1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
  3. [email protected] : wp-needuser : wp-needuser
শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২:২৩ অপরাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু : একটি অবহেলিত জাতীয় সংকট

  • আপডেট সময় শুক্রবার, ২৮ জুলাই, ২০২৩

ড. মো. ইদ্রিস আলম
শিশু ও কিশোরদের মৃত্যুর অন্যতম কারণ পানিতে ডুবে মৃত্যু, যা বর্তমানে একটি অবহেলিত জাতীয় সংকট। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ২০১৭ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ্বে প্রতি বছর ৩ লাখ ৬০ হাজার মানুষ পানিতে ডুবে মারা যায়। এর ৯০ শতাংশই ঘটে নি¤œ ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোয়। পানিতে ডুবে মৃত্যুতে সবচেয়ে ঝুঁকিতে আছে এক-চার বছরের শিশুরা। দ্বিতীয় ঝুঁকিপূর্ণ বয়স পাঁচ-নয় বছর। ডব্লিউএইচওর প্রতিবেদনে দেখা যায়, ছেলেশিশু মেয়েশিশুর তুলনায় দ্বিগুণ পানিতে ডুবে মারা যায়। পানিতে মৃত্যু পরিহারযোগ্য তবে পানিতে ডুবে মৃত্যু পরিহারে প্রতিরোধমূলক কর্মসূচি বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশে অপেক্ষাকৃত কম।
বাংলাদেশের প্রথম স্বাস্থ্য ও তথ্য জরিপ (২০১৩) অনুযায়ী, এক থেকে ১৭ বছরের শিশুদের অপমৃত্যুর প্রধান কারণ পানিতে ডুবে মৃত্যু, যা যৌথভাবে নিউমোনিয়া, অপুষ্টি ও কলেরায় মৃত্যুর চেয়েও বেশি। বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্বাস্থ্য ও তথ্য জরিপ (২০১৬) অনুযায়ী, বছরে ১৪ হাজার ৪৩৮ জন (১-১৭ বছর বয়সী) শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। শিশুমৃত্যুর অন্যতম কারণ: ১. বয়স্কদের তত্ত্বাবধানের অভাব, ২. গ্রামে শিশু পরিচর্যা কেন্দ্রের অভাব, ৩. অতিদরিদ্রতা, ৪. পুকুর-জলাধারে নিরাপত্তাবেষ্টনীর অভাব এবং ৫. সাঁতার না জানা। বাংলাদেশে প্রায়ই আট-নয় বছরের শিশুর সাঁতার না জানার কারণে পানিতে ডুবে মারা যেতে দেখা যায়। যদিও একটি সুস্থ শিশুকে চার-পাঁচ বছর বয়স থেকে সাঁতার শেখানো উচিত। পুকুর, ডোবা, খাল, বালতি, বাকেট ইত্যাদি জায়গায় বিভিন্ন বয়সী শিশু মারা যায়। এক গবেষণায় দেখা যায়, পাঁচ বছর বয়সীদের ৮০ শতাংশ পানিতে ডুবে মৃত্যু ঘটে বসতঘর থেকে ২০ মিটার দূরত্বের মধ্যে পুকুর-জলাশয়ে। বাংলাদেশে একাধিক শিশু বিশেষভাবে জোড়া শিশু একই স্থানে একই সঙ্গে পানিতে ডুবে মারা যেতে দেখা যায়। সাধারণত একটি শিশু অন্য শিশুকে পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার সময় বাঁচাতে গিয়ে একসঙ্গে মারা যায়। এতে বোঝা যায়, শিশুকে পানি থেকে নিরাপত্তা কৌশল, বিশেষত নিরাপদ উদ্ধার কৌশল সঠিকভাবে শিক্ষা দেয়া হয় না।
সচেতনতার অভাব, বয়স্কদের দ্বারা শিশু তত্ত্বাবধানের অভাব এবং অবহেলাকে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর প্রধান কারণ হিসেবে গণ্য করা হয়। মানুষ অনেক সময় তার শিশু নিরাপদ মনে করলেও শিশুমৃত্যুর বাস্তবতা ভিন্ন হয়। যেমন বিশ্বাস: আমাদের শিশু পানিতে ডুবে মারা যাবে না। কেননা আমরা অত্যন্ত ভালো পিতা-মাতা, বাস্তবতা: সব পিতা-মাতা তাঁদের শিশু পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার আগে এভাবেই চিন্তা করেন। কেউই ভাবেন না, তার শিশু পানিতে ডুবে মারা যেতে পারে। সঠিক তত্ত্বাবধান ছাড়া কোনো শিশু পানি থেকে নিরাপদ নয়। বিশ্বাস: আমাদের বড় ছেলে-মেয়েরা শিশুটি দেখাশোনা করে। আমাদের আশপাশে অনেক মানুষ রয়েছে। বাস্তবতা: বড় ভাই-বোনের তত্ত্বাবধানে থাকার সময় অনেক শিশু মারা যেতে দেখা যায়। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের অনেক লোকের বসতবাড়িতেও শিশুকে পুকুরের পানিতে ডুবে মারা যেতে দেখা যায়।
