1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
  3. [email protected] : wp-needuser : wp-needuser
শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ০৯:১৬ পূর্বাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

স্বপ্নের বাংলাদেশ অসুখী কেন? : রমেন্দ্র কুমার দে মিন্টু

  • আপডেট সময় শনিবার, ১২ আগস্ট, ২০২৩

পৃথিবীর উন্নয়নশীল দেশগুলির জীবনযাত্রার আকর্ষণে আমাদের যুবকরা দেশ ছাড়তে মৃত্যুকেও ভয় পায়না। যুবকদের স্বপ্ন তো থাকবেই। কিন্তু যাদের দেশ আকর্ষণীয় লাভের অর্থ-সামর্থ্য কোন সময়ই হবেনা। যারা বৃদ্ধ, শিশু, কিশোর তাদের এই আর্থিক নিষ্পেষণ, প্রতারণা, এই অনিয়মের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে থাকতে হবে। একটা মানুষের শিশু থেকে শেষ জীবন পর্যন্ত বাঁচার অধিকার, মুক্ত জীবন, তার গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা ও সুখী জীবন নিয়েই স্বপ্ন দেখে। আর যারা দেশ চালায় তারা চটকদার কথা বলে, মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় যায় অথবা জোর করে ক্ষমতা দখল করে তাদের এবং সমাজে শ্রেণী বৈষম্যের কারণে স্বার্থান্বেষী বুদ্ধিমানদের দাপটে আমরা সাধারণ মানুষেরা হেরে যাই।
রাজতন্ত্র থেকে উপনিবেশবাদ, স্বৈরাচার পর্যন্ত শাসন-শোষণ, অত্যাচার নিষ্পেষণে আমাদের পূর্ব-পুরুষেরা এ সমাজের পরিবর্তনের লক্ষ্যে আন্দোলন সংগ্রাম করে এই উপমহাদেশে জীবন উৎসর্গ করে গেছেন। তারই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতিকে অর্থনৈতিক শোষণ ও গণতান্ত্রিক অধিকার অর্জন, সুখী সমাজ ব্যবস্থা গড়ার জন্য রাজনীতিবিদ, শ্রমিক-কৃষক, ছাত্র, সৈনিক-বুদ্ধিজীবী সবাই জীবন উৎসর্গ করেছিল মহান মুক্তিযুদ্ধে। ত্রিশ লক্ষ মানুষের প্রাণ গেল, মা-বোনদের ইজ্জত গেল, প্রাণ বাঁচাতে ভারতে শরণার্থী হল। কিন্তু আজ আমাদের এ সমাজে মুষ্টিমেয় সুখ ছাড়া সাধারণ মানুষের লড়তে হচ্ছে জীবন রক্ষার মধ্য দিয়ে কোন প্রকার টিকে থাকার সংগ্রামে।
একদা তরুণ যুবকেরা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। আজ তরুণ যুবকেরা হতাশাগ্রস্ত। সমাজে অপরাধী কিশোর গ্যাং গড়ে উঠেছে। শাসকশ্রেণী তরুণদের বিপথগামী ও রাজনীতি বিরোধী করে তোলাই স্বাভাবিক, তারা চায়না তরুণেরা বিদ্রোহ করুক।
স্বাধীনতা সংগ্রামের উদ্দেশ্যে ও লক্ষ্য বড় রাষ্ট্র ভেঙে ছোট রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছিল না। ছিল এমন একটি রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ে তোলার যেটি হবে সমাজতান্ত্রিক। উন্নয়ন যা ঘটছে, তা পুঁজিবাদী ধরণের। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেনÑ কেউ খুব বেশি ধনী হবে, সে আমি চাইনা। আমি কমিউনিস্ট নই। সমাজতন্ত্রী তিনি দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটানোর কথা বলেছিলেন। তার একটা বড় দার্শনিক ভিত্তি আছে, সেটি হচ্ছে সুষম সমাজ। এই মুক্তি অর্জনের জন্য প্রয়োজন সাম্য, সম্পদের সুষমবণ্টন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অন্ন, বাসস্থানসহ সব অধিকারের সকল বাস্তবায়ন, সামাজিক ন্যায় বিচার এবং ব্যক্তির মর্য্যাদা প্রতিষ্ঠা ও বৈষম্য, জাতপাতের বিভাজন দূর করা।
