1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
  3. [email protected] : wp-needuser : wp-needuser
বৃহস্পতিবার, ২৫ জুলাই ২০২৪, ০৬:২৬ অপরাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

তারুণ্যের নৈতিকতা ও সমাজ ভাবনা : ড. রেবেকা সুলতানা

  • আপডেট সময় সোমবার, ২৮ আগস্ট, ২০২৩

 

তরুণ বয়স মানব জীবনের বিস্ময়কর সময়। তরুণরা আমাদের সব নির্ভরতার স্থল। তারুণ্য মূলত কোন সময়? শৈশব ও প্রাপ্তবয়স্কের মাঝামাঝি সময়ে যারা অবস্থান করে তাদের তরুণ বলা হয়। তরুণরা পুরো পৃথিবীর মেরুদণ্ড। তরুণদের মধ্যে কোনো পিছুটান থাকে না। যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য তারা প্রস্তুত থাকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম তারুণ্যের জয়গান করেছেন। রবিঠাকুর বলেছিলেন, “ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা, ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ, আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা।”

কাজী নজরুল নিজেই ছিলেন তারুণ্যের প্রতীক। তিনি বলেছেন, “আমরা শক্তি আমরা বল আমরা ছাত্রদল। মোদের পায়ের তলায় মূর্ছে তুফান ঊর্ধ্বে বিমান ঝড়-বাদল।” অর্থাৎ, তুফানও তরুণদের চরণতলে থাকে, কী পরিমাণ সাহস তরুণ জীবনে!

সাম্প্রতিক সময়ে পৃথিবীতে যেসব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে, তরুণদের মাধ্যমেই হয়েছে। প্রাচীনকালেও এর যে বিপরীত চিত্র দেখি তা কিন্তু নয়। কারণ প্রাচীনকালে মেসিডোনিয়ার রাজা আলেকজান্ডার মাত্র ২৩ বছর বয়সে অর্ধেক পৃথিবী জয় করেছেন। হযরত মুহাম্মদ (স.) এর দিকেও যদি তাকাই, তিনি ২০ বছর বয়সে ‘হিলফুল ফুজুল’ নামে যে সংগঠন তৈরি করেন। এর মাধ্যমে কুরাইশ বংশের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মাঝে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন। মুঘল স¤্রাট আকবর মাত্র ১৩ বছর বয়সে দিল্লির সিংহাসনে বসেন। ১৯ বছর বয়সে তিনি তার কূটনৈতিক দূরদর্শিতার মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষকে একটি আধুনিক বৃহত্তর রাষ্ট্রের সোপানে নিয়ে যান। রাজনীতিতেও আমরা দেখি সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে তরুণ সমাজ।

বর্তমানে আধুনিকতার ছোঁয়ায় আমরা উন্নত থেকে উন্নততর অবস্থানে যাচ্ছি, অন্যদিকে তরুণদের নৈতিক অবক্ষয় মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। যারা পৃথিবীর মেরুদ-, তাদের যখন নৈতিকতায় ঘাটতি দেখা দেবে, মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটবে সেটি কিন্তু পৃথিবীর জন্য অশনিসংকেত। এটি অব্যাহত থাকলে ভীষণ সংকটময় কাল দেখা দিতে পারে। যেটা থেকে আমাদের পরিত্রাণ পেতে হলে অনেক কষ্ট করতে হবে। এই যে অশনিসংকেত, এটি যে শুধু তরুণদের ক্ষতি করবে তা নয়, গোটা মানবজাতির জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। যেহেতু পরিবর্তনটা তারাই নিয়ে আসছে, তাদের ক্ষেত্রে পরিবর্তনটা যদি ইতিবাচক না হয়ে নেতিবাচক হয়, তাহলে এটি পুরো বিশ্বের জন্যই ধাক্কা।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যদি লক্ষ করি, ঐশীর ঘটনা সামনে নিয়ে আসা যায়, যার টাকার কোনো অভাব ছিল না। জীবন খুবই সমৃদ্ধ ছিল। কিন্তু এক মাদক তাকে নৈতিক অবক্ষয়ের শেষ পর্যায়ে নিয়ে গেছে। তাকে মানুষ থেকে পশুতে পরিণত করেছে। এই যে অবক্ষয় এটা যদি দিনের পর দিন চলতে থাকে, তখন কিন্তু মা-বাবা, ভাই-বোন, প্রতিবেশী এগুলো মাথায় থাকে না, যখন নৈতিক অবক্ষয় ঘটে। বড় বড় অনেক ঘটনা ঘটে, যেটা রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়। নৈতিক অবক্ষয়ের ফলে তরুণরা যেকোনো কিছু করতে পারে নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করেই। এ ঘটনাগুলো কেন ঘটে তার কিছু কারণ আছে, প্রথমত সুশিক্ষার অভাব। নৈতিকতার ঘাটতি থাকায় তারা যেসব অসামাজিক কার্যকলাপ করে এর প্রধান কারণ হলো সে পুঁথিগত শিক্ষাটা প্রতিষ্ঠান থেকে ঠিকই নেয়, কিন্তু সুশিক্ষাটা সে নিতে পারে না। এবং জীবনের যে শিক্ষা ও দর্শন, সেখান থেকে সে ছিটকে পড়ে।

