বিভিন্ন গণমাধ্যমে যে-সব তথ্যবার্তা পরিবেশিত হয় সে-সব তথ্যবার্তা প্রতিনিয়ত প্রতিপন্ন করে যে, সর্বাস্তৃত একটি লুটপাটের রাজত্ব চলছে সারা দেশজুড়ে, কেউ ঠেকাতে পারছে না। সকল প্রকার লুটপাটের একটা ফিরিস্তি যে-কেউ তৈরি করতে পারেন, যদি সেটা সুদীর্ঘ হয়ে উঠে তাহলেও বোধ করি তা লুটপাটের সবটাকে প্রকাশ করার পক্ষে যথেষ্ট বলে বিবেচিত হবে না, সেটার অপূর্ণতা নিয়ে আপত্তি উঠবেই অর্থাৎ পরিপূর্ণতা নিয়ে সন্দেহ থেকে যাবেই এবং এটাই স্বাভাবিক। কেন না প্রতিষ্ঠিত লুটপাটের বহরব্যাপকতা ও গভীরতা এতোটাই বেশি যে, তার সুনিশ্চিত পরিমাণ নির্ণয় এককথায় অসম্ভব। কেবল বলা যায়, সমাজ ও প্রকৃতির প্রতিটি বিন্দুতে লুটপাটের তা-ব অপ্রতিরোধ্য গতিতে অব্যাহত আছে। সমাজ পরিসরে আত্মসাতক্রিয়া যখন আইনি প্রকরণে বৈধতা পেয়ে যায় তখন আত্মসাৎ এমন সর্বাত্মক রূপ লাভ করে। অভিজ্ঞমহলের ধারণা আমাদের দেশে এমন আত্মসাতকেÑ যেমন কালো টাকাকে সাদা করা কিংবা বালু উত্তোলনের জন্যে নদী ইজারা দেওয়ার মতো ঘটনার মতো অগণিত ঘটনা-বাস্তবতার উদাহরণ তোলে ধরা যায়Ñ আইনি প্রকরণে ইতোমধ্যে বৈধতা দেওয়া হয়েছে ও হচ্ছে। এখানে নদী থেকে বালু উত্তোলনের বিষয়টিকেই বিবেচনা করা যাক।
গত বৃহস্পতিবারের (১০ আগস্ট ২০২৩) দৈনিক সুনামকণ্ঠের একটি সংবাদপ্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, “বালি উত্তোলনে ভাঙছে যাদুকাটা নদীর পাড়”। এই সংবাদপ্রতিবেদনের পরতে পরতে সমাজ ও প্রকৃতিকে নির্মমভাবে শোষণের তথ্যচিত্র প্রদর্শিত হয়েছে, যে-শোষণের সার্বিক প্রক্রিয়াকে অর্থনীতিবিদেরা আত্মসাত বলে অখ্যাত করেছেন। প্রতিবেদনে কী বলা হয়েছে তা দেখার আগে বালু উত্তোলনের আইন কী বলে সেটা পরখ করে দেখা যাক। ২০১০ সালের বালু মহাল আইনে বলা হয়েছে যে, বিপণনের উদ্দেশ্যে কোনো উন্মুক্ত স্থান, চা-বাগানের ছড়া বা নদীর তলদেশ থেকে বালি বা মাটি উত্তোলন করা যাবে না। এছাড়া সেতু, কালভার্ট, ড্যাম, ব্যারাজ, বাঁধ, সড়ক, মহাসড়ক, বন, রেললাইন ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা অথবা আবাসিক এলাকা থেকে বালি ও মাটি উত্তোলন নিষিদ্ধ, যা অমান্য করলে দুই বছরের জেলসহ জরিমানার বিধান রয়েছে। বালু উত্তোলনের আইন সংক্রান্ত এইটুকু তথ্য পর্যালোচনা করলে যে কেউ বুঝতে পারবেন যে, যাদুকাটা নদী ও তার আশেপাশে কোনও নদীতেই বালু উত্তোলনের ক্ষেত্রে বালুমহাল আইনের বিধি-নিষেধ মানা হচ্ছে না। এইভাবে প্রমাণ করা যায় যে, সমাজ ও প্রকৃতির প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রকারান্তরে আইন না মেনে আত্মসাতের সর্বাত্মক তা-ব বহাল রাখা হয়েছে। না হলে কেন প্রতিবেদনে একজন স্থানীয় সংসদ সদস্যের বরাত দিয়ে বলা হবে, ‘লিজ নিয়েই বালি তোলা হচ্ছে। এলাকাবাসী না দিলে কোন বাহাদুর আছে, বালি তুলে নিয়ে যাবে প্রশ্ন রাখেন তিনি। টাকার জন্য স্থানীয়রা নিজেরা নিজেরাই বালি তুলছে বলে মন্তব্য করে তাদের নদীর মাঝখান থেকে বালি তোলার নির্দেশনা দিয়েছেন।’ অথবা একজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে কেন বলা হবে, ‘এখানে আগে থেকেই একটি সংঘবদ্ধ চক্র অবৈধভাবে এসব কাজ করছে। তারা প্রভাবশালী বলেও জানান তিনি। আর প্রতিবাদ করতে গেলে স্থানীয়দের হয়রানি হওয়ার বিষয়টিও শিকার করেন। তবে পাহারা দেয়া সম্ভব না জানিয়ে স্থানীয়দের সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এসব প্রতিহতে স¤পৃক্ত করার কথা জানান। বালি উত্তোলনের খবর পেলে নিয়মিতভাবে অভিযান চলছে বলেও জানান ইউএনও।’
সে যাই হোক, আলোচ্য প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সমাজ ও প্রকৃতিকে অবৈধ উপায়ে শোষণের কাজ পুরোদমে চলছে এবং প্রকারান্তরে সাধারণ মানুষের অপরিমিত ক্ষতিসহ প্রাকৃতিক ভারসাম্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
এখন প্রশ্ন হলো প্রতিকারের জন্যে মানুষ কার কাছে যাবে? কারও কারও মতে যে-কর্তৃপক্ষ বালুমহাল লিজ দিয়েছেন তার কাছেই যেতে হবে। অগত্যা সে-কর্তৃপক্ষের কাছেই দাবি করছি, সমাজ ও প্রকৃতিকে রক্ষা করুন। ইতোমধ্যে প্রশাসন ও ইজারাদাররা বালু মহালের আইনি নিয়ম রক্ষায় নিজেদের ব্যর্থতা প্রমাণ করেছেন, তাই উদ্ভূত আইনবিরোধী পরিস্থিতি সামাল দিতে আপাতত লিজ বাতিল করুন।