এখন একজন রাজনীতিক গণবিচ্ছিন্ন দূরের মানুষ। রাজনীতির মঞ্চ বা ময়দানে সাধারণের স্থান সংকুচিত এবং তাদের জন্য জানার তেমন কিছু থাকেনা। রাজনীতি এখন সম্পন্ন মানুষের ক্ষমতা চর্চার এবং উচ্চাভিলাষীর সম্পদ ও ক্ষমতা অর্জনের অবলম্বন মাত্র। তাদের প্রয়োজন টাকা। সাদা কালো যাই হোক! প্রয়োজন বিত্ত, বৈধ বা অবৈধ যাই হোক তার চাই। ক্ষমতা আদর্শ আত্মমর্যাদা বিসর্জন দিয়ে হলেও তা চাই।
বর্তমানে রাজনীতিকের লক্ষণ হলো তাকে ঘিরে থাকবে অসংখ্য উমেদার, চাটুকার ও কৃপাপ্রার্থী। তিনি মৌচাক, ক্ষমতা ও বিত্তের ভা-ার। জনসেবায় শুনা যায় নেতার প্রশংসা, গুণগান এবং ভিন্ন দল ও নেতার প্রতি বিষোদগার। বর্তমান রাজনীতিবিদরা অনর্থনীতি পছন্দ করেন। তার কারণ হল- তাদের অর্থনীতি বিষয়ে জ্ঞানের অভাব বা সবজান্তা ভাব। ফলে তারা আমলা কিংবা অন্য কারও ওপর নির্ভর হয়ে পড়েন বা পরামর্শের ধার ধারেন না।
এতদিন শুনে আসছি রাজনীতি, গণতন্ত্র, নির্বাচন সবকিছু জনগণের কল্যাণের জন্য। জনগণের অভাব, অভিযোগ, অধিকার যদি রাজনীতিতে উপেক্ষিত থাকে, রাজনৈতিক নেতারা আমলে না নেন, তাহলে সেই রাজনীতির প্রয়োজন কি? আসলে জনগণের সমস্যা সংকট নিয়ে কোন দলই ভাবেনা। কীভাবে ক্ষমতায় যাওয়া ও থাকা যাবে, সেটাই তাদের একমাত্র ধ্যান জ্ঞান হয়ে পড়েছে। তাঁরা জনগণের নামে রাজনীতি করেন এটা উপহাস ছাড়া আর কিছু নয়।
জাতি যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল তা অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক চেতনা। ফলে এর মধ্যে সব ধরনের বৈষম্যমুক্ত সমতাভিত্তিক উদার মানবিক চেতনা ও অধারিত ছিল। ব্যক্তিগত সম্পদ আহরণের যে বেপরোয়া প্রতিযোগিতা চলছে তাতে ব্যাপক উন্নয়ন, প্রবৃদ্ধি উপহার বা মাথাপিছু গড় আয়ের বিপুল বৃদ্ধি স্বত্বেও ধনী দরিদ্রের বৈষম্য কেবল বাড়ছেই। সংসদে ৭০ শতাংশের কাছাকাছি ব্যবসায়ী। আইন প্রণয়নে তাদের ভূমিকাই প্রাধান্য হবে। এরপর বিভিন্ন খাতেও ব্যবসায়ী মন্ত্রী মহোদয়েরা সক্রিয়। ফলে ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর চাপ নীতি নির্ধারকদের ওপরই থাকবে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অব ইকোনমিক মডেলিং (সায়েক) গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে এবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত একটি জরিপ চালিয়ে ছিল। তাতে দেখা গেছে ধারদেনা করে জীবন চালানো এখন স্বাভাবিক বিষয় হয়ে পড়েছে। ১৮ শতাংশ নি¤œ আয়ের পরিবারের কখনো কখনো পুরো দিন না খেয়ে থেকেছে। তাদের এক বড় অংশকেই কোন কোন কারণে সরকারি সেবার জন্য যেতে হয় বা হবে। এখন ক্ষমতাসীনেরা কোন প্রকার জবাবদিহির মুখোমুখি হতে হয়না। কারণ এখনকার শাসন ব্যবস্থার ভিত্তিই হচ্ছে জবাবদিহি হীনতা। এই ব্যবস্থার নির্ভরতা প্রশাসনের ওপর। জাতীয় সংসদে বাজেট নিয়ে আলোচনা যতটা প্রশংসার ধ্বনি শোনা যায়। তার কিয়দাংশও প্রশ্ন শোনা যাবে না।