সুশিক্ষা এমন বিষয় যা মানুষকে রুপা বা স্বর্ণ থেকে হীরায় পরিণত করে। এ সুশিক্ষা সবাই নিতে পারে না, কারণ সুশিক্ষিত মানুষ মানেই স্বশিক্ষিত। সুশিক্ষা পেলে তার নৈতিক অবক্ষয় ঘটবে না। এর অভাবেই অবক্ষয় ঘটছে। তারপর নিরক্ষর কিছু মানুষ থাকে, যারা শুধু হয়তো স্বাক্ষর করতে পারে বা অল্প একটু পড়তে পারে, তাদের আসলে আমরা শিক্ষিত বলতে পারি না। এ রকম ৪০ শতাংশ মানুষ আছে আমাদের। এক্ষেত্রে দেখা যায় তাদের শিক্ষার দৈনতার কারণ, সে কিছুই জানে না। না জেনেই অসামাজিক ও অনৈতিক কার্যকলাপ করে থাকে। এটি আমাদের জন্য বড় একটি ধাক্কা। তরুণদের সঠিক পথে পরিচালিত করতে হলে এ নিরক্ষরতা দূর করা জরুরি। তারপর যেটি দেখা যায়, তরুণদের নৈতিক অবক্ষয়ের অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে সম্মানজনক পেশায় না যেতে পারা। তারা যখন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়, তখন তার এমন এক ধরনের চেতনাবোধ তৈরি হয় যে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ চাকরি সে পাবে বা পৃথিবীতে সে সর্বোচ্চ পর্যায়ে যাবে। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায়, আশার সঙ্গে কাজের মিল হয় না। যেহেতু আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে অনেক ত্রুটি থাকে। এক্ষেত্রে দেখা যায় তরুণরা নিজেদের সঠিক জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি বিধায় হতাশ হয়ে পড়ে। এ হতাশা, উদ্বিগ্নতা তাকে মাদকাসক্তির দিকে ধাবিত করে। এতে সে অনেক সময় অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ে। এদিকে তরুণ সমাজের মধ্যে অপসংস্কৃতির প্রভাব রয়েছে।

