গত শুক্রবারের (২৫ আগস্ট ২০২৩) দৈনিক সুনামকণ্ঠের একটি সংবাদশিরোনাম ছিল, “খাস কালেকশনের নামে চাঁদাবাজি’। নিচে লেখা হয়েছে, “আদালতের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে তাহিরপুর উপজেলার শ্রীপুর ও ডাম্পেরবাজার নৌঘাটে চলছে অবৈধ খাস কালেকশন। খাস কালেকশন বন্ধে উচ্চ আদালতের স্পষ্ট নির্দেশনা থাকলেও সেটা মানা হচ্ছেনা। উপজেলার মন্দিআতা ও মনতলা গ্রামের একটি চক্র আদালতের আদেশ উপেক্ষা করে রাতে কয়লা, পাথরবাহী নৌকা ও চোরাই কয়লা নৌকা থেকে ৫-৭ হাজার টাকা করে অবৈধভাবে চাঁদা উত্তোলন করছে। তারা প্রতিদিন প্রায় লাখ টাকা উত্তোলন করছে অবৈধভাবে। চাঁদাবাজ চক্রের সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসনের কয়েকজন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে।” অন্যত্র বলা হয়েছে, “তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুপ্রভাত চাকমা বলেন, এতিম তালুকদার ওয়াকফ অব স্টেইট নি¤œ আদালতে যে মামলা করেছিল তা তাদের বিপক্ষে আদেশ হয়। তাই পরবর্তীতে সংক্ষুব্ধ হয়ে তারা উচ্চ আদালতে গেলে উচ্চ আদালতও স্বত্ত্ব মামলা মোকদ্দমাটি আবারও নি¤œ আদালতে পাঠিয়ে দেন। এই মামলাটি চলমান আছে। তবে প্রশাসনের কেউ খাস কালেকশনের সঙ্গে জড়িত নয় জানিয়ে তিনি বলেন, কেউ অবৈধভাবে চাঁদা তুললে আমরা অভিযান চালিয়ে থাকি।” তবে এই কর্মকর্তা বলতে পারতেন যে, তারপরও খাস কালেনশনের নামে চাঁদাবাজি চলতেই থাকে, সেটা তিনি বলেন নি এবং বোধ করি তাঁর পক্ষে কোনও প্রকারেই বলা সম্ভবও নয়। বললে সেটা হবে স্বীয় দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার চূড়ান্ত প্রকাশ এবং শেষে হয় তো তাঁর চাকরিই থাকবে না, তাছাড়া কারও চাকরি হারানো অবশ্যই ভালো কীছু নয়।
এই বাস্তবতার শেষ পর্যন্ত নিহিতার্থ একটাই, কায়েমি স্বার্থবাদীদের স্বার্র্থোদ্ধারের প্রকল্প বাস্তবায়নÑ অর্থাৎ ‘বিচার মানি, তালগাছ আমার’। যে-প্রকল্প বাস্তবায়ন চলে আসছে পৃথিবীতে সম্পদের ব্যক্তিগত মালিকানা উদ্ভবের ঊষাকাল থেকে।
সমাজবিকাশের ঐতিহাসিক নিয়ম মেনেই বর্তমান কালপর্বে আমাদের দেশের সমাজসাংস্থিতিক কাঠামোর একটা মূর্তনির্দিষ্ট ধরণ দাঁড়িয়েছে। এই ধরণের সুবৃহৎ পরিসরে কার্যকর আছে একটি ‘কাঠামোগত সহিংসতা’। তাত্ত্বিকরা বলেন, “এটা একটা ‘ব্যবস্থা’ হিসেবে জনগণের নির্দিষ্ট অংশের ক্ষতি করে চলে। সেকারণেই তা ‘সহিংসতা’। এই সহিংসতার সমর্থন আসতে থাকে বিদ্যমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং বিভিন্ন সংস্থা থেকে পদ্ধতিগতভাবে। যে কারণে একে একটা কাঠামোগত ক্ষতি বলা হচ্ছে।” খাস কালেকশন এবংবিধ ক্ষতিরই একটি মূর্তনির্দিষ্ট অর্থাৎ বাস্তব প্রকাশ কিংবা নমুনা মাত্র।
আমাদের সমাজটা এমনই। একে বদলে দিতে হবে। বদলাবার প্রশ্নটি এখানে অলোচ্য নয়। এখানে আলোচনার গতিমুখ ‘বিচার মানি, তালগাছ আমার’ অর্থাৎ তাত্ত্বিকদের আবিষ্কার ‘কাঠামোগত সহিংসতা’র পরিসরে কায়েমি স্বার্থোদ্ধার। সুতরাং আদি অকৃত্রিম ‘চোর পুলিশ খেলা’ চলবেই। নদী থেকে বালু উত্তোলন নিষিদ্ধ হলেও বন্ধ হবে না, দিনের বেলা অভিযান চলবে আর রাতের বেলা অভিযান বন্ধের ফাঁকে বালু উত্তোলন চলবে, চিহ্নিত উত্তোলনকারীদেরকে আইনের আওতায় এনে কখনওই ধরা হবে না। হাওরদুর্নীতি বন্ধের জন্যে বিভিন্ন নীতি প্রণীত হবে ও পদক্ষেপ নেওয়া হবে কিন্তু হাওরদুর্নীতি বন্ধ হবে না। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অবৈধ উপায়ে অর্থ আদায় করে আত্মসাৎ করবেন, কিন্তু প্রতিকার হবে না, তাঁর চাকরি যাবার বদলে তিনি শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের পদক অর্জন করবেন। বিষয়টা অনেকটা জনসমক্ষে ধুমপান দ-নীয় অপরাধ হলেও সেটা উপেক্ষা করা হবে, ধুমপান চলবেই। আইন থাকবে আইনের জায়গায়, প্রয়োগের নামে একটুও নড়বে না। প্রশাসন হরদম দহরম চালিয়ে যাবে, হয়ে উঠবে আরও আরও বেশি বেশি করে ‘করিবকর্মা’, ‘করিতকর্মা’ কখনওই হবে না, এটাকেই বলে প্রশাসনিক ব্যবস্থা। অর্থাৎ শেষ বিচারে ‘বিচার মানি, তালগাছ আমার’ নীতিই সমাজের পক্ষে সর্বোত্তম নীতি। সুতরাং কাঠামোগত সহিংসতার অদৃশ্য পতাকাতলে “আদালতের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে তাহিরপুর উপজেলার শ্রীপুর ও ডা¤েপরবাজার নৌঘাটে চলছে অবৈধ খাস কালেকশন।” চলছে এবং চলতেই থাকবে।