আমরা জানি শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষায় উপযুক্ত বরাদ্দের মাধ্যমে ধনী দারিদ্রের বৈষম্য হ্রাস করা যায়। কারণ এসব খাতে বরাদ্দ প্রত্যক্ষ ভাবে সীমিত ও নি¤œ আয়ের জনগোষ্ঠীর উপকারে আসে।
প্রতিবাদ মানুষের ধর্ম। ঘোর স্বৈরাচারী সমাজেও প্রতিবাদ নীরব হয়ে থাকেনা। রাজনীতিতে বহুবলই ক্ষমতার চরম নির্ণয়ক। তবে গণতন্ত্রে তার প্রয়োগ শাসিতের সম্পত্তি সাপেক্ষে। এখানেই স্বৈরতন্ত্রের সঙ্গে এর মূল পার্থক্য। ব্রিটেন ও ভারতের মতো পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রে তাই সংখ্যাগরিষ্ঠ শাসক দলকে সতর্ক থাকতে হয়। সংসদীয় আদর্শ শাসক ও বিরোধী উভয় দলই নাগরিকদের নির্বাচিত প্রতিনিধি। প্রতিবাদের অভাবে গণতন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়ে। মুক্ত গণমাধ্যম, মানবাধিকার ও সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য অত্যাবশ্যক। ১৯৭৫ইং সালের পর থেকে আজ পর্যন্ত সংবাদিকতা চর্চা, কথা বলা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা রাষ্ট্রের তরফ থেকে সংকোচিত করে দেওয়া হয়েছে। কেবল সাহাবুদ্দিন আহমদের অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে আইন রদ করা হয়। উপনিবেশ আমলে সিক্রেটস অ্যাক্ট, বিপজ্জনক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মত অনেকগুলো নিবর্তনমূলক আইন জাতির উপর চাপিয়ে দেয়া হয়। বাংলাদেশের মতো দেশে সাংবাদিকতা হচ্ছে পুকুরের মধ্যে অনেকগুলো কুমির ছেড়ে বলা হলো এপার থেকে ওপারে সাঁতার কেটে যাও।
দেশের ধনীদের জন্য বিচার আছে। যার নেই তার জন্য কিসের বিচার? যার আছে তাকে রক্ষা করার জন্যই তো বিচার! দেশে এখন রেশন কার্ডের মতো মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দেয়া হচ্ছে।
ঔপনিবেশিক লুণ্ঠন পার হয়ে ভারতবর্ষের একদা সবচেয়ে সমৃদ্ধ জনপদে “বাংলার কপালেও কেন এই অপমান তিলক জুটলো? সেটা বিশ্লেষণ করলেই বুঝা যাবে কেন পুঁজি পাচারকারীরা জাতির এক নম্বর দুশমন।” ব্রিটেনের যখন পুঁজি গড়ে উঠেছিলো, তারা দস্যুবৃত্তিই করেছিলো। কিন্তু তারা তো পৃথিবীর নানা জায়গায় উপনিবেশ আর দস্যুবৃত্তি করেই অর্থ, ধন, সম্পদ নিজেদের দেশে নিয়ে গিয়েছিল। আমাদের দেশের লুটেরা, ধনিকেরা, তস্কর দস্যুরা (ভূমিদস্যু, বনখেকো, পদ বিক্রেতা, শেয়ার মার্কেটের লুটেরা, টেন্ডার দস্যু, ব্যাংক লুটেরা, বালুখেকো, নিয়োগ বিক্রেতা, প্রশ্নপত্র বিক্রেতা, ক্যাসিনো স¤্রাট, মাদক স¤্রাট, চাঁদাবাজির গডফাদার, আদম বেপারী ইত্যাদি) তো দেশের টাকা বিদেশে পাচার করে দিচ্ছে।
