আশিস রহমান ::
সারা গ্রামে ৫ জনও এসএসসি পাস শিক্ষার্থী খুঁজে পাওয়া যায়নি। যাতায়াতের জন্য নেই কোনো রাস্তাঘাট। অপুষ্টিতে ধুঁকছে গ্রামের প্রতিটি পরিবারের শিশু। প্রাথমিক শিক্ষা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে কোমলমতি শিশুরা। বর্ষা মৌসুমেও এবার হাওরে পানি নেই, নেই আগের মতো মাছ। ফলে বংশ পর¤পরায় মাছ ধরা ও বিক্রির পেশায় নিয়োজিত গ্রামের প্রতিটি পরিবার বেকারত্বের ঘানি টেনে বেড়াচ্ছেন। পেটের দায়ে বিভিন্ন এনজিও সংস্থার কাছ থেকে ঋণ নিয়ে এখন কিস্তি পরিশোধ করতে পারছেন না। অপুষ্টি, অশিক্ষা, দারিদ্র, বেকারত্ব, অবহেলা ও বঞ্চনায় জর্জরিত দোয়ারাবাজার উপজেলার সদর ইউনিয়নের জেলেপল্লী দক্ষিণ বড়বন্দ গ্রামের দুর্দশা দেখার জন্য যেন কেউ নেই।
উপজেলা সদরের উত্তর পাশে ব্রিটিশ সড়ক। সড়কের পূর্বপাশে নাইন্দার হাওর ও পশ্চিম পাশে কালিউরি নদী। বৃটিশ সড়ক ধরে উত্তর দিকে অগ্রসর হলেই সামনে পড়বে মুদিদোকান। সেখানে গিয়ে সড়ক থেকে নেমে কাঁচা রাস্তা ধরে হেঁটে একটু পশ্চিম দিকে যেতেই দেখা মেলে দ্বীপ সদৃশ দক্ষিণ বড়বন্দ গ্রামের। কাদায় ভরা সড়ক হেঁটে ও নৌকায় করে যেতে হয় এই গ্রামে। চারদিকে হাওর-নদীর পানিবেষ্টিত এই গ্রামটি একটি নিভৃত জেলে পল্লী। প্রায় ১০০ জেলে পরিবারের বসবাস এখানে।
সোমবার (৩১ জুলাই) দুপুরে সরেজমিনে দক্ষিণ বড়বন্দ গ্রাম ঘুরে স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে আলাপকালে জানা যায়, গ্রামবাসীর দুর্দশার কথা। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, স্বাধীনতার প্রায় ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত উপজেলা সদরের সাথে দক্ষিণ বড়বন্দ গ্রামের কোনো সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা নেই। শুকনো মৌসুমে পায়ে হেঁটে আর বর্ষা মৌসুমে নৌকায় করে যাতায়াত করতে হয়। রাস্তার ব্যাপারে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সংসদ সদস্যের সাথে একাধিকবার যোগাযোগ করে দায়সারা আশ্বাস ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যাইনি। এদিকে গ্রামে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই। যাতায়াত ব্যবস্থা না থাকায় দূরবর্তী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও সন্তানদের পড়াশোনায় পাঠাতে পারছেন না অভিভাবকেরা।
অন্যদিকে জ্যৈষ্ঠ থেকে কার্তিক পর্যন্ত বছরের পাঁচ মাস গ্রামের পার্শ্ববর্তী হাওরে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন তারা। বাকি সময়টুকু মাছ ধরতেন নদীতে। এবার পানি না থাকায় দুইমাসও হাওরে মাছ ধরা যায়নি। ফলে প্রতিটি পরিবারের কর্মক্ষম পুরুষেরা এখন বাড়িতে বসে বেকার সময় পার করছেন। সংসার চালাতে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন তারা।
আলাপকালে দক্ষিণ বড়বন্দ গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল মন্নান (৬৫) বলেন, হাওরের চারদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধ। পানি আসা যাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নাই। হাওরে এবার পানিও নাই, মাছও নাই। স্ত্রী সন্তান নিয়ে বাড়িতে বেকার সময় পার করছি। ব্র্যাক থেকে ঋণ নিয়ে এখন কিস্তি পরিশোধ করতে পারছিনা। সরকারি কোনো প্রণোদনাও পাচ্ছিনা। এভাবে চললে আমাদের না খেয়ে মরতে হবে।
