ডেঙ্গুর ভয়াবহতা প্রতিদিন রেকর্ড ভঙ্গ করে চলছে। আমরা অনুমান করতে পারছি না আরো কত ভয়াবহতা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। মৃত্যুহারের দিক থেকে ডেঙ্গুপ্রবণ দেশগুলোর সব রেকর্ড ভেঙে আমরা বিশ্বরেকর্ড গড়েছি। তার পরও লাগাম টেনে ধরে আমরা বলতে পারছি না আর কত। এর মূল কারণ কী? যেকোনো রোগের ভয়াবহতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের একটা পরিচ্ছন্ন বার্তা দিয়ে যায় আর তা হলো রোগ সৃষ্টির যে কারণগুলো বিরাজমান তার শক্তির কাছে পরাজিত হচ্ছে আমাদের প্রয়াস। যেহেতু ডেঙ্গু একটা ভেক্টর বা মশকবাহিত রোগ। এ রোগের ভয়াবহতা ও তীব্রতা শুধু ডেন-ভাইরাসের শক্তিশালী ও বৈচিত্র্যময় আক্রমণের ফল তা কিন্তু নয়। এর দক্ষতা অবশ্যই মশকীর প্রজনন স্থানের পরিবেশ, মানুষের হস্তক্ষেপ, জমানো পানির প্রাচুর্য, পরিবেশের উপাদানের
পরিবর্তন ও সর্বোপরি প্রাকৃতিক শত্রুর ধ্বংস। এখন আসা যাক, এসব প্রভাবিত উপাদানগুলো মশক ও ডেন-ভাইরাসকে কতটা প্রভাবিত করেছে বা করতে ভূমিকা পালন করছে। উল্লিখিত উপাদানগুলোর মধ্যে মানুষের হস্তক্ষেপ যদি আমরা মূল নিয়ামক ধরি, তাহলে অন্য উপাদানগুলো একে কেন্দ্র করেই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। অর্থাৎ মশকের প্রজনন স্থানগুলো অবশ্যই মানবসৃষ্ট এবং সেই স্থানগুলোয় মশার লার্ভার পর্যাপ্ত খাবার সরবরাহ করাও আমাদেরই দ্বারা হয়ে চলেছে। আমরা বুঝে করি বা না বুঝে করি আমাদেরই দ্বারাই হয়ে চলেছে। আমাদের জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে প্রতিনিয়ত প্রজনন স্থান সৃষ্টি এবং তা খাবারসমৃদ্ধ করার কাজটি আমরা করে চলেছি। আরেকটু ¯পষ্ট করে বললে বলতে হয়, প্রতিদিন নতুন নতুন ভবন তৈরি, মেরামত ও পয়ঃপ্রণালি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা বন্ধ করে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি, নির্বিচারে গাছপালা নিধন করে ইমারত নির্মাণ, মানবিক ও সামাজিক দায়িত্ব বোধের তোয়াক্কা না করে যত্রতত্র প্লাস্টিকের বোতল ও পানি জমে থাকতে পারে এমন ক্যান, খাবারের উচ্ছিষ্ট বাক্স, নারকেলের মালাই ইত্যাদির ছুড়ে ফেলার নিয়মিত চর্চা মশক জন্মানো ও বৃদ্ধির ওপর কতটা প্রভাব বিস্তার করছে তা সহজেই অনুমেয়।
আমাদের নগ্ন হস্তক্ষেপের ফলে সমন্বিত দমন ব্যবস্থা না করে সমন্বিতভাবে মশকী বৃদ্ধিতে মুখ্য ভূমিকা রাখছি। যেমন- ক) উপর্যুপরি কীটনাশক ব্যবহার করে মশকীকে প্রতিরোধী করে তোলা। খ) মশকীর প্রাকৃতিক শত্রুকে ধ্বংস করে মশকীকে দ্বিগুণ শক্তিশালী করে তোলা। গ) পানিদূষণ করে মশকীর লার্ভার খাবার ব্যাকটেরিয়ার পর্যাপ্ত সরবরাহ করা। ঘ) বায়ুদূষণের মাধ্যমে পরিবেশের প্রভূত ক্ষতি সাধন করে পরিবেশের যেসব উপাদান, যেমন তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, আর্দ্রতা, বায়ুপ্রবাহ ও সূর্যরশ্মির প্রভাব প্রভৃতি মশকীয় বংশবিস্তারে উপযোগী করে তোলা। এ উপযোগী পরিবেশই মশকীকে মৌসুমি কালকে অতিক্রম করে সারা বছরই তার বংশবিস্তারে এবং ডেন-ভাইরাসের বহন ও বিস্তারে মুখ্য ভূমিকা রাখছে। ঙ) এডিস মশার বংশ বিস্তার ট্রি-হোল বা গাছের গর্তে জমানো পানিতেও হয়ে থাকে। গাছপালা ধ্বংসের ফলে মশা জনমানুষের বসতিতে চলে আসছে এবং বাড়ির বাইরে এডাল্টিসাইড স্প্রে করার ফলে বসতবাড়ির মধ্যে মশকীর ঘনত্ব বেড়েই চলছে। চ) অপরিকল্পিত নগরায়ণের শহর হিসেবে দাঁড়িয়েছে ঢাকা। দেখা যায়, দুই ভবনের মাঝে থাকে না কোনো ফাঁক। হয়তো বছরের পর বছর কেউ প্রবেশ করতে পারে না সেখানে। আবার সিটি করপোরেশনের কোনো কর্মীই সেখানে কিছু প্রয়োগ করতে পারেন না। এ স্থানগুলো নিরবচ্ছিন্ন মশা তৈরির কারখানা হিসেবে কাজ করছে। ছ) কৃষিকাজ ও মৎস্যচাষের জন্য যথেচ্ছা কীটনাশকের ব্যবহার অত্যন্ত জটিলভাবে পানি ও মাটির দূষণ ঘটাচ্ছে, যার ফলে সেই দূষিত স্থানে জমা পানিতে মশার ডিম ফুটে লার্ভা বের হয়। একটি প্রতিরোধী পরিবেশে নিজেকে আরো শক্তিশালী করে তুলছে।
এতগুলো সহযোগিতামূলক কর্মকা-ের ফলাফল হিসেবে আমরা যা লক্ষ করছি, তাহলো মশকীর লাগামহীন বংশবৃদ্ধি ও কীটনাশক প্রতিরোধী হয়ে ওঠা একই সঙ্গে ডেন-ভাইরাসের আক্রমণ এবং লক্ষণের প্রভূত পরিবর্তন। আগের চেয়ে বর্তমানে ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণগুলোর মধ্যে যে পরিবর্তন এসেছে তা ¯পষ্টত মশকীর প্রতিরোধী আগ্রাসী আচরণের শরীরবৃত্তীয় কার্যকলাপের ফলাফল। সহজ ভাষায় বললে বলতে হয়, মশকী যেমন প্রতিরোধী ও শত্রুমুক্তভাবে দ্বিগুণ শক্তিশালী হয়ে উঠছে, ঠিক তেমনি মশকীর শরীরে বেড়ে ওঠা ও সব শরীরবৃত্তীয় কার্যকলাপ ব্যবহারকারী ডেন-ভাইরাসও একইভাবে চলতে থাকলে এর গন্তব্য কোথায় এবং কতটা ভয়াবহ তা নিরূপণ করতেই গা শিউরে উঠছে। তবে আশার কথা হলো, এত কিছু হচ্ছে মানুষের হস্তক্ষেপের কারণে। তাই মানুষের হস্তক্ষেপকে যদি যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনার মধ্যে আনা যায় তাহলেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসতে বাধ্য। অর্থাৎ সময় এসেছে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য সবাইকে একসঙ্গে কাজ করার। সেক্ষেত্রে আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয়ের সঙ্গে সব শ্রেণী-পেশার মানুষের এ সংকট উপলব্ধি করতে হবে। সরকারের বিভিন্ন বিভাগের সম্মিলিত প্রয়াস ও জনস¤পৃক্ততাই পারে এ ভয়াবহতা হতে রক্ষা করতে।
[অধ্যাপক ড. মো. গোলাম ছারোয়ার: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, কীটতত্ত্ব বিভাগ, জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম), মহাখালী, ঢাকা]