আমরা দুটি চক্রে বাঁধা পড়েছি। একটা দুর্নীতি, অন্যটা বৈষম্য। দুর্নীতি এতোটাই বিস্তৃত যে এর বাইরে থেকে কিছুই করা সম্ভব হচ্ছেনা। এটা নিচ থেকে শুরু করে সর্বপর্যায়ে ছড়িয়ে পড়েছে। ১৩.৫ বিলিয়ন ডলার খরচ করে রাশিয়ার সহায়তায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করা হচ্ছে, কয়েক বছর আগে এমন একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরিতে ভারতের খরচ হয়েছিলো মাত্র ৩.০৫ বিলিয়ন ডলার। দুর্নীতি দমন কমিশন স্বাধীনভাবে কিছু করতে পারেনা, কারণ একজন সরকারি কর্মকর্তাকে ধরতে হলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হয়।
দুদকের প্রতিবেদনে কক্সবাজারের ১৫৫ জন স্থানীয় রাজনীতিকের সম্পৃক্ততার কথা উল্লেখ করে দুদক কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিন তিনটি প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণে বড় ধরনের দুর্নীতি সংঘটিত হয়েছে বলে জানান। এ ব্যাপারে তিনি তিনটি প্রকল্পে দুর্নীতির জন্য পৃথক তিনটি মামলা করায় উনি চাকরিচ্যুত হন।
যারা উচ্চ আয়ের মানুষ, যারা অতি ধনী তাদের মধ্যেই অনেক কর খেলাপী, ঋণ খেলাপী, টাকা পাচারকারী। তারা নানা ধরনের সরকারি সুবিধাপ্রাপ্ত। তাদের বিদেশ ভ্রমণ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে না, তাদের সরকারি সেবা পেতেও বঞ্চিত হচ্ছেন না। ঋণখেলাপিরা যখন ক্ষমতার অংশিদার হয়ে যান তখন এ দুষ্ট চক্র থেকে বের হয়ে আসা খুবই দুষ্কর। এখন আমরা সবখানেই গোষ্ঠীস্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে যাচ্ছে।
সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মহিতের আমল থেকে বর্তমান অর্থমন্ত্রীর আমল পর্যন্ত খেলাপী ঋণের উল্লম্ফন, বৈদেশিক মুদ্রা পাচার, রাজস্ব আইনের ঘটতি, চড়া সুদের বৈদেশিক ঋণ নির্ভরতা বাড়তে থাকে। প্রবৃদ্ধি কিংবা মাথাপিছু আয় বাড়লেই মানুষের উন্নয়ন হয়না। প্রকৃত উন্নয়ন তখনই হবে যখন সব মানুষের মৌলিক চাহিদা তথা অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া নিশ্চিত হবে।
পাকিস্তান আমলে মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে বিপুল অর্থ ছিল, আর বৃহত্তর জনগোষ্ঠী নিঃস্ব থেকে নিঃস্ব হচ্ছিলো। বর্তমান সরকারের উন্নয়ননীতির পরিকল্পনায় এই বৃহত্তর জনগোষ্ঠী নেই। উন্নয়ন তেলা মাথায় তেল দেয়া। লুটপাটকারীদের সুবিধা করে দেয়া। দ্রুত ধনী হওয়া আর গরীব বাঁচিয়ে রাখার জন্য যেসব সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি তার একটা বড় অংশ লাভের গুড় পিঁপড়া খেয়ে নিচ্ছে। যে ডলার আয় করতে চোখ ধাঁধানো আলোর নিচে আমাদের নারীরা সেলাই মেশিনে নিজের বিন্দু বিন্দু রক্ত ঢেলে দিচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্যে গনগনে রোদের নিচে নিজের সব আয়ু ঢেলে দিচ্ছেন আমাদের শ্রমিকেরা – এই রক্ত ঘামের বিনিময়ে অর্জিত ডলার আমাদের লুটেরা ধনিরা, কালো টাকার মালিকেরা, দুর্নীতিবাজ ক্ষমতাবানেরা, কর্মকর্তারা বিদেশে পাচার করে দেন আমদানি বাণিজ্যের “ওভার ইনভয়েসিং” ও রপ্তানি বাণিজ্যে “আন্ডার ইনভয়েসিং” এবং হুন্ডি ব্যবসার মাধ্যমে।
