সুনামকণ্ঠ ডেস্ক ::
ঘনিয়ে আসছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ফলে দলীয় মনোনয়ন পেতে তৎপরতা বাড়িয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য এমপি প্রার্থীরা। সম্প্রতি দলটির কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ ও দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাদের নিয়ে সভায় দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছেন, জরিপের ভিত্তিতেই এবার দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হবে। কারও চেহারা দেখে বা কারও সুপারিশে এবার কোনো মনোনয়ন হবে না। এরপর থেকেই দলের সম্ভাব্য এমপি প্রার্থীরা জরিপের ফল পক্ষে আনতে তৎপরতা বাড়িয়েছে কয়েকগুণ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য এমপি প্রার্থীরা নিজেদের অবস্থান তুলে ধরতে তৃণমূল পর্যায়ে সরকারের গত সাড়ে ১৪ বছরের উন্নয়নকাজ নিয়ে আয়োজন করছেন উঠান বৈঠক, সভা ও সেমিনারের। এ ছাড়া স্থানীয় পর্যায়ের সরকারি গোয়েন্দা সংস্থা ও সাংবাদিকদের কাছেও তারা নিয়মিত ঢুঁ মারছেন। তাদের একটাই চাওয়া যেন জরিপের তথ্য নিজেদের পক্ষে থাকে। একই সঙ্গে তৃণমূল পর্যায়ের বিভাগীয়, জেলা-উপজেলা পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গেও তারা নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। যাতে করে দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার হয় যে, এলাকার জনগণের সঙ্গে তাদের স¤পৃক্ততা রয়েছে। এলাকায় ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে।
এদিকে, আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা মনে করেন, হঠাৎ এসে জুড়ে বসলেই দলীয় মনোনয়ন কপালে জুটবে-এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। শুধু নির্বাচনকেন্দ্রিক নয়, যারা বিগত দিনে জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক রেখেছেন, তারাই দলীয় মনোনয়ন পাবেন। বসন্তের কোকিলদের মনোনয়ন দেওয়া হবে না। যারা আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে ছিলেন, ত্যাগী, সৎ, শিক্ষিত এবং কোনো অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত নন, তাদেরই মূল্যায়ন করা হবে। শেখ হাসিনা বলেছেন, জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য ও জনস¤পৃক্ততা রয়েছে এমন ব্যক্তির হাতেই নৌকা তুলে দেওয়া হবে।
আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা বলছেন, শোকাবহ আগস্ট মাস শেষ হলেই নির্বাচনি তোড়জোড় আরও বাড়বে। কারণ হাতে সময় খুব কম। সেপ্টেম্বরে সংসদের শেষ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে। এরপর থেকেই চূড়ান্ত প্রার্থীদের এলাকায় কাজ করার নির্দেশনা দেওয়া হবে। এরই মধ্যে বেশ কয়েক ধাপে প্রার্থী বাছাইয়ের কাজ এগিয়ে নেওয়া হয়েছে। প্রতিটি আসনে অন্তত দুই থেকে তিনজনের নাম বাছাই করা হয়েছে। যৌক্তিক কারণে শেষ মুহূর্তে কাউকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া সম্ভব না হলে সেখানে বিকল্প প্রার্থীকে নৌকা প্রতীক তুলে দেওয়া হবে।
গত ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পাননি এমন একাধিক এমপি প্রার্থী গণমাধ্যমকে বলেন, গত একাদশ জাতীয় নির্বাচনে নৌকা প্রতীক চেয়েও পাইনি। তখন দলের সভাপতিসহ কেন্দ্রীয় নেতারা বলেছিলেন, এলাকায় গিয়ে কাজ করতে। ঐক্যবদ্ধ থাকতে। তাদের সেই আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি। এলাকায় যাচ্ছি। সরকারের উন্নয়ন চিত্র তুলে ধরছি। জনগণের সঙ্গে উঠান বৈঠক করছি। তাই আমরা মনে করি আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যোগ্য বিবেচনা করে আমাদের মনোনয়ন দেবেন দলীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সূত্র জানায়, আগামী ডিসেম্বর বা জানুয়ারিতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। সেপ্টেম্বরে তফসিল ঘোষণা করবে বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন। সঙ্গত কারণে আওয়ামী লীগ নির্বাচনের জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। দলীয় প্রার্থী স¤পর্কে খোঁজখবরও নিচ্ছে দলটির হাইকমান্ড। তাদের নজর কাড়তে এখন থেকেই মাঠে চষে বেড়াচ্ছেন সম্ভাব্য এমপি প্রার্থীরা। কারণ আগামী জাতীয় নির্বাচন হবে চ্যালেঞ্জের। নানামুখী প্রতিবন্ধকতা থাকবে। তাই মাঠ পর্যায়ে ব্যাপক কাজ করছে। পাশাপাশি কীভাবে আওয়ামী লীগ আগামীতে দলীয় মনোনয়ন দেবেন তারও নির্দেশনা দিচ্ছেন দলটির প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ও মনোনয়ন বোর্ডের এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দলীয় মনোনয়নের ক্ষেত্রে এবার নেত্রী শেখ হাসিনা কারও চেহারা দেখে দেবেন না। যারা দলের দুঃসময়ে পাশে ছিলেন। ত্যাগী, সৎ, শিক্ষিত, কোনো অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত নন, দলের কাছে যাদের কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই, যারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করে শুধু আওয়ামী লীগের রাজনীতিই করেছেন, তাদেরকে মূল্যায়ন করা হবে। এবার কোনো হাইব্রিড নেতা মনোনয়ন পাবেন না। সেটি যদি আমিও হই। আমরা যারা মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য তারাও দলীয় মনোনয়ন পাব, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে সবার আমলনামা রয়েছে। তিনি আমলনামা দেখে এবার সিদ্ধান্ত নেবেন। ইতিমধ্যে শেখ হাসিনা বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা দিয়ে জরিপ করিয়েছেন। নেত্রীর টেবিলে অনেকের জরিপের ফল রয়েছে। এ ছাড়াও তৃণমূল পর্যায়ের বিভাগীয়, জেলা-উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতাদের মতামত নেবেন। সেখানে যার ফল পক্ষে আসবে তাকেই দলীয় মনোনয়ন দেবেন।
তিনি বলেন, সম্প্রতি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় নেত্রী স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, নিজ নিজ নির্বাচনি এলাকায় দলীয় এমপিদের জনপ্রিয়তা বা কার কত ভোট তা খতিয়ে দেখছে আওয়ামী লীগ। আগামী জাতীয় নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও কঠিন হবে। এই লড়াইয়ে যেসব প্রার্থী ভোটারদের কাছে জনপ্রিয়, ভোটে বিজয়ী হয়ে আসতে পারবেন, এমন প্রার্থীকেই বেছে নেবে দল। তাদের কপালেই জুটবে নৌকার টিকেট। আর যেসব এমপি জনপ্রিয়তা হারিয়েছেন, কর্মীদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করেছেন, রাজনীতির মাঠ থেকে শুরু করে পারিবারিক বলয় তৈরি করেছেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থীদের মদদ দিয়েছেন, এমন এমপিদের বাদ দেবে দলটি। এ বিষয়ে খুবই কঠোর অবস্থান নিয়েছেন দলীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ছাড়া মনোনয়নপ্রত্যাশীরা যদি একে অন্যের বিরুদ্ধে ব্যক্তি আক্রমণ করেন অথবা প্রার্থীরা একে অন্যের বিরুদ্ধে কুৎসা রটায়, তাদেরকেও মনোনয়ন দেওয়া হবে না। যেসব এমপি জনপ্রিয়, ভোটারদের আস্থা অর্জন করতে পেরেছেন, দলীয় কর্মীদের সঙ্গে দূরত্ব নেই, তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে সুষ্ঠু নির্বাচনে যারা বিজয়ী হয়ে আসতে পারবেন, তাদেরই নৌকার মনোনয়ন দেওয়া হবে।
আওয়ামী লীগের দুই সাংগঠনিক স¤পাদক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সম্প্রতি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় আমরা তৃণমূল পর্যায়ের সাংগঠনিক রিপোর্ট দলীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে তুলে ধরেছি। তৃণমূল পর্যায়ে দলের সাংগঠনিক অবস্থা সেখানে তুলে ধরা হয়েছে। শুধু তাই নয়, সংগঠন নিয়ে তৃণমূল পর্যায়ে কোন নেতার কী ভূমিকা সেখানে বলা আছে। এ ছাড়া আমরা যতটুকু জানি নেত্রী একাধিক জরিপ করেছেন, কোন নেতা এলাকায় কতটুকু জনপ্রিয়, তা দলীয় সভাপতির কাছে আছে। ফলে কে কী তৎপরতা চালাল তাতে কিছু আসে যায় না। যারা দলের দুঃসময়ে ছিলেন, এলাকায় সবসময়ই জনপ্রিয়-তাদেরকেই নেত্রী মনোনয়ন দেবেন। এখন শেষ বেলায় এসে টাকা ছড়িয়ে কোনো কাজ হবে না। দলীয় প্রধানমন্ত্রীর হাতে সবার আমলনামা রয়েছে। তাই জরিপের ফল নিজের পক্ষে আনার কোনো সুযোগ নেই। কারণ নেত্রী একাধিক মাধ্যমে জরিপ করেছেন।
আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেন, আওয়ামী লীগ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইতিমধ্যে দলীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেতাদের তৃণমূল পর্যায়ে কাজ করার জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন। কারণ নির্বাচন কাছাকাছি এসে গেছে। এখন আর বসে থাকার সুযোগ নেই। যারা দলের দুঃসময়ে ছিলেন, এখনও আছেন, এলাকায় জনপ্রিয়, সৎ, শিক্ষিত, ত্যাগী-তারাই দলীয় মনোনয়ন পাবেন। ইতিমধ্যে দলীয় সভাপতি কয়েক দফায় বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে জরিপ করেছেন। আরও জরিপ হচ্ছে। কেউ চাইলেই নিজের পক্ষে জরিপের ফল আনার সুযোগ নেই।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ স¤পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, আওয়ামী লীগ দেশের সবচেয়ে বড় ও সবচেয়ে জনপ্রিয় একটি দল। তাই দলীয় মনোনয়নের ক্ষেত্রে দলের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অনেক বিষয় বিবেচনা করতে হয়। একেকজনের একেক রকমের প্রত্যাশা থাকবে সেটাও স্বাভাবিক। তবে নির্বাচনকে সামনে রেখে কেউ যদি এলাকায় জনপ্রিয়তা বাড়ানোর জন্য কাজ করে সেটি ভালো। কিন্তু সিদ্ধান্ত নেবেন শেখ হাসিনা। কারণ তিনি নানাভাবে জরিপ করছেন। কেউ চাইলেই তার পক্ষে জরিপের ফল আনা সম্ভব নয়।