গত ২৫ জুলাই ২০২৩ তারিখের দৈনিক সুনামকণ্ঠের পাতায় ছাপানো কয়েকটি সংবাদের শিরোনাম হাজির করছি : ১. ‘মহিলা মাদ্রসায় ছাত্রীদের যৌন হয়রানির আভিযোগ’, ২. ‘শান্তিগঞ্জে কিশোরীর বস্তাবন্দি লাশ \ অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে মামলা দায়ের’ এবং ৩. ‘পরীমনির মামলার
বিচার হবে ক্যামেরা ট্রায়ালে’। এই সমাজে নারীর অবস্থান কতোটা নি¤œস্তরপর্যায়ে গিয়ে থিতু হয়েছে এই তিনটি সংবাদের মর্মোদ্ধার করা গেলে সেটা সহজেই অনুমেয়।
নারীর উপর সহিংসতা কতটুকু বেড়েছে কিংবা কমেছে, সেটা বলা খুবই শক্ত ব্যাপার তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এর জন্য যথাযথ সমীক্ষা ও পরিসংখ্যান সম্পন্ন করা সর্বাগ্রে জরুরি। হয়তো তেমন সমীক্ষা ও পরিসংখ্যান অনুসন্ধানে দুষ্প্রাপ্য নয়। কিন্তু সমাজপরিসরের সর্বত্র চলমান নরীনির্যাতনের উপর করা তেমন কোনও সমীক্ষা বা পরিসংখ্যান উপস্থিত মুহূর্তে আপাতত হাতের কাছে নেই। তার বদলে গত ২৫ জুলাই ২০২৩ তারিখের দৈনিক সুনামকণ্ঠের পাতায় ছাপানো কয়েকটি সংবাদ হাজির করেছি। সে-সংবাদগুলো অনায়াসে প্রতিপন্ন করে যে, দেশে নারী নির্যাতন কেবল চলমান নেই, প্রতিহত করা হয় না বা প্রতিহত করা যায় না বলে সেটা অপ্রতিহতও বটে। এই অপ্রতিহতার ভেতরে বর্তমান সমাজসংস্থিতির বিস্তারজুড়ে প্রতিকারহীনতার একটি সামাজিক-রাজনীতিক পরিপ্রেক্ষিতকেও প্রত্যক্ষ করা যায়, যেটা বহুলাংশে নির্বিচারিতার সংস্কৃতিকে প্রশ্রয় দেয় এবং কার্যক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করে। রাজনীতিটা নারীর বিরুদ্ধে পুরুষের রাজনীতি। যেমন “মহিলা মাদ্রসায় ছাত্রীদের যৌন হয়রানির আভিযোগ’ শীর্ষক প্রতিবেদেনের শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে, ‘দিরাই পৌর শহরের একটি মহিলা মাদ্রাসায় মুহতামিমের (অধ্যক্ষ) বিরুদ্ধে ছাত্রীদের যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠেছে। এতদিন মুহতামিমের একটি ঘনিষ্ঠ প্রভাবশালী মহলের দ্বারা বিষয়টি ধামাচাপা দিয়ে রাখলেও একজন ছাত্রীর অভিভাবক রবিবার বিকেলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন। তবে এখনো বিষয়টি সালিশের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করতে নানা চেষ্টা চলছে বলে জানা গেছে।” এই উল্লেখ সমাজের অভ্যন্তরে প্রতিষ্ঠিত ও সচল থাকা নারী নির্যাতনের প্রতিকারহীনতার চিত্রটিকেই তোলে ধরছে, যা সালিশ বসানোর প্রচেষ্টা সফল করে তোলে প্রকারান্তরে ধর্ষণকে জায়েজ করে নিতে তৎপরতার নামান্তর। যেখানে ইসলামী আইন অনুসারে মুহতামিকে (যদি তিনি বিবাহিত হন এবং তার যৌনকার্যক্রম যিনা পর্যন্ত প্রশস্ত হয় তবে) কোমর পর্যন্ত মাটিতে পোঁতে পাথর ছোঁড়ে মৃত্যুদ- কার্যকর করার বিধান আছে। পরিতাপের বিষয় তা না করে সালিশ করার তৎপরতা চালানো হচ্ছে, যা ইসলাম সম্মত নয়। পরবর্তী দুইটি (‘শান্তিগঞ্জে কিশোরীর বস্তাবন্দি লাশ \ অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে মামলা দায়ের’ ও ‘পরীমনির মামলার বিচার হবে ক্যামেরা ট্রায়ালে’ শীর্ষক) প্রতিবেদন সমাজের পুরুষ প্রতিনিধি কর্তৃক নারীর প্রতিপক্ষে অবস্থান নিয়ে নির্বিচার ও বিবেকহীন আচরণচর্চায় পুরুষ পরম্পরায় অভ্যস্ততার প্রমাণ দাখিল করছে। মুক্তবাজার অর্থনীতির অবাধ বাণিজ্যের যুগে সমাজ যৌক্তিক ও অধিকতর স্বাধীন মুক্তজীবনের দিকে অগ্রসর হতে পারতো। অর্থাৎ অন্যের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও স্বাধীনতাকে রক্ষায় বদ্ধপরিকর হয়ে যতœবান হতে পারতো। কিন্তু সেটা হয় নি। বরং পুরুষতান্ত্রিকতার ফাঁদে পড়ে সমাজ অধিকতর ধর্ষণ প্রবণতার দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
এমনটা চলতে পারে না। পরীমণির উপর শ্লিলতাহানিকর আক্রমণ, মাদ্রাসায় ছাত্রীর উপর যৌন হয়রানি ও কিশোরীর বস্তাবন্দি লাশ প্রমাণ করে আধুনিককালে এসেও আমাদের সমাজটি সভ্য হতে পারেনি। অর্থাৎ কোথাও একটি বস্তাবন্দি কিশোরীর লাশ মানেই সমাজটা আস্ত একটা অসভ্য সমাজ। এটিকে সভ্য করে তোলতে হবে। সে জন্য কেবল প্রশাসনিক প্রচেষ্টাই যথেষ্ট নয়, আরও অনেক কীছুই করতে হবে। তবু বলি, প্রশাসনিক তৎপরতাÑ বিশেষ করে নারী নির্যাতনের প্রতিকার করার কর্মতৎপরতাÑ এমনভাবে বাড়ানো হোক যাতে নারী নির্যাতনেরÑ যতটুকু হওয়া দরকার ততটুকুÑ প্রতিকার হয় এবং নারীনির্যাতনের বিরুদ্ধে মানুষ সচেতন হয়ে উঠে। অন্যথায় সমাজ দিনে দিনে আরও অসভ্য হয়ে উঠবে, পথেঘাটে কিশোরীর বস্তাবন্দি আরও লাশ পাওয়া যাবে অধিক সংখ্যায়। অবশ্যই ভুলে গেলে চলবে না যেÑ যে-সমাজ নারীকে মূল্য দিতে পারে না, নারীর
মর্যাদা যে-সমাজে প্রতিষ্ঠিত নয়Ñ সে-সমাজ অগ্রসর ও আধুনিক সমাজ কীছুতেই হতে পারে না, সে-সমাজে মানুষ যতই উঁচু দালানে বাস করুক আর মোবাইল হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়াক।