সুনামকণ্ঠ ডেস্ক ::
দেশের অভিজাত এলাকায় বসবাসকারী করদাতাদের গত করবর্ষের রিটার্নের তথ্য যাচাই করার কাজ শুরু করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। গত এক মাসে (জুলাই) ৩০ হাজারের বেশি রিটার্নের তথ্য খতিয়ে দেখা হয়েছে। এতে ৭৪ ভাগ ধনী করদাতাই গাড়ির তথ্য গোপন করেছে। কোটি টাকা দামের দুটি বা তার বেশি গাড়ি থাকলেও ২৫ ভাগ করদাতা রিটার্নে প্রকৃত তথ্যের চেয়ে কম আছে বলে উল্লেখ করেছে। শতকরা ৩৯ ভাগ করদাতা গাড়ির দাম কম দেখিয়েছেন। শতকরা ১০ ভাগ করদাতার গাড়ি থাকলেও নেই বলেও জানিয়েছেন। এই করদাতার অনেকে ব্যাংক হিসাবের এবং স্থাবর স¤পদের তথ্যও গোপন করেছেন। এনবিআরের তৈরি প্রতিবেদন থেকে এসব জানা গেছে।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, ১ জুলাই থেকে রাজধানীর গুলশান এলাকা, উত্তরা, সেগুনবাগিচা, ধানমন্ডি, বনানী, লালমাটিয়া, বসুন্ধরা, মিরপুর-১৩, বারিধারায় টাস্কফোর্স কমিটির কাজ চলছে। রাজধানীর অভিজাত এলাকায় বসবাসকারী বাকি করদাতাদের তথ্যও খতিয়ে দেখা হবে। এরপর চট্টগ্রামের অভিজাত এলাকার করদাতাদের রিটার্নের তথ্য খতিয়ে দেখার কাজ শুরু করা হবে। পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন বিভাগীয় ও জেলা শহরের অভিজাত এলাকার করদাতাদের রিটার্নের তথ্য যাচাই করা হবে।
রিটার্নে তথ্য গোপনকারীদের মধ্যে ৫০ বছরের বেশি বয়সের করদাতাই বেশি। রিটার্নে যাদের গরমিল পাওয়া গেছে তাদের মধ্যে শতকরা ৭০ ভাগই ব্যবসায়ী। তাদের ৬৫ ভাগের বয়সই ৫২ বছর বা তার বেশি। তথ্য গোপনকারী বর্তমান ও সাবেক চাকরিজীবীদের ৬০ ভাগের বয়স ৫৫ বছরের বেশি। তবে খেলোয়াড়, অভিনেতা-অভিনেত্রী, শিল্পী, চিকিৎসক, আইনজীবী, প্রকৌশলী, স্থপতি, সাংবাদিকদের মধ্যে মিথ্যা প্রদানকারীদের শতকরা ৪৫ ভাগের বয়সই ৫০ বছর বা তা নিচে। অবসরপ্রাপ্ত বা ৬৫ বছরের বেশি বয়সের নাগরিকদের শতকরা ৯০ ভাগই রিটার্নে করযোগ্য আয় নেই এবং অন্যের ওপর নির্ভরশীল বলে জানিয়েছে। অথচ এসব ব্যক্তির নামে ফ্ল্যাট, বাড়ি ও গাড়ি আছে। ফ্ল্যাট ও বাড়ি থেকে বড় অঙ্কের ভাড়া পেয়ে থাকেন, যা রিটার্নে আয় হিসাবে দেখাননি।
এনবিআর সূত্রে আরও জানা গেছে, অনেকে রিটার্নে অলংকারের পরিমাণ এবং বাজারদরের চেয়ে মূল্য কম দেখিয়েছেন। স্থাবর ও অস্থাবর স¤পদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ফ্ল্যাটের সংখ্যা কম দেখিয়েছেন। অন্যদিকে রিটার্নে যেসব ফ্ল্যাটের কথা জানানো হয়েছে তার প্রতিটির মূল্যও কম দেখানো হয়েছে। রাজধানীর বাইরে এক এলাকায় বেশি পরিমাণের জমি থাকলে বেশির ভাগ করদাতা তা উল্লেখই করেননি। এসব এলাকার করদাতাদের পরিবারের সদস্যদের রিটার্নের তথ্যেও গরমিল পাওয়া গেছে।
রিটার্নের তথ্য যাচাই করতে প্রতিটি কর সার্কেলের কর্মকর্তাদের নিয়ে পৃথক পৃথক টাস্কফোর্স কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানা গেছে এনবিআর সূত্রে। এরই মধ্যে যাদের রিটার্নে গরমিল পাওয়া গেছে তাদের কাছে তথ্য গোপনের কারণ জানতে চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। একই সঙ্গে সময় বেঁধে দিয়ে পাওনা কর পরিশোধে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কয়েকবার সময় বেঁধে দেওয়ার পরও পাওনা পরিশোধ না করলে রাজস্ব আইন অনুসারে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তথ্য গোপনের দায়ে অভিযুক্ত করে এনবিআর মামলা করবে। প্রয়োজনে হিসাব জব্দ এবং জেল-জরিমানাও করা হবে।
