1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
মঙ্গলবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৩, ০৫:৩৭ পূর্বাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

বিষণ্ন প্রহর বিপন্ন মানবতা : আমরা কি ভুল পথে হাঁটছি?

  • আপডেট সময় বুধবার, ২৩ আগস্ট, ২০২৩

ড. মো. আব্দুল হামিদ
পরিচিত কারো সঙ্গে একান্ত আলাপে খেয়াল করবেন, তিনি কীভাবে আশপাশের মানুষের (এমনকি নিকটজনের) দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত বা প্রতারিত হচ্ছেন তার দীর্ঘ বয়ান হাজির করছেন। সেটা না করলেও অন্তত পক্ষে তার পেশাগত, পারিবারিক, শারীরিক ও মানসিক নানা সংকটের দিকগুলো আপনার সামনে বিশদভাবে তুলে ধরছেন। অর্থাৎ সবকিছু মিলিয়ে তিনি যে ভালো নেই তা বুঝতে আপনার মোটেই বিলম্ব হবে না। অথচ বাহ্যিক চাকচিক্য দেখে আশপাশের মানুষ হয়তো তার সম্পর্কে উল্টোটাই ধারণা করে!
কেন এমনটা হচ্ছে? নিঃসন্দেহে অনেক কারণ রয়েছে। তবে অন্যতম কারণ হলো- পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র এমনকি আন্তর্জাতিক পরিসরে যারা যতটুকু ক্ষমতা ধারণ করছে তার পুরোটাই নিজ স্বার্থ হাসিলে সর্বাত্মকভাবে কাজে লাগাতে সচেষ্ট রয়েছে। ছলে, বলে, কৌশলে যেভাবেই হোক নিজের লক্ষ্য অর্জনই মূল কথা। এতে অন্যদের ক্ষতি, মন খারাপ বা কষ্ট হলেও সেটা ‘কেয়ার’ (পাত্তা দেয়া) বা ‘কাউন্ট’ (গোনার টাইম) করার সময় তাদের নেই। খুব ব্যতিক্রম ছাড়া এমনটা করাই যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে ক্ষুব্ধ মানুষের সংখ্যা বাড়ছে তা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু প্রকৃতি কেন ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে তা স্পষ্ট নয়। বিশ্বের নানা প্রান্তে প্রকৃতির একের পর এক আক্রমণে এটা স্পষ্ট যে আমাদের সামগ্রিক কর্মকা- প্রকৃতির মোটেই পছন্দ হচ্ছে না। হয়তো সে কারণেই তীব্র তাপদাহ, খরা, বন্যা, দাবানল, ঘূর্ণিঝড়, ভূমিক¤প ইত্যাদি দিয়ে আমাদের বারবার সতর্ক করছে। শতবছরের মধ্যে সবচেয়ে প্রাণঘাতী দাবানল, হাজার বছরের মধ্যে উষ্ণতম জুলাই মাস, তাজমহলকে হুমকির মুখে ফেলা বন্যা ইত্যাদি কি বিশেষ কিছু ইঙ্গিত করছে? আমরা কি সেগুলো মোটেও আমলে নিচ্ছি?
না, বরং করোনা আক্রমণের পর যখন সবাই মিলে মহামারীর ক্ষত সারানো জরুরি ছিল, তখন থেকে উল্টো পথে হাঁটছি। সবাই মিলে ক্রমেই পৃথিবীটাকে বসবাসের অনুপযোগী করে তুলতে আগ্রাসী হচ্ছি। এটা শুধু পুতিন নয়, বরং আপনার চারপাশে দেখুন যার যতটুকু ক্ষমতা আছে তার চূড়ান্ত সদ্ব্যবহারে কোনো কার্পণ্য করছে না। ফলে মানুষের বাহ্যিক আয়-স¤পদ বাড়লেও ঘরে-বাইরে অশান্তির মাত্রা প্রবল হচ্ছে। কেউই তৃপ্তিসহকারে বলতে পারছে না- আমি ভালো আছি!
কভিড পুরো বিশ্বকে স্তব্ধ করে দেয়ার পর ধারণা করা হয়েছিল যে এরপর মানুষ অনেক বেশি পর¯পরের প্রতি আন্তরিক ও সমব্যথী হবে। বিপদে-আপদে পর¯পরের পাশে দাঁড়াবে। সবাই মিলেমিশে বিশ্বকে এগিয়ে নেবে। কিন্তু রাশিয়ার অপ্রয়োজনীয় ইউক্রেন আক্রমণ অতি অল্প সময়ে সেই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে। সেই ধারাবাহিকতায় চীন-তাইওয়ান, ইরান-যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান, উত্তর কোরিয়া, মিয়ানমার এবং আফ্রিকার বেশকিছু দেশে অস্থিরতা ক্রমেই বাড়ছে। অঘোষিত তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি আমরা। বিশ্ব মোড়লদের ইচ্ছার বলি হয়ে বিপুলসংখ্যক মানুষ এখন উদ্বাস্তু জীবনযাপন করছে। ভূমধ্যসাগরে নিত্যদিন শত শত অভিবাসনপ্রত্যাশীর ডুবে মরার খবর তারই সাক্ষ্য দেয়। শুধু জীবন রক্ষার তাগিদে বিপুলসংখ্যক মানুষ ছুটে বেড়াচ্ছে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে।