দেশীয় সুস্থ, সুন্দর সংস্কৃতির পরিবর্তে জাঁকজমকপূর্ণ অপসংস্কৃতি দেখে তরুণরা তার দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ে। যেগুলো তাদের নৈতিক অবক্ষয় ঘটায়। যেখান থেকে তাদের হুট করেই ফিরে আসা সম্ভব হয় না। অবশ্য মনোরম ও নির্দোষ চিত্ত বিনোদনের ব্যবস্থা আমাদের সমাজে খুবই কম, অর্থাৎ যেখানে সুষ্ঠু চিত্ত বিনোদন করা যাবে। সেটিও একটি কারণ, যা তাদের পর্যায়ক্রমে অবক্ষয়ের দিকে নিয়ে যায়। এক্ষেত্রে পরিবারের সচেতনতাবোধও প্রয়োজন। যখন তারা তারুণ্যে প্রবেশ করে একধরনের স্বাধীনতা চায়, এ স্বাধীনতা পেলে তরুণরা তার অপব্যবহার করে। যে কারণে তারা অনেক সময় অনৈতিক কাজে ঝুঁকে পড়ে। কারণ সবচেয়ে বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলো পরিবার, যেখান থেকে তার নৈতিক মূল্যবোধের কাঠামোটি তৈরি হয়। যেটা আমরা ছোটবেলায় দেখি, মূল শিক্ষা সেখান থেকেই আসে। এক্ষেত্রে অনেক বড় ঘাটতি রয়েছে, মা-বাবা অনেক বেশি ব্যস্ত থাকার কারণে সন্তানের সঙ্গে সঠিক যোগাযোগ করতে পারে না। সন্তানকে যে ধরনের পরিবেশ দেয়া দরকার, সেটিও সম্ভব হয় না। যে কারণে এ ধরনের সমস্যাগুলো দেখা দেয়। এছাড়া ধর্মীয়, নৈতিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ না করার বিষয়টিও সামনে চলে আসে। এখানে ঘাটতি থেকে যায়। তরুণদের নৈতিকভাবে যদি তৈরি করতে হয়, তাহলে বর্তমান সময়ে তাদের মধ্যে ধর্মীয় যে অপব্যাখ্যা করা হয়, সেখান থেকে তাদের দূরে রাখতে হবে। পরবর্তী যে বিষয়টি গুরুত্ব পায়, তা হলো শিক্ষকদের সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে হবে।

পরিবারের পরেই শিশুদের যে পদচারণা থাকে তা বিদ্যালয়, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে যেহেতু শিক্ষকদের কথা শিশুরা শোনে, তাই শিক্ষকদের দায়িত্ব নিতে হবে। বর্তমান যুগ প্রযুক্তির আলোয় বিকশিত। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যাপকভাবে পৃথিবীকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। সেখানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ভালো-মন্দের প্রভাব স¤পর্কে তাদের সচেতন করতে হবে। এরপর যে বিষয়টি রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অসাম্প্রদায়িক যে মানসিকতা, সে চিন্তায় তাদের চালিত করতে হবে। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সবাই মিলে এ কাজ করতে হবে। কেউ এর দায়ভার এড়াতে পারে না। একজন অসাম্প্রদায়িক মানুষ কারো ক্ষতির কারণ হয় না। যার যে অবস্থান রয়েছে, সে অবস্থান থেকে দায়িত্ব নিতে হবে। এটি সবার দায়িত্ব, আমাদের একার দায়িত্ব না। সেই সঙ্গে অসুস্থ ছাত্ররাজনীতির চর্চা থেকে সরে এসে সুষ্ঠু রাজনীতির চর্চা অব্যাহত রাখতে হবে। নাহলে অল্প বয়সে একজন শিক্ষার্থীর হাতে টাকা, ক্ষমতা ও অবৈধভাবে অনেক কিছু চলে আসবে, কিন্তু সে নিজেকে প্রকৃতপক্ষে আবিষ্কার করতে পারবে না। এক্ষেত্রে সমাজের বিদগ্ধজন ও নৈতিক ব্যক্তির সং¯পর্শে যদি তারা থাকে, তাহলে অনেকটাই সরে আসতে পারবে। এ জায়গাগুলোকে যদি আমরা গুরুত্ব দিই, তাহলে একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় তরুণদের নৈতিক, মানবিক, সাংস্কৃতিক ও দায়িত্বশীল করে গড়ে তুলতে হবে। এজন্য নৈতিকতার শক্ত ভিত্তি যদি সন্তানকে দেয়া যায়, তাহলে তাদের আর পাহারা দিতে হবে না এবং বিপথগামীও হবে না। এক কথায় তার মননশীলতার বিকাশ ঘটাতে হবে। নাহলে সে অনৈতিকতার দিকে ঝুঁকে পড়বে। তরুণদের এ জায়গা থেকে যদি তুলে নিয়ে আসতে হয় এবং বাংলাদেশসহ পুরো পৃথিবীকে সমৃদ্ধ করতে হলে তরুণদের সর্বোচ্চ নৈতিক, মানবিক ও অসাম্প্রদায়িক হয়ে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হবে। এক্ষেত্রে তরুণদের মূল্যবোধস¤পন্ন মানবিক শিক্ষা দিতে হবে। এটি যদি থাকে তাহলে তারা বিশ্বকে নেতৃত্ব দিতে পারবে।

[ড. রেবেকা সুলতানা: অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়]

 

 

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com