারি বিনোদপুর গ্রামের জহিরুল ইসলাম বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নিয়ে আরও তিনজন সহকারী শিক্ষিকা নিয়ে বিনাবেতনে এলাকার শিশুদের পাঠদান শুরু করার দুই বছর চলার পর স্কুল পরিচালনা কমিটি গঠন করে ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে শিক্ষকদের স্থায়ীভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০১০ সালে এফআইভিডিবির সহযোগিতায় নেদারল্যান্ডস সরকারের আর্থিক অনুদানে ১২ লাখ ৭২ হাজার ৩০০ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয় একটি স্কুল ভবন। ২০০৭-২০১২ সাল পর্যন্ত গ্রামবাসীর অর্থায়নে একজন শিক্ষককে নিয়মিত বেতন প্রদান করা হয়। প্রধান শিক্ষকসহ বাকি দুজন নিজ এলাকার কোমলমতি শিশুদের কথা বিবেচনা করে দীর্ঘ ৭ বছর এখানে বিনা বেতনে পাঠদান করার পর শিক্ষকদের সংসারের অভাব-অনটনের কারণে বিদ্যালয়টির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। ২০১৩ সালে সারাদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ হওয়ার সময় প্রধান শিক্ষক বিদ্যালয়টি সরকারিকরণের আশায় ফের চালু করেন এবং স্কুলটির জাতীয়করণের জন্য ১৮ মে, ২০১৭ সালে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে ফাইল জমা দেওয়া হয়। যার ডায়েরি নং-৪৪৭০, সিরিয়াল নং-৭৭। বিভিন্ন দপ্তরে ঘুরে কোনো উপায়ন্তর না পেয়ে তিনি এলাকার লোকজনকে নিয়ে স্কুলটি জাতীয়করণের লক্ষ্যে স্থানীয় সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোয়াজ্জেম হোসেন রতনের সহযোগিতা কামনা করে। সংসদ সদস্য ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী বরাবর একটি ডিও লেটার পাঠান।
সাকিরা বেগম, সায়লা বেগমসহ গ্রামের কয়েকজন শিক্ষার্থী জানায়, গ্রামে বিদ্যালয় না থাকায় তাদের অনেক সহপাঠী দূরের স্কুলে যায় না। আবার অনেকে লেখাপড়াও ছেড়ে দিয়েছে। গ্রামে একটি বিদ্যালয় হলে তারা লেখাপড়া করার সুযোগ পেত বলে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা জানায়।
স্কুল পরিচালনা কমিটির সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমাদের মতো নিজেদের পরবর্তী প্রজন্মও স্কুলের অভাবে লেখাপড়া করতে পারছে না। ফলে নিরক্ষরতা, শিশুশ্রম বাড়ছে। আগামী প্রজন্মের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য এ স্কুল জাতীয়করণে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষসহ প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন জানান।
স্কুলটির জমিদাতা এনামুল হক বলেন, বিদ্যালয় স্থাপনের জন্য ৩৩ শতক জমি দান করে মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে শুধু আশ্বাসই পেয়েছি। কাজের কাজ কিছুই হয়নি। মৃত্যুর আগে বিদ্যালয়টির জাতীয়করণ দেখে যেতে চাই।
স্থানীয় ইউপি সদস্য শাহজাহান খন্দকার বলেন, একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় না থাকায় ৪টি গ্রামের অনেক শিশু দূরে গিয়ে খুব কষ্ট করে লেখাপড়া করছে। অনেকে ঝরে পড়ছে। শিক্ষার অভাবে শিশু-কিশোর ও যুবসমাজ বিপথগামী হচ্ছে।
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আবুল খায়ের জানান, যেসব জায়গায় স্কুল নেই সেসব জায়গায় স্কুল স্থাপনের জন্য চলতি বছরের এপ্রিল মাসে একটি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। অনেকেই এ প্রকল্পের আওতায় আমাদের কাছে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিয়েছেন। আমাদের টিম মাঠপর্যায়ে তদন্ত করে যাচাই-বাছাই করে যেসব জায়গায় স্কুলের বেশি প্রয়োজন সেসব জায়গায় স্কুল নির্মাণ করা হবে।