সম্প্রতি এক সভায় এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেন, সব করদাতাই আমাদের কাছে সম্মানিত। রিটার্নে করদাতারা বাড়ি, ফ্ল্যাট ও গাড়ির প্রকৃত তথ্য দিয়ে রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছেন কি না তা খতিয়ে দেখা হবে।
এনবিআর কর্মকর্তারা জানান, অনেকের গাড়ির তথ্য গোপনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এসব গাড়ির মধ্যে এক কোটি থেকে এর বেশি দামের গাড়িও আছে। এই গাড়ির অনেকগুলোর তথ্য বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) কাছে নেই। এসব গাড়ি জাল বা ভুয়া কাগজপত্র বানিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে। বছর শেষে নবায়নের ও অগ্রিম কর প্রদানের কাগজও ভুয়া বানিয়ে নেওয়া হয়েছে। বছরের পর বছর এসব কারসাজিতে সরকার হাজার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব বঞ্চিত হয়েছে। এ কাজে অনেক অসাধু গাড়ি বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান এবং একাধিক দালাল চক্র জড়িত। এসব দালালের সঙ্গে বিআরটিএর অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনৈতিক লেনদেনের স¤পর্ক রয়েছে।
বিআরটিএর ঢাকার মিরপুর, কেরানীগঞ্জের ইকুরিয়া, বরিশাল, পিরোজপুর, ভোলা, ঝালকাঠি, নেত্রকোনা, পটুয়াখালী, জামালপুর, খাগড়াছড়ি, ফেনী ও কক্সবাজার কার্যালয়ের আশপাশের দালাল চক্রের সহায়তায় গাড়ির ভুয়া নথিপত্র জোগাড় করা হয়েছে অনেক দিন থেকেই একাধিক চক্র এ অপকর্ম করছে। ভুয়া নথি দিয়ে গাড়ি চালিয়েছে এমন দুশোর বেশি গাড়ি এনবিআর থেকে চিহ্নিত করা হয়েছে।
এনবিআরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরেজমিনে উপস্থিত হয়ে গুলশান অ্যাভিনিউ এলাকায় বসবাসকারী এক ব্যবসায়ীর বাড়িতে একটা সাধারণ মানের প্রাইভেট গাড়ি, দুটি বিলাসবহুল দামি গাড়ি পাওয়া যায়। এ ব্যক্তি রিটার্নে শুধু প্রাইভেট গাড়ির উল্লেখ করেছেন। সব তথ্য-প্রমাণ খতিয়ে দেখে প্রমাণ পাওয়া যায়, দামি গাড়ি দুটি রাজধানীর বাইরে থেকে ভুয়া কাগজপত্র ব্যবহার করে নিবন্ধন নেওয়া হয়েছে। একইভাবে উত্তরার সেক্টর-৩-এ বেসরকারি চাকরিজীবীর তিনটি গাড়ি পাওয়া যায়। একটি নিজে, স্ত্রী এবং সন্তানরা দুটি ব্যবহার করেন। অথচ রিটার্নে সবচেয়ে কম দামের একটি গাড়ির কথা বলা হয়েছে। যার মূল্য কম দেখানো হয়েছে। অন্যদিকে রাজধানীর মিরপুর-১৩ নম্বরে বসবাসকারী এক শিল্পীর ৭২ বছর বয়সের বাবার নামে দুটি গাড়ি থাকলেও তার একটিও রিটার্নে
উল্লেখ করা হয়নি। এই গাড়ি দুটি মিরপুর থেকে নিবন্ধন নিয়েছে। দুটো গাড়িই শিল্পী ও তার পরিবার ব্যবহার করেন।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ গণমাধ্যমকে বলেন, সাধারণ আয়ের মানুষের চেয়ে ধনীদের কর ফাঁকির পরিমাণ বেশি। বিশেষভাবে যারা বাড়ি, গাড়ির তথ্য গোপন করে কর ফাঁকি দেন। এসব ব্যক্তি নিয়মিত কর পরিশোধে সক্ষম। তাদের শাস্তির আওতায় আনা কঠিন। তারা সমাজের প্রভাবশালী। এ বিষয়ে এনবিআরের উচিত কঠোর হওয়া।