মনে রাখবেন, আপনি আপনার শিশুর প্রধান নিরাপত্তাকারী। বিশ্বাস: আমার শিশু নিরাপদ কেননা সে সাঁতার জানে। বাস্তবতা: শিশুরা পানিতে একা বিপদে পড়ে। সাঁতার শেখানোর সময় যে যেভাবে নির্দেশনা অনুযায়ী সাঁতার কাটে একা পানিতে পড়ে সে সেভাবে করে না, বরং পানি খেতে খেতে ডুবে যায়। বিশ্বাস: আমার শিশু সবসময় আমার সঙ্গে বাসায় থাকে। বাস্তবতা: শিশুরা অত্যন্ত দ্রুত এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলে যায়। আপনার সরাসরি চোখের সামনে না থাকলে সে হয়তো পানিতে চলে গেছে। বিশ্বাস: আমার শিশু কোথাও পড়লে আমি জানব। বাস্তবতা: পানিতে ডোবা অত্যন্ত নীরব ঘটনা। শিশুরা পানিতে ডোবার সময় কোনো আওয়াজ বা সাহায্য প্রার্থনা করতে পারে না, ফলে শিশু নীরবে পানিতে ডুবে মারা যায়।
ডব্লিউএইচও (২০১৭) পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু নিবারণে ছয়টি প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করে। যেমন ১. প্রাক-স্কুল বয়সী শিশুকে পানি থেকে নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ, ২. পানিতে গমনপথে বেষ্টনী প্রদান, ৩. সাঁতার শেখানো এবং পানি থেকে নিরাপত্তা কৌশলে প্রশিক্ষণ প্রদান, ৪. বন্যা ও অন্যান্য পানি থেকে সংঘটিত দুর্যোগ থেকে সুরক্ষা, ৫. পানি থেকে শিশুকে নিরাপদে উদ্ধার ও সিপিআর প্রশিক্ষণ প্রদান, ৬. বোট, জাহাজ ও ফেরিতে নিরাপদে যাতায়াতে কার্যকরী বিধি ব্যবস্থা প্রণয়ন এবং প্রতিষ্ঠাকরণ। উল্লিখিত ছয়টি নিবারণ কর্মসূচি বাস্তবায়নে ডব্লিউএইচও চারটি কৌশল প্রণয়নের সুপারিশ করে। যেমন ১. বিভিন্ন সেক্টরের কর্মকা-ে সমন্বিতভাবে পানিতে ডুবে মৃত্যুর কথা বিবেচনা করা, ২. কৌশলগত যোগাযোগের মাধ্যমে জনসচেতনতা বাড়ানো, ৩. তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ এবং গবেষণার মাধ্যমে পানিতে ডুবে মৃত্যু নিবারণে সৃজনশীল কৌশল প্রণয়ন করা এবং ৪. জাতীয় নিরাপত্তা নীতি প্রণয়ন করা। ডব্লিউএইচও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পানিতে ডুবে মৃত্যুহারে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণসহ সাংবাদিক ও গণমাধ্যমের কর্মীদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণের কথা বলেছে।
ডব্লিউএইচও বৈশ্বিক পানিতে ডুবে মৃত্যু পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করছে। ২০২৩ সালের প্রতিবেদনে পানিতে ডুবে মৃত্যুসংশ্লিষ্ট মানবিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতির দিক উল্লেখ করে নিবারণ কৌশল বাস্তবায়নের জন্য জোর দিয়েছে। জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার আমন্ত্রণে ডব্লিউএইচও বিশ্বব্যাপী পানিতে ডুবে মৃত্যু বিষয়ে সমন্বয়কের দায়িত্ব পালনে সম্মত হয়েছে। একই সঙ্গে ২০২৩ সাল থেকে প্রতি বছর ২৫ জুলাই বিশ্ব পানিতে ডুবে মৃত্যু পরিহার দিবস পালনের ঘোষণা দিয়েছে।
ডব্লিউএইচও জনস্বাস্থ্য কর্মসূচির আওতায় পানিতে ডুবে মৃত্যু পরিহার বিষয়ে জনসচেতনতা কার্যক্রম চালিয়ে যাবে। ২০২৩ সালের পানিতে ডুবে মৃত্যু নিবারণ দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘যে কেউই পানিতে ডুবে যেতে পারে, কারো ডুবে যাওয়াই কাম্য নয়।’