মেহনতি শ্রম করে সুবিধাভোগীরা শ্রমের ফসল হাতিয়ে নেয়। দেশে উৎপাদিত মূল্যের ক্ষেত্রে দেখা যায় ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও পরিবহন শ্রমিকদের চাঁদাবাজি ও পণ্য বহনে ব্যবহৃত জ্বালানীর উচ্চমূল্যের কারণে ভোক্তারা বাজার থেকে উচ্চমূল্যে কিনতে হয় এবং পণ্য উৎপাদনকারীরাও ন্যায্য মূল্য পান না।
মূল্যস্ফীতির কারণে আপস করতে হচ্ছে পুষ্টিতে- মাছ, মাংস, ডিম, উধাও হয়েছে মানুষের খাদ্য তালিকা থেকে। সবশ্রেণীর মানুষেরই খরচ এবং আয় বৈষম্যও বেড়েছে। দেশে ২০১৮-২০১৯ সালে মুদ্রাস্ফিতি ছিল- ৫.৪৮ শতাংশ আর ২০২২-২০২৩ সালে দাঁড়িয়েছে ৯.৯৪ শতাংশ। নি¤œ ও মধ্যবিত্তের কর্মসংস্থান, আয়, সঞ্চয় মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। খাদ্য, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের খরচ কমিয়েছে। দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিসপত্রের উপর উচ্চ মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ধার্য্য করায় ন্যূনতম বেঁচে থাকা দূর্বিষহ হবে। সরকার এখনো ক্রমাগত মূল্যস্ফিতির জন্য রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে দায়ী করছে। আন্তর্জাতিক বাজারে বিভিন্ন পণ্যের দাম উল্লেখযোগ্য হারে কমলেও ভোক্তাদের স্বস্তি নেই। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমলেও দেশে তেলের দাম কমার লক্ষণ নেই। আমাদের দেশে পরোক্ষ কর বিভিন্ন নিত্যপণ্যসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে জনগণ থেকে সেটি আদায় করা সহজ। কিন্তু প্রত্যক্ষ কর ইনকাম ট্যাক্স বা আয়কর সেটি ঠিকমতো আদায় করা হয়না। মূল্যস্ফীতির কারণে বাজারে নিত্য পণ্যমূল্যের ২০১৯ সাল থেকে ২০২৩ সালের ব্যবধান লক্ষ করলেই বুঝা যায় কি অবস্থা।
২০১৯ সাল ২০২৩ সাল
সোয়াবিন- ১০৪/- ১৯০/-
চিনি-৫৫/- ১১০/-
আটা-২৮.৫০/- ৫৫/-
মুসুর-৫৫/- ১০০/-
সুখী জীবনের প্রথম শর্ত হল শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের উন্নত মান। আমাদের শিক্ষাবিদেরা শিক্ষা ব্যবস্থার মূল ত্রুটিগুলোর বা সমস্যার মূলে না গিয়ে গা-বাঁচিয়ে কথা বলেন। শিক্ষায় যারা অভিভাবক তারা ভাবেন দেশের সব মানুষ নির্বোধ, তাদের যা বুঝানো হবে তাই বুঝবেন, যা শেখানো হবে তাই শিখবেন। কোন প্রশ্ন করা যাবে না। করলে উত্তর মিলবে না। আমাদের অজ¯্র ছাত্র-ছাত্রীদের মান ধরে না রেখে পাশের সংখ্যা বাড়িয়ে দেওয়া হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন কোম্পানি, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠানে ২৫,৯৮৮ জন বিদেশী মানুষ কাজ করে এর মধ্যে চীনের ৬০৭৫ জন (সর্বোচ্চ) দক্ষ ও মানসম্পন্ন প্রশিক্ষিত কর্মী বিদেশ থেকে শিল্প ও ব্যবসা বাণিজ্য পরিচালনার জন্য বেশি বেতনে নিয়ে আসছেন।
