সুনামকণ্ঠ ডেস্ক ::
ডিমের বাজারে প্রায় দুই সপ্তাহের অস্থিরতা শেষে কমতে শুরু করেছে দাম। কিন্তু এই সময়ে ডিম সিন্ডিকেট হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় ১৫০ কোটি টাকা। ডিমের দাম বাড়ার যৌক্তিক কোনো উত্তর ব্যবসায়ীরা দিতে না পারলেও তাদের টার্গেট অনুযায়ী তা বেড়েছে। পরে সরকারের আমদানির হুমকি ও বিভিন্ন সংস্থার বাজার তদারকিতে বড় অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়ে ডিমের দাম কিছুটা কমাতে বাধ্য হয়েছে ডিম সিন্ডিকেট।
তবে এখনো মূল পাইকারি বাজারে (মিলগেটে) প্রতিটি ডিমের দাম বিক্রি হচ্ছে ১১ টাকা ৫০ পয়সা। ফলে পরিবহন খরচ, ড্যামেজ, আড়তদার, পাইকারি ও খুচরা লাভ শেষে সরকার নির্ধারিত দামে বাজারে ডিম বিক্রি সম্ভব হচ্ছে না, অর্থাৎ এখনো বাজারে সরকার নির্ধারিত ১২ টাকা রেটে প্রতিটি ডিম বিক্রি হচ্ছে না। এতে নি¤œমধ্যবিত্ত ও নি¤œবিত্তদের প্রোটিনের মূল উৎস ডিম অধরাই থেকে যাচ্ছে। প্রতিটি পরিবারই আগের চেয়ে ডিম কেনা অর্ধেক বা এক-তৃতীয়াংশ কমিয়ে দিয়েছে।
বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য মতে, দেশে প্রতিদিন সব ধরনের ডিমের মোট চাহিদা ৪ দশমিক ৭০ কোটি থেকে ৪ দশমিক ৮০ কোটি। আগে উৎপাদন ছিল ৪ দশমিক ৪০ থেকে ৪ দশমিক ৪৫ কোটি। তবে কিছুদিন আগে এই উৎপাদন কমে গিয়ে দাঁড়ায় ৩ দশমিক ৯০ থেকে ৪ দশমিক ১০ কোটির মধ্যে।
মৎস্য ও প্রাণিস¤পদ মন্ত্রণালয় বলছে, প্রতিটি ডিমের উৎপাদন খরচ ১০ টাকা ৫০ পয়সা। ফলে সব ধরনের হাত ঘুরলেও কোনোভাবেই খুচরা পর্যায়ে একটি ডিমের দাম ১২ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। অথচ প্রায় ১৪ দিন খুচরা পর্যায়ে প্রতিটি ডিম বিক্রি হয়েছে ১৫ টাকা। আর পাইকারিতে সে দাম ছিল ১২ দশমিক ৪০ থেকে ১২ দশমিক ৫০ টাকা; অর্থাৎ প্রতিটি ডিম থেকে সিন্ডিকেট অতিরিক্ত বাণিজ্য করেছে ২ টাকা। সেই হিসাবে প্রতিদিন গড়ে বাণিজ্য হয়েছে ৮ কোটি টাকা। আর ১৪ দিনে সিন্ডিকেটের বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১১২ কোটি টাকা।
আর ডিমের বড় ধরনের দাম বাড়ানোর আগে আস্তে আস্তে দাম বাড়ানো হয়েছে। আবার ১৪ দিন শেষে আস্তে আস্তে কমানো হচ্ছে। ফলে সেখানেও আরও ৩০ থেকে ৪০ কোটি টাকার বাণিজ্য হয়েছে। ফলে এই আগস্ট মাসে ডিম সিন্ডিকেট অতিরিক্ত বাণিজ্য করেছে প্রায় ১৫০ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ স¤পাদক খন্দকার মুহাম্মদ মহসিন গণমাধ্যমকে বলেন, ডিমের দাম বাড়ার মূল সমস্যা ঘাটতি। আমাদের ৩৯ ভাগ খামার বন্ধ। নানা কারণে চালু থাকা খামারেও উৎপাদন কমে গেছে। অথচ কথায় কথায় ভারতের সঙ্গে তুলনা করা হয়। তারা আমাদের চেয়ে ৫০ বছর এগিয়ে। তাদের সরকার পোলট্রি খাতে বড় ধরনের সাবসিডি দেয়। এ ছাড়া তাদের ডিমের সাইজ আমাদের চেয়ে ছোট। ফলে তারা কিছুটা কম দামে ডিম বিক্রি করতে পারে।
খন্দকার মুহাম্মদ মহসিন আরও বলেন, আমাদের বেশির ভাগ পোলট্রি পণ্য আমদানি করতে হয়। প্রথমে করোনায় সব থমকে যায়। এরপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ডলারের দাম ৩০ টাকা বেড়ে যায়। এতে স্বাভাবিকভাবেই আমাদের বড় ধরনের খরচ বেড়েছে। এ ছাড়া স¤প্রতি বৈরী আবহাওয়া, বিশেষ করে প্রচ- গরম, এরপর আবার বৃষ্টি এতে অনেক মুরগি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আবার আড়তদাররাও কিছুটা অতিরিক্ত মুনাফা করে। সব মিলিয়ে ডিমের দাম বেড়ে যায়। তবে এখন আবার উৎপাদন বাড়ায় ডিমের দাম কিছুটা কমেছে। তবে এর চেয়ে দাম কমাতে হলে সরকারকে সাবসিডি দিতে হবে; বিশেষ করে আমদানি করা পোলট্রির সব পণ্য কম দামে খামারিদের দিতে হবে।
