পত্রিকার পাতায় যাঁরাই ঘটনাটির খবর পড়েছেন, তাঁরাই বিস্ময়ে হা হয়ে গেছেন- এটা আমার বিশ্বাস। মাত্র একটি কাঁঠালের নিলামকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট কলহ থেকে সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছে চারজন। ১১ জুলাইয়ের প্রায় সব দৈনিকেই খবরটি বিশেষ গুরুত্বসহ প্রকাশিত হয়েছে। ঘটনা ঘটেছে সুনামগঞ্জ জেলার শান্তিগঞ্জ উপজেলার জয়কলস ইউনিয়নের হাসনাবাদ গ্রামে। মর্মান্তিক ওই হত্যাকা- ১০ জুলাই ঘটলেও এর সূত্রপাত হয়েছিল ৭ জুলাই শুক্রবার। ওই দিন হাসনাবাদ গ্রামের মসজিদে এক ব্যক্তি একটি কাঁঠাল দান করেন। কাঁঠাল তোলা হয় নিলামে। উদ্দেশ্য কাঁঠাল বিক্রির
টাকা মসজিদের ফান্ডে জমা হবে। নিলামে কাঁঠালটির দাম ওঠে তিন শ টাকা। কিন্তু নিলামের সময় এক পক্ষের লোকজন দাবি করে তারা আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে না। এ নিয়ে দুই পক্ষের তর্কাতর্কি হয়। পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে, হাসনাবাদ গ্রামে আগে থেকেই ‘সরাই মোড়ল গোষ্ঠী’ আর ‘মালদার গোষ্ঠী’ নামে দুটি পক্ষ ছিল। জমিজমার আধিপত্য বিস্তার নিয়ে এই দুই গোষ্ঠীর মধ্যে বিবাদ-বিসংবাদ লেগেই থাকে। তো শুক্রবারের নিলামের সে ঘটনার জের গড়ায় সোমবার পর্যন্ত।
সেদিন দুই গোষ্ঠীর লোকজন দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে একে অপরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ভয়ানক সংঘর্ষে ঘটনাস্থলেই নিহত হয় তিনজন। হিংসা-বিদ্বেষ, অসহিষ্ণুতা এবং জিঘাংসা কতটা ভয়ংকর হলে একটি কাঁঠালের নিলামকে কেন্দ্র করে চারজন মানুষের প্রাণপ্রদীপ নিভে যাওয়ার মতো নৃশংস ঘটনা ঘটতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। এ ধরনের ঘটনা আমাদের দেশের নানা প্রান্তে আকছার ঘটছে। কখনো জমিজিরাত নিয়ে ভাইয়ে ভাইয়ে লিপ্ত হচ্ছে হানাহানিতে। আবার সন্তান ছুরি চালাচ্ছে পিতা বা মাতার গলায়। এক হাত পরিমাণ জায়গার মালিকানা বা দখলস্বত্ব নিয়ে শরিকদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ, মারামারির ঘটনাও এন্তার ঘটে।
তেমনি ঘটনা ঘটেছে রাজশাহীর গোদাগাড়ীর পাকড়ি ইউনিয়নের মুসরাপাড়া ইয়াজপুর গ্রামে। জমি নিয়ে বিরোধের জের ধরে সংঘটিত সংঘর্ষে নিহত হয়েছে তিনজন। সে খবরও একই দিনে প্রকাশিত হয়েছে গণমাধ্যমে। সর্বশেষ খবর হলো সুনামগঞ্জ এবং রাজশাহীর ঘটনায় নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে আটজনে। মামলা হয়েছে উভয় ঘটনায়। হয়তো আটক-গ্রেপ্তারও হবে দোষী-নির্দোষ অনেকে। তবে তুচ্ছ ঘটনায় যারা প্রাণ হারাল, তারা আর ফিরে আসবে না। অথচ সমাজের বিবেকবান মানুষেরা যদি এগিয়ে আসতেন, তাহলে এই মর্মান্তিক ঘটনা এড়ানো অসম্ভব ছিল না।