একই গ্রামের জিয়া উদ্দিন (৫৫) বলেন, আমাদের ঘরে ঘরে এখন অভাব। সবাই বেকার। এবছর কোরবানির ঈদে আমাদের সমাজে কোনো পশু কোরবানি পর্যন্ত হয়নি। ধারদেনা করে এখন সংসারের খরচ চালিয়ে যাচ্ছি।
জালাল উদ্দিন (৫০) বলেন, ঘর থেকে বের হওয়া যায়না। রাস্তাঘাট নাই। আমার জন্মের আগে রাস্তাঘাট যেমন ছিলো এখনো সেই অবস্থাতেই আছে। ভোটের সময় হলে নেতারা ভোট নিতে আসে পরে আর আমাদের খোঁজখবর কেউ রাখেনা।
গৃহিণী মনোয়ারা বেগম (৫০) বলেন, স্কুল নাই। বাচ্চাদেরকে পড়াশোনা করাতে পারছিনা। বাচ্চারা মানুষ হবে কিভাবে। রাস্তাঘাট নাই। বৃদ্ধ মানুষ ও গর্ভবতী নারীরা অসুস্থ হলে হাসপাতালে নেওয়া যায়না। আমাদের কোনো উন্নয়ন হয়না।
এ ব্যাপারে দোয়ারাবাজার সদর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আব্দুল হামিদ বলেন, দক্ষিণ বড়বন্দসহ আশপাশের কয়েকটি গ্রাম সত্যিই অনেক অবহেলিত। এখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই, কোনো রাস্তাঘাট নেই। শিক্ষার হার একেবারে কম। আমি স্থানীয় সংসদ সদস্যসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে এখানকার বিষয়ে একাধিকবার অবহিত করেছি। এছাড়া আমার ইউনিয়ন পরিষদেরও তেমন কোনো বরাদ্দ নেই। আমি আমার পরিষদের সক্ষমতার মধ্যে যতটুকু সম্ভব উন্নয়ন কাজ করে যাচ্ছি। এই এলাকার সার্বিক উন্নয়নে স্থানীয় সংসদ সদস্যসহ প্রশাসনের সুদৃষ্টি কামনা করছি।
উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা পঞ্চানন কুমার সানা জানান, প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করতে হলে বিভিন্ন ধরনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। রিমোট এরিয়ার জন্য দক্ষিণ বড়বন্দে এনজিওভিত্তিক একটি পকেট স্কুল চালু করা হয়েছিল। পরে এটার কার্যক্রমও বন্ধ হয়েগেছে।
উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা তুষার কান্তি বর্মণ জানান, হাওরে এবার পানির পরিমাণ কম হওয়ায় এবং দেশীয় মাছ কমে যাওয়ায় মৎস্যজীবীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সকল প্রকৃত মৎস্যজীবীদের তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। অনেকের কার্ড হাতে এসেছে আবার অনেকের কার্ড এখনো প্রসেসিং চলছে। সকল প্রকৃত মৎস্যজীবীকে এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে। আমাদের উপজেলাসহ বৃহত্তর সিলেট বিভাগের মৎস্যজীবীদেরকে এখন পর্যন্ত প্রণোদনার আওতায় আনা হয়নি। সরকারের পরিকল্পনা আছে প্রণোদনার আওতায় নিয়ে আসার। সরকারি প্রণোদনা আসলে মৎস্যজীবীদেরকে প্রণোদনা দেওয়া হবে।
দোয়ারাবাজার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আরিফ মুর্শেদ মিশু বলেন, দুর্গম এরিয়ার উন্নয়নের জন্য আমরা কিছু প্রস্তাবনা পাঠিয়েছি। এছাড়া কয়েকটি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের প্রস্তাবনাও পাঠানো হয়েছে। দক্ষিণ বড়বন্দ গ্রামের সমস্যাগুলো আমি সরেজমিনে গিয়ে দেখে আসবো।