রাজনৈতিক এ ডামাডোলে সামগ্রিক অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কথা মোটেই ভাবা হচ্ছে না। তাছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ এভাবে বাড়তে থাকলে বিশ্ববাসীর খাদ্যনিরাপত্তা অচিরেই বড় হুমকির মুখে পড়বে। আগে একক কোনো রাষ্ট্র সংকটে পড়লে অন্যরা এগিয়ে আসত। সামগ্রিক সহায়তায় তারা দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে পারত। কিন্তু এখন বিশ্ব পরিস্থিতি এমনই যে কেউ কারো দিকে খেয়াল করার সুযোগ নেই। কারো সংকটে ঋণভারে আরো জর্জরিত করার মতো রাষ্ট্র বা সংস্থা পাওয়া যাবে বটে, কিন্তু সত্যিকারের শুভাকাক্সক্ষী নয়। ফলে যাদের সংকট তাদেরকেই কাটিয়ে উঠতে হবে। এমন পরিস্থিতিতে নিজেদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি হ্রাস করে সহযোগিতা ও সহমর্মিতার মনোভাব বৃদ্ধি করা দরকার। কিন্তু সবাই যেন উল্টো পথে হাঁটছে।
তাছাড়া নানা সংকট, ঘাত-প্রতিঘাতে মানুষের অনুভূতিও বুঝি ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে। কারণ আগে আমাদের দেশে বড় কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থা নানাভাবে তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসত। এমনকি মাত্র এক বছর আগে সিলেটের বন্যায় এর চরম দৃষ্টান্ত দেখা গিয়েছিল। অথচ এ বছর চট্টগ্রাম, বরিশাল ও দেশের উত্তরাঞ্চলের কয়েক জেলায় (দীর্ঘসময় ধরে) জলাবদ্ধতা ও বন্যায় লাখ লাখ মানুষ ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। কিন্তু তাদের সাহায্যার্থে সেই উদ্যোগ বা চেষ্টা লক্ষ করা যাচ্ছে না। পার¯পরিক সহযোগিতার হাতগুলো ক্রমেই যেন গুটিয়ে যাচ্ছে।
দ্রব্যমূল্য নিয়ে দেশে যে তুঘলকি কা- চলছে তা আলাদাভাবে বলা নি®প্রয়োজন। কারণ প্রতিদিন বাজারে গেলেই কোনো না কোনো পণ্যের আঁচ আমাদের দগ্ধ করে। নিত্যপ্রয়োজনীয় কয়েকটি পণ্যের মূল্য নিয়ে গণমাধ্যমে হইচই হলেও আড়ালে-আবডালে সব পণ্যের দামই অনেক বেড়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট সিন্ডিকেটগুলো এতটাই শক্তিশালী যে, কেউ তাদের লাগাম টানতে সাহস করছে না। ফলে সীমিত আয়ের মানুষের নাভিশ্বাস অবস্থা থেকে উত্তরণে কার্যকর কোনো উদ্যোগ দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। কিংবা একটার মূল্য নিয়ন্ত্রণে আনতে না আনতেই আরো কয়েকটা বেড়ে যাচ্ছে!
শুরুর দিকে রসিকতা করে বলা হতো, ডেঙ্গু বড়লোকদের অসুখ। কারণ শহরের অভিজাত পরিবারগুলোয় এ মশার বিস্তার এবং আক্রান্ত রোগী পাওয়া যেত। তখন আরো বলা হতো- গরিব ও বস্তিবাসীদের এ রোগ হলে তা মহামারীর আকার ধারণ করবে। এবার ডেঙ্গু সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এমনকি গ্রামের মানুষও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের দেশের মানুষ জ্বর, সর্দি-কাশিকে খুব একটা গুরুত্ব দেয় না বলেই হয়তো পুরো চিত্র সামনে আসছে না। কিন্তু পরিস্থিতি মোটেই ভালো নয়। আমি গত সপ্তাহে উত্তরাঞ্চলে ছিলাম। সেখানে প্রায় প্রত্যেক পরিবারে এক বা একাধিক ব্যক্তির জ্বর হচ্ছে। এতে মানুষের কর্মস্পৃহা ও মানসিক শান্তি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
পাশাপাশি সুস্থ মানুষের হুটহাট করে মারা যাওয়া বা অচল হয়ে যাওয়ার ঘটনা বেড়েছে। আপাতদৃষ্টে সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ হঠাৎ করে ‘নাই’ হয়ে যাচ্ছে। সেগুলোর চিকিৎসা নিয়ে উদগ্রীব হলেও তার উৎস ‘খাদ্যে ভেজাল’ বিষয়ে থাকছি চরম উদাসীন। পৃথিবীর নানা দেশ খাদ্যে ভেজাল দেয়ার ব্যাপারে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অবলম্বন করলেও আমরা কেন যেন কঠোর হতে পারছি না। আর এত উন্নয়নের ভিড়ে ‘সড়ক দুর্ঘটনা’ নিয়ে ভাবার সময় কোথায়? অথচ পরিসংখ্যাগত দিক থেকে ডেঙ্গু বা করোনার চেয়েও আমাদের প্রেক্ষাপটে বড় মহামারী হলো এ সড়ক দুর্ঘটনা। কারণ শুধু জুলাইয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে ৫৭৬ জন! অথচ এ বিষয়ে উদ্বেগের পরিবর্তে আমরা বেশ অভ্যস্ত হয়ে উঠছি।
চারপাশের বিদ্যমান অস্থিরতায় আমাদের অধিকাংশের দু’দ- স্থির হয়ে ভাবার সময় মিলছে না। অথচ সত্যিই সেটা গভীরভাবে অনুভব করলে মনটা বড় বিষণœ হয়ে ওঠে। কারণ আজ সামগ্রিক অবস্থা ও বিশ্ব মানবতা বড় বিপন্ন!
[ড. মো. আব্দুল হামিদ: শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের শিক্ষক ও ‘সুখের অসুখ’ বইয়ের লেখক]

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com