নতুন শিক্ষানীতি নিসন্দেহে শিক্ষার গুণগত মান পরিবর্তনের উপযোগী। কিন্তু এটা বাস্তবায়নে শিক্ষার্থীর তুলনায় শিক্ষকের সংখ্যা অপ্রতুল, শিক্ষকদের মধ্যে একংশের মেধা মানসিক পরিবর্তন ও প্রশিক্ষণের অভাব। স্কুলে পাঠাগার, ল্যাব, মাঠ, মিলনায়তন সহ প্রয়োজনীয় ভৌত সুবিধার অভাব।
আমাদের দেশে প্রচলন আছে সরকারে যারাই ক্ষমতায় থাকে সে দলই ছাত্র রাজনীতিকে ক্ষমতার স্বার্থে অন্যায় ভাবে ব্যবহার করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেন না। পড়াশুনা বা গবেষণা গৌণ বিষয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিরোনাম হয় প্রধানত ছাত্রাবাসে নির্মম নির্যাতন, ভিন্ন মতের উপর অকথ্য আক্রমণ, যৌন নির্যাতন ও দুর্নীতির করণে। শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা দিন দিন বাড়ায় সমাজে মাদক থেকে শুরু করে সামাজিক অপরাধগুলোতে জড়িত হয়।
আমাদের সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ৬৮৪। শিক্ষকদের শূন্যপদ আছে ১৮১৭ জন। ১৮ বছর চাকরী করে টাইম স্কেল বা গ্রেড পাননি ৬০০০ শিক্ষক। তাদের কাছ থেকে জানতে পারলাম এসব সমস্যার সমাধান না হলে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করা কঠিন হয়ে পড়বে। আমাদের শহরের-গ্রামের শ্রমজীবী, কেউ বিধবা, দিনমজুর, কেউ ভ্যান চালক, কেউ ক্ষেতমজুর, কেউ বাস-চালক শ্রমিক, কেউ ফেরিওয়ালা, কেউ বাসা বাড়িতে কাজ করে প্রেরণা থাকে সন্তানের লেখাপড়া করানো। কিন্তু সবসন্তান এই পরিশ্রমের মূল্য দিতে পারে না। কারণ হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উপযুক্ত পরিবেশের অভাব।
স্বাস্থ্য খাতের অবস্থা আরও করুণ। সুখী জীবনের প্রথম শর্ত হলো স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মান উন্নয়ন। সরকারের উচিত শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বর্তমানের চেয়ে আরও তিনগুণ খরচ করা উচিত। সরকারি হাসপাতালগুলিতে সাধারণত শহর ও গ্রামের সাধারণ লোকজন চিকিৎসার জন্য যান। বিত্তশালীরা সাধারণ চিকিৎসার জন্য হলেও প্রাইভেট ডাক্তারদের দেখান। সাধারণ লোকজন হাসপাতালে গেলে প্রথমেই পড়তে হয় চতুর্থশ্রেণীর কর্মচারীদের হয়রানির মধ্যে। তারপর টিকেট কেটে ডাক্তারের কাছে গেলে ডাক্তাররা রোগীদের গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ বা সঠিক রোগ চিহ্নিত হলো কি না তা বাহ্যিকভাবে দেখে ঔষধ লিখে দেন। সেই প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী সহজলভ্য লোক দেখানো দুই/একটি ঔষধ দিয়ে বাকিগুলো বলে দেয় বাহির থেকে কিনে আনার জন্য। কোনো দামী ঔষধ হাসপাতালে দেয়া হয়না। মানুষ হতাশ হয়ে প্রাইভেট চিকিৎসকদের শরণাপন্ন না হয়ে উপায় থাকে না। ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে পরিচালিত প্রাইভেট চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোতে লাগামহীন মুনাফা লাভের জন্য মধ্যবিত্ত-নি¤œবিত্ত মানুষজনকে বিপর্যয়ের মধ্যে ঠেলে দেয়। সাধারণ জ্বর-ঠা-া থেকে শুরু করে জটিল অসুখ, অপারেশন আর জীবন বাঁচানোর জরুরি চিকিৎসা, ডাক্তারের ফি, প্যাথলজির পরীক্ষা, ঔষধপত্রের দাম সবকিছুর খরচ ঊর্ধ্বমুখী। যারা বিত্তশালী তারা ইচ্ছা করলে উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশ-বিদেশে ছুটে যাবেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের পক্ষে তা সম্ভব নয়। সরকারিভাবে উন্নত চিকিৎসার কোন নিশ্চয়তা না থাকায় অধিক মুনাফার লোভে রাজধানীসহ বিভাগীয় ও জেলা শহর, শহরতলী সর্বত্র ব্যাঙের ছাতার মতো প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিক গজিয়ে উঠেছে। যার কোন নিয়ন্ত্রণ বা চিকিৎসার মানের তদারকী করা হয় না। আন্তর্জাতিক মানদ-ে সিজারিয়ানে শিশু জন্মের হার শতকরা ১০-১৫ শতাংশ রাখার কথা। কিন্তু বাংলাদেশে এটি ৩৩ শতাংশ। দেশের হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সবসময় পাওয়া যায়না। চিকিৎসকদের দক্ষতারও মানুষের আস্থার ঘাটতি আছে। সেবা ও পরিচর্যার মান নি¤œ মানের। যোগ্য ও দক্ষ সহায়ক অর্থাৎ নার্স, চিকিৎসা সহকারী, ল্যাবরেটরী টেকনিশিয়ান অপ্রতুল এবং বেতনও খুব কম পায়। বিশ্ব ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ১লক্ষ মানুষের জন্য ডাক্তারের সংখ্যা পাকিস্তানে ১১২ জন, ভারতে ৯৩ এবং বাংলাদেশে ৬৪ জন নিয়োজিত। এরপর রয়েছে দুর্নীতি ও কাজে অবহেলা যার কোন প্রতিকার নেওয়া হয়না।
কিছুদিন পূর্বে খবর পেলাম চট্টগ্রামের দুই সরকারি হাসপাতালে ২৯ কোটি টাকার ৪টি চিকিৎসা যন্ত্র নষ্ট হয়ে পড়ে থাকায় রোগীদের বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ৩/৪ হাজার টাকা ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। গত কোভিডের সময় পত্রপত্রিকায় দেখলাম বিমানবন্দরে পড়ে আছে কোটি কোটি টাকার চিকিৎসার যন্ত্রপাতি। বর্তমানে ডেঙ্গু মোকাবেলায় রোগীরা সিট পায়না। শোনা যায়া হাসপাতালে রোগিদের স্যালাইন, ক্যানোলা, স্কসটিপ ও স্যালাইনের সঙ্গে যুক্ত নলও দেওয়া হচ্ছে না। পুষ্টির ও সুচিকিৎসার অভাবে খর্বকায় ও কম বৃদ্ধি সম্পন্ন শিশু নানান জটিলতা নিয়ে জন্ম হচ্ছে।
কেন আমরা এই অবস্থায় পড়লাম! কারণ আমরা লাইনচ্যুত হয়ে পড়েছি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করলে সরকারের সঙ্গে জনগণের গভীর সম্পর্ক গড়তে হবে। মুক্তচিন্তা ও সাধারণ জনগণের স্বার্থ রক্ষা করতে হবে। সুখি জীবন করতে হলে স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মান উন্নয়ন, স্থানীয় শিল্পায়ন গড়ে, মানসম্পন্ন কর্মসংস্থান ও স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামীণ অর্থনীতি দাঁড় করাতে হবে ও বৈষম্য দূর করতে হবে। ফিরিয়ে আনতে হবে সত্যিকারের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়।

 

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com