1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
সোমবার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:৩৩ অপরাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও মানব সভ্যতার ভবিষ্যৎ : ড. মো. মোরশেদুল আলম

  • আপডেট সময় রবিবার, ২৭ আগস্ট, ২০২৩

বাংলাদেশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির প্রথম সংবাদ উপস্থাপিকা অপরাজিতাকে উপস্থাপন করে চ্যানেল টোয়েন্টিফোর। এর আগে ভারতের উড়িষ্যার একটি প্রাইভেট টিভি চ্যানেল এআই এঙ্কর লিসাকে উপস্থাপন করে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স হলো এমন একটি প্রযুক্তি, যা তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে যন্ত্র বা অ্যাপ্লিকেশনকে মানুষের বুদ্ধি ও চিন্তাশক্তির আদলে কাজের উপযোগী করে তোলে। উচ্চতর ক্ষমতাস¤পন্ন ক¤িপউটার, রোবট ও অন্যান্য যন্ত্র এর অন্তর্ভুক্ত। আন্দ্রেয়ার কাপলান এবং মাইকেল হেনলিন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সংজ্ঞায় বলেন, এটি একটি সিস্টেমের বহির্ভূত তথ্য সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারার ক্ষমতা, এমন তথ্য থেকে শিক্ষা গ্রহণ এবং ওই শিক্ষা ব্যবহার করে অভিযোজনের মাধ্যমে বিশেষ লক্ষ্য ঠিক করা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ প্রযুক্তির উন্নয়ন হচ্ছে। মূলত আগের তথ্য বিশ্লেষণ করেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিভিন্ন সেবা দিয়ে থাকে। অ্যালান টুরিং ১৯৫০ সালে তার উদ্ভাবিত ‘টুরিং টেস্ট’-এর মাধ্যমে কোনো যন্ত্রের চিন্তা করার ক্ষমতা আছে কিনা তা পরীক্ষা করা হয়। জন ম্যাকার্থি সর্বপ্রথম ১৯৫৫ সালে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স টার্মটি ব্যবহার করেন। পরের বছর নিউ হ্যামশায়ারের হ্যানোভার শহরের ডার্টমাউথ কলেজে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে তিনি তা প্রথম প্রকাশ করেন। এ জন্য জন ম্যাকার্থিকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অন্যতম জনক বলা হয়। তার অন্য সহযোগীরা হলেন মার্ভিন মিনস্কি, অ্যালেন নিউয়েল এবং হার্বাট এ সায়মন।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মূলত কোনো যন্ত্রের সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা, উপলব্ধি স¤পর্কিত জ্ঞান অর্জন, অর্জিত জ্ঞান কাজে লাগানো, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা, উদ্ভূত কোনো নতুন পরিস্থিতিতে সাড়া প্রদান প্রভৃতি বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণা করে থাকে। ধারণা করা হচ্ছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঠিক প্রয়োগে আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার বেড়ে ১৬ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়াবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রসার আমাদের দেশে ঘটলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মাত্রা অনেকগুণ বেড়ে যাবে। ম্যাককিঞ্জি গ্লোবাল ইনস্টিটিউটের এক গবেষণা মতে, আগামী ১২ বছরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারের মাধ্যমে বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ২ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব। যার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়বে। বাংলাদেশের শুধু যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটবে তা নয়, নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগও বাড়বে। ফলে বেকার সমস্যার সমাধান হবে। এর ফলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা উৎপাদনের হার যেমন অনেকগুণ বেড়ে যাবে, সেই সঙ্গে উৎপাদনের সময়ও বর্তমানের তুলনায় বহুগুণ কমে যাবে। ফলে স্বল্প সময়ে অধিক উৎপাদন করা সম্ভব হবে, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বয়ে আনবে।
টেলিকম কো¤পানি সফট ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা এবং জাপানের শীর্ষধনী মাসাওসি সনের মতে, আমি মনে করি, আজ থেকে ৩০ বছর পর বিশ্বে স্মার্ট রোবটের সংখ্যা হবে ১০ বিলিয়ন। এই রোবটরা ব্যাপকভাবে মানুষের চাকরি নিয়ে নেবে। যত শিল্প মানুষ গড়ে তুলেছে, সবই নতুন করে পুনর্বিন্যস্ত করা হবে।
আগামী দিনগুলোতে চিকিৎসাসেবায়, অফিস-আদালতে, শিল্প-কারখানায়, সংবাদ সংস্থা বা গণমাধ্যমে, ভাষান্তর প্রক্রিয়ায়, টেলিফোন সেবায়, বৈজ্ঞানিক গবেষণায়, হোটেল-রেস্তোরাঁ এমনকি বিপণিবিতানসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কর্মক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাস¤পন্ন যন্ত্র তথা রোবটের ব্যাপক ব্যবহারের আভাস দিচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এক গবেষণায় দেখা যায়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারের ফলে বিশ্বজুড়ে যেমন প্রায় ৭ মিলিয়ন কর্মক্ষেত্রের সুযোগ কমবে, তেমনি আরো ৭ দশমিক ২ মিলিয়ন কর্মক্ষেত্র উদ্ভব হবে। এই কর্মসংস্থানের জোগান দিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাবিষয়ক গবেষকের প্রয়োজনীয়তা বেড়ে যাবে। আগামী ১০ বছরে এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন হবে ১০ মিলিয়ন।
উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এখন বাংলাদেশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রসারে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ হাইটেক, আইটি, আইটিইএস শিল্পের বিকাশ ও বিস্তার, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে আকর্ষণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দক্ষ মানবস¤পদ উন্নয়নের লক্ষ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে ২৮টি হাইটেক পার্ক, সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক, আইটি ট্রেনিং অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপন করছে। আমাদের দেশেও এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাবিষয়ক প্রশিক্ষণ এবং বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রির ব্যবস্থা করা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় ও আইসিটি/হাইটেক ইন্ডাস্ট্রির মধ্যে সেতুবন্ধন সৃষ্টির মাধ্যমে মানবস¤পদ উন্নয়ন ও দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষায়িত ল্যাবরেটরি স্থাপন করছে। ল্যাবগুলো শিক্ষাদানের পাশাপাশি ছাত্র-শিক্ষকসহ গবেষকদের গবেষণার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে।
সুইজারল্যান্ডভিত্তিক একটি গবেষণা কেন্দ্র ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের তথ্যমতে, নতুন প্রযুক্তির কারণে ১৩ কোটিরও বেশি কাজের সুযোগের সৃষ্টি করবে। ডাটা এনালিস্ট, সফটওয়্যার ডেভেলপার, সোশ্যাল মিডিয়া ¯েপশালিস্ট এ ধরনের কাজ অনেক বাড়বে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের মূল চালিকাশক্তি। তাই যত বেশি এই প্রযুক্তিতে বিশেষজ্ঞের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে, ততই এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উন্নতি অর্জন করবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা খুবই দক্ষতার সঙ্গে ক্যান্সার কোষ শনাক্ত করতে পারে। ক্যান্সার কোষ শনাক্ত করা ছাড়াও মেডিকেল ইমেজিং রেডিওগ্রাফি, ম্যামোগ্রাফি, নিউক্লিয়ার মেডিসিন- প্রতিটি ক্ষেত্রেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা রোগ নির্ণয়ে সাহায্য করতে পারে। ক্যান্সার চিকিৎসায়, সার্জারি, ব্রাকিথেরাপিত তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ বসাতে এখন রোবটিক হাত ব্যবহার করা হচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাস¤পন্ন এসব রোবটিক হাত ক¤িপউটার প্রোগ্রাম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বলে নির্ভুলভাবে কাজ করতে পারে। অদূর ভবিষ্যতে মানুষের শরীর রোগমুক্ত রাখার জন্য জিনোম বিশ্লেষণ করে ত্রুটিযুক্ত জিন সংশোধন করা হবে। সে ক্ষেত্রে কোটি কোটি ডিএনএ পরীক্ষা করে দেখার দায়িত্ব নেবে কৃত্রিম বুদ্ধির কোনো স্মার্ট রোবট।
আধুনিক যানবাহনের প্রায় সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে অনেকগুলো মাইক্রো ক¤িপউটার। পৃথিবীর অনেক স্থানে এখন স্বয়ংক্রিয় চালকহীন গাড়ি চলছে। অনেক আধুনিক এয়ারপোর্টেও এক টার্মিনাল থেকে অন্য টার্মিনালে চালকহীন সংযোগকারী ট্রেন চলছে। পরিচ্ছন্নতার দায়িত্ব নিয়েছে স্বয়ংক্রিয় রোবট, ইমিগ্রেশন সামলাচ্ছে আধুনিক মেশিন। আধুনিক অফিস, ব্যাংক, হাসপাতাল, ব্যবসা-বাণিজ্য খেলাধুলা- সবখানেই এখন ক¤িপউটার প্রোগ্রাম ও নানা রকম অ্যাপের মাধ্যমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহৃত হচ্ছে। মহাকাশে ভাসমান স্যাটেলাইটগুলোর সবই স্বয়ংক্রিয়ভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। স্যাটেলাইট নেভিগেশন জিপিএস, গুগল আর্থ, গুগল ম্যাপ, গুগল সার্চ ইঞ্জিন- এসবই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ। পৃথিবীর অর্থনীতি এখন নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে। প্রতিদিন ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার লেনদেন হচ্ছে অনলাইন ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভালো দিকের পাশাপাশি খারাপ দিকও রয়েছে। আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, ৫০টিরও বেশি দেশ যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহারযোগ্য রোবট তৈরি করছে- যেটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে লক্ষ্য নির্ধারণ করবে এবং শত্রুকে হত্যার কাজটি করবে। এ ধরনের রোবট এবং ড্রোনের গবেষণায় প্রচুর অর্থও ব্যয় করা হচ্ছে।
স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির গবেষকরা দাবি করেছেন, তারা এমন একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরি করেছেন, যেটি সহজেই শরীরের বিভিন্ন পরীক্ষা করে কবে মানুষের মৃত্যু হবে, সেটা গণনা করে বলে দেবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরিতে যেসব সরঞ্জাম প্রয়োজন হবে এবং ব্যবহারের পর অকেজো হয়ে পড়া এসব যন্ত্র বা যন্ত্রাংশ যখন বর্জ্যে পরিণত হবে, তখন তা পরিবেশের জন্য ক্ষতির কারণ হবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা গবেষণায় অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী প্রতিষ্ঠান গুগলের প্রধান নির্বাহী সুন্দর পিচাই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারে বিপর্যয়ের আশঙ্কার কথা বলেছেন। মার্কিন সংবাদ মাধ্যম দ্য ওয়াশিংটন পোস্টকে প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপব্যবহার রুখতে নির্দিষ্ট নীতিমালা মেনে চলা। আর কীভাবে প্রযুক্তির অপব্যবহার হতে পারে, তা নিয়ে আগেই ভাবা উচিত। শুধু নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও উন্নয়ন করলেই চলবে না, সে প্রযুক্তির ব্যবহার যেন মানবসভ্যতার বিপক্ষে না যায়, সে বিষয়েও সতর্ক থাকতে হবে।
[ড. মো. মোরশেদুল আলম : শিক্ষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়]

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com