সূত্র জানায়, গত বছরের আগস্টেও একইভাবে ডিমের বাজারে কারসাজি করে দাম বাড়ানো হয়। তখন ভোক্তা অধিদপ্তর অভিযান চালিয়ে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সিন্ডিকেট করে দাম বাড়ানোর প্রমাণ পায়। কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলাও হয়। কিন্তু সেই মামলার আর অগ্রগতি হয়নি। ফলে এ বছর আগস্টেও আগের চেয়ে দ্বিগুণ উৎসাহে ডিমের দাম বাড়াল সিন্ডিকেট। ভোক্তা অধিদপ্তর ছাড়াও গত বছর আগস্টে কাজী ফার্মস, প্যারাগন, সিপি, ডায়মন্ড এগ, পিপলস ফিডসহ বেশ কয়েকটি কো¤পানির বিরুদ্ধে মামলা করে প্রতিযোগিতা কমিশন।
জানা যায়, বাংলাদেশে এখন পোলট্রি খামারি আছেন ৬০ হাজার। তাদের মধ্যে ২০ হাজার খামারি ডিম উৎপাদন করেন। আর ৪০ হাজার খামারি মুরগি উৎপাদন করেন। ডিম উৎপাদনকারী বেশিরভাগ খামারিকে কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের আওতায় নিয়ে গেছে কয়েকটি করপোরেট প্রতিষ্ঠান। তাদের আগাম টাকা দিয়ে ডিম ও মুরগির দাম বেঁধে দেওয়া হয়। সারা বছর সেই একই দামে ডিম ও মুরগি কেনে কয়েকটি করপোরেট প্রতিষ্ঠান। তাই করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো সহজেই বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। তাদের আবার নিজস্ব ফার্মও আছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রতিদিন সকালে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর লোকজন নির্দিষ্ট এজেন্টদের মাধ্যমে সকাল ১০টার মধ্যে মোবাইল ফোনে এসএমসএস, ফেসবুক পেজের মাধ্যমে সারা দেশে ডিমের দাম জানিয়ে দেয়। আর সেই দামেই ডিম বিক্রি হয়। এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। এর সঙ্গে উৎপাদন বা চাহিদার তেমন স¤পর্ক থাকে না। অথচ ডিমের দাম বৃদ্ধি নিয়ে স¤প্রতি সরকারের ডাকা একাধিক বৈঠকে বড় বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি, পাইকারি বাজারের বড় ব্যবসায়ী বা ক্ষুদ্র খামারির কেউই দায় নিতে চাননি। দাম বৃদ্ধির জন্য একে অপরের ওপর দায় চাপিয়েছেন। কেউ কেউ উচ্চহারে খাবারের দাম বৃদ্ধির কথা বলেছেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, মুরগির খাবারের দাম আগের চেয়ে বেড়েছে। সেটা হিসাব করেই এখন ডিম উৎপাদন খরচ সাড়ে ১০ টাকা নির্ধারণ করেছে মন্ত্রণালয়। ফলে খাবারের দাম বৃদ্ধির দোহাই দিয়ে ডিমের দাম বাড়ানোর সুযোগ নেই। যদি খাবারের দাম না বাড়ত তাহলে ডিম উৎপাদন খরচ সাত থেকে আট টাকার মধ্যেই থাকত। দেশে একটা ডিমের খুচরা দাম ১৪ থেকে ১৫ টাকা হলেও পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের বিভিন্ন শহরে একটি ডিমের খুচরা দাম বাংলাদেশি টাকায় আট টাকার মধ্যেই বিক্রি হচ্ছে।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, এখনো মিলগেটে ১১ দশমিক ৩০ টাকা করে প্রতিটি ডিম বিক্রি হচ্ছে। এতে নির্ধারিত ১২ টাকা দামে ভোক্তার হাতে ডিম পৌঁছাচ্ছে না। ডিমের দাম কমাতে হলে মিলগেটে দাম কমাতে হবে। আমরা এ ব্যাপারে মৎস্য ও প্রাণিস¤পদ মন্ত্রণালয়ে রিপোর্ট জমা দিয়েছি। মুরগির খাবারের দাম কেমন হওয়া উচিত, সেটাও নির্ধারণের জন্য আমরা বলেছি। এ ছাড়া রসিদ ছাড়া যেন ডিম ক্রয়-বিক্রয় না হয়, সেটা আমরা মনিটরিং করছি। যা সামনে আরও জোরদার হবে।