মধ্যনগর প্রতিনিধি ::
মধ্যনগর উপজেলার হাওরবেষ্টিত গ্রাম বাঙালভিটা ছিল প্রতিরোধযোদ্ধাদের শক্তিশালী ঘাঁটি। গ্রামের ৬২টি আদিবাসী পরিবার ছিল মুজিবভক্ত। ফলে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদকারী বীরযোদ্ধাদের অবাধ বিচরণ ও অবস্থান ছিল বাঙালভিটায়। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষ হতেই গ্রামটির ওপর নিদারুণ আক্রোশ নেমে আসে। অব্যাহত নিপীড়ন-নিযার্তন, জবরদখল, লুটপাটের মুখে বাঙালভিটার সব আদিবাসী পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়। তাদের দেশত্যাগেও বাধ্য করা হয়।
জানা যায়, বাঙালভিটা গ্রামের প্রাণেশ রেমা, হিতেন রেমাদের মতো মুষ্টিমেয় কিছু প্রতিরোধযোদ্ধা স্বদেশে ফিরতে পারলেও, কাইটাকোনা এলিন সাংমা, বাঙালভিটার সুদন হাজং, সুবোধ হাজংদের মতো বীরযোদ্ধারা গ্রামে ফিরে আসতে পারেনি। পরিবার-পরিজন নিয়ে সীমান্তের ওপারে দুর্গম পাহাড়-জঙ্গলেই তাদের ঠাঁই নিতে হয়েছে। বাংলাদেশে একেকটি পরিবারের বিঘার পর বিঘা জমি রয়েছে, তবুও ভিনদেশে তাদের বেঁচে থাকতে হচ্ছে অন্যের জমিতে বেগার খেটে।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানাযায়, বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের প্রতিবাদ করায় তাদের ওপর নেমে আসে সীমাহীন প্রশাসনিক অত্যাচার। খুনি মোশতাক চক্রের দোসররা মেতে ওঠে ঘৃণ্য জিঘাংসায়। তারা প্রতিরোধযোদ্ধাদের বাড়িঘরে হামলা চালায়, লুটে নেয় সর্বস্ব। তাদের নিরাপরাধ স্বজন-পরিজনরা পর্যন্ত নির্মম অত্যাচার থেকে রেহাই পাননি। যারা বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের ঘটনায় আনন্দ মিছিল করেছে – তারাই রাতারাতি প্রতিরোধযোদ্ধাদের পরিবার, এমনকি তাদের আত্মীয়-স্বজনদের দেশত্যাগে বাধ্য করে। তারা গারো পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে যান ভারতের আসাম কিংবা মেঘালয়ে। সেখানেও তাদের নিশ্চিত আশ্রয় জোটেনি, দুবেলা খাবার নিশ্চয়তা। আজো তারা যাযাবরের মতো ঘুরে বেড়ান এক স্থান থেকে অন্য স্থানে, জীবিকার সন্ধানে, বেঁচে থাকার আশায়। কারো ভাগ্যে স্থায়ী ঠিকানা পর্যন্ত জোটেনি।
বাঙালভিটা গ্রামের বাসিন্দা ’৭৫- এর প্রতিরোধযোদ্ধা প্রাণেশ রেমা জানান, এক পর্যায়ে তারা কয়েকজন দেশে ফিরে এলেও এখনো ওই গ্রামের ৪০-৪৫টি পরিবার আজও মাতৃভূমিতে ফিরতে পারেনি। এরই মধ্যে অনেকে মেঘালয়ে গহীন জঙ্গলে খাদ্য ও চিকিৎসার অভাবে ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুবরণ করেছেন। আক্ষেপের সুরে তিনি বলেন, এদের খবর কেউ নেয় না। সময়ের ব্যবধানে এরা হারিয়ে গেছে আমাদের মাঝ থেকে।
”৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে ভারতের সীমান্তবর্তী মেঘালয় রাজ্যে প্রতিরোধযোদ্ধাদের ‘বেতগড়া’ কো¤পানির কমান্ডার নেত্রকোনা শহরের বাসিন্দা সুকুমার রায় বলেন, মেঘালয়ে আশ্রয় নেওয়া বাঙালভিটার অনেক প্রতিরোধযোদ্ধা ও তাদের পরিবার মানবেতর জীবনযাপন করছে। তাদের অল্প কিছু সংখ্যক দেশে ফিরে এলেও অধিকাংশই আজও ফিরতে পারেনি। তাদের ফিরিয়ে আনতে আমরা জোর দাবি জানিয়েছি।
উল্লেখ্য, গত বছরের ১৪ আগস্ট জাতীয় প্রেসক্লাবে ৭৫-এর প্রতিরোধযোদ্ধা বীর কমান্ডো নামে সংগঠনের ব্যানারে আয়োজিত মানববন্ধন কর্মসূচিতে সংগঠনের নেতারা দাবি করেন ‘আসাম ও মেঘালয়ের বিভিন্ন দুর্গম জনপদে সীমান্তবর্তী বিভিন্ন এলাকায় ৮ শতাধিক প্রতিরোধযোদ্ধা ও তাদের পরিবার সদস্যরা স্বেচ্ছানির্বাসনের জীবন-যাপনে বাধ্য হচ্ছেন। শুধু বঙ্গবন্ধু হত্যার সশস্ত্র প্রতিবাদ করার কারণেই তাদের দেশছাড়া হতে হয়েছে। গত চার দশকেও তাদের কেউ খোঁজ নেয়নি। প্রতিরোধযোদ্ধারা তাদের সেই সহযোদ্ধাদের সসম্মানে দেশে ফিরিয়ে আনতে সরকারি উদ্যোগ জোর দাবি জানিয়েছেন। একই সঙ্গে জবরদখলদারীদের কবল থেকে প্রতিরোধযোদ্ধাদের বাড়িঘর, ফসলি জমিসহ লুটে নেওয়া স¤পদ উদ্ধারে তারা কঠোর প্রশাসনিক পদক্ষেপ নিতেও আকুতি জানিয়েছেন।