এ ধরনের ঘটনা গ্রামেই বেশি ঘটে। একটি ঘটনা মনে পড়ছে। ২০০৫ সালের কথা। আমি তখন প্রধানমন্ত্রীর সহকারী প্রেস সচিব। সংগত কারণেই দাপ্তরিক কাজের পাশাপাশি নিজ এলাকার নানা বিষয় নিয়ে কথা বলতে হয়। একদিন এক মুরব্বি এলেন আমার বাসায়। তাঁকে আগে থেকেই চিনতাম। জমির সীমানা নিয়ে বিরোধ বেঁধেছে তারই মামাতো ভাইয়ের সঙ্গে। ভদ্রলোককে আমি দাদা ডাকলেও তাঁর ফুপাতো ভাইয়ের সঙ্গে আমার চাচা-ভাতিজা স¤পর্ক। তাঁরা দুজনই আমাকে ¯েœহ করেন। তো তিনি ঘটনা সবিস্তারে বর্ণনা করে অনুরোধ করলেন এর একটা বিহিত করে দেওয়ার জন্য। ঘটনার বিবরণ শুনে তাঁকে বললাম, দাদা, বিষয়টা আমি মীমাংসা করে দিতে পারি। তবে কথা দিতে হবে এটা নিয়ে এলাকায় কারও সঙ্গে দল পাকাতে পারবেন না। তিনি কথা দিলেন। তারপরও আমি জানতাম দুই পক্ষে কিছু লোক জড়ো হবে। আমি তার প্রতিপক্ষ ভাইটির সঙ্গে কথা বলে ঘটনা শুনলাম। বুঝতে পারলাম জায়গার পরিমাণের চেয়ে তাঁদের ইগো বা জেদের পরিমাণ অনেক বেশি। ভেবে দেখলাম, এই জেদের তুষের আগুনে যদি কেউ ঘি ঢেলে দেয়, তাহলে নিমেষে তা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠতে পারে। আমি ফুপাতো ভাইকে বললাম, চাচা, আল্লাহ তো আপনাকে কম দেননি। তা ছাড়া আপনার ওই ভাই তো তেমন লেখাপড়া জানে না। সামাজিক জ্ঞানও তার আপনার চেয়ে কম। আপনি একটু বেশি ছাড় দিন। বিষয়টির সুষ্ঠু সমাধান হয়ে যাক।
সিদ্ধান্ত হলো পরের শুক্রবার সীমানা চিহ্নিত করা হবে। নির্ধারিত দিনে গিয়ে দেখি এলাহি কা-! দুই পক্ষেই খানাপিনার আয়োজন হয়েছে। লোকজনের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। দেখে বুঝতে পারলাম, বিবাদরত দুই ভাই জমি কম পেলে তাঁদের কোনো লাভ-লোকসান নেই। তাঁদের লাভ পেট পুরে একবেলা খাওয়া আর হাতে কিছু নগদ নারায়ণ পাওয়া। আমি চাচাকে ফোন করে বললাম, আমি এসেছি। দাদাও আছেন। আপনিও আসেন। খুঁটি গাড়ি। চাচা বললেন, আমার আসার দরকার নাই। আপনি আপনার বিবেচনামতো ফয়সালা করে দেন। আমি কয়েকজনকে নিয়ে দুজনের জমির মাঝামাঝি জায়গায় চাচার ভাগ থেকে এক হাত জমি বেশি নিয়ে খুঁটি গাড়ার সিদ্ধান্ত দিলাম। দাদাও খুশি। সহজেই একটি জটিল সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। অনেকেই সন্তোষ প্রকাশ করলেন, কেউ কেউ মনে মনে নাখোশও হলেন। বিষয়টি নিয়ে সালিস-দরবার, মামলা-মোকদ্দমা হলে তাঁদের কারও কারও টু পাইস কামানোর মওকা সৃষ্টি হতো।
আমাদের গ্রামাঞ্চলে দুই পক্ষের মধ্যে বিবাদ লাগিয়ে ফায়দা লুটে নেওয়ার মানুষের সংখ্যা কম নয়। একটি গল্পের কথা মনে