প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জনস্বাস্থ্য ঝুঁকিসংশ্লিষ্ট মৃত্যু মোকাবেলায় দেশব্যাপী বিভিন্ন প্রস্তুতি ও নিবারণমূলক কার্যক্রম প্রাতিষ্ঠানিকভাবে থাকলেও পানিতে ডুবে মৃত্যু বিষয়ে কার্যক্রম অত্যন্ত অপ্রতুল। সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ, বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি) ২০০৬ ও ২০১৩ সময়ে রায়গঞ্জ, শেরপুর ও মনোহরদী উপজেলায় পাইলট প্রকল্প বাস্তবায়ন করে কমিউনিটি ডে কেয়ার সেন্টার (আঁচল) ও সাঁতার প্রশিক্ষণকে কম খরচে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু নিবারণের কার্যকরী কৌশল হিসেবে চিহ্নিত করছে। উপর্যুক্ত দুটি নিবারণ কৌশলের সঙ্গে জনসচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা করলে আরো বেশি সুফল পাওয়া সম্ভব। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের পানিতে ডুবে মৃত্যু নিবারণে বাস্তবায়িত আরো একটি প্রকল্পে কোনো এলাকায় একই সঙ্গে বেষ্টনীযুক্ত খেলাঘর এবং শিশু পরিচর্যা কেন্দ্র বাস্তবায়ন করলে শিশুমৃত্যু নিবারণে ভূমিকা রাখার প্রমাণ পাওয়া যায়। বাংলাদেশ সরকার ২০১১ সালের স্বাস্থ্যনীতিতে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুকেও একটি জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে। শিশু নিরাপত্তায় পাইলট প্রকল্পে পানিতে ডুবে মৃত্যুও বিবেচনা করলেও সরকার কর্তৃক বাস্তবায়িত প্রকল্প এখনো সীমিত।
ডিজাস্টার অ্যাকশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু নিবারণে বৈজ্ঞানিক গবেষণা, জনসচেতনতা ও মানুষের সক্ষমতা বৃদ্ধি, সাঁতার প্রশিক্ষণ ও জলাধার থেকে সুরক্ষা কৌশল শেখানো, অনিরাপদ জলাধারে বেষ্টনী প্রদান এবং কমিউনিটি ডে কেয়ার স্থাপনে কাজ করছে। অর্থ সংকট, বাস্তবায়নের সক্ষমতার অভাব এবং অন্যান্য সামাজিক-সাংস্কৃতিক কারণে ডব্লিউএইচও কর্তৃক প্রদানকৃত নিবারণ কৌশলকে দেশব্যাপী বাস্তবায়নে সময়ের প্রয়োজন হতে পারে। এমতাবস্থায় ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রমের মাধ্যমে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু নিবারণে ভূমিকা পালন করা যেতে পারে। সমাজের একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি হিসেবে আমরা সবাই শিশুমৃত্যু নিবারণে ভূমিকা পালন করতে পারি। যেমন ১. শিক্ষা ঘর থেকে শুরু হয়, পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর বিষয়টি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে শেয়ার করা, ২. বাড়িতে শিশু পানি থেকে নিরাপদ কিনা পর্যবেক্ষণ করা, ৩. পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর ভয়াবহতা পরিবার, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীর সঙ্গে আলাপ করা, ৪. বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনার আড্ডায় অন্য বিষয়ের সঙ্গে এ বিষয় উপস্থাপন করা, ৫. প্রতিবেশীদের শিশুরা নিরাপদ কিনা পর্যবেক্ষণ করা, ৬. উঠান বৈঠকের ব্যবস্থা করা, ৭. জলাধারের পাশে বেষ্টনী প্রদানের ব্যবস্থা করা, ৮. নিজে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করা এবং অন্যকেও উৎসাহিত করা, ৯. আর্থিক সক্ষমতা থাকলে দরিদ্র পরিবারকে বেষ্টনীযুক্ত খেলাঘর প্রদান, ১০. শিশুদের সাঁতার শেখানোর ব্যবস্থা করা, ১১. ইউটিউব ও স্বীকৃত প্রশিক্ষণকারীর কাছ থেকে সিপিআর প্রশিক্ষণ, ১২. নিজ নিজ এলাকায় যুবকদের সমন্বয়ে ক্যা¤েপইন দল গঠন, ১৩. জাতীয় জনসচেতনতা ক্যা¤েপইনে অংশগ্রহণ, ১৪. এলাকায় কমিউনিটি ডে কেয়ারের সম্ভাব্যতা যাচাইকরণ ও বাস্তবায়নকরণ।
পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু নিবারণে সরকারি ছাড়াও এনজিও, কমিউনিটি অর্গানাইজেশন ও বেসরকারি খাতের কার্যক্রম এখনো সীমিত। পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু নিবারণ কৌশল বাস্তবায়নে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার পাশাপাশি সমাজের সর্বস্তরের জনগণের অংশগ্রহণ ও অবদান রাখা জরুরি।
[ড. মো. ইদ্রিস আলম: অধ্যাপক, ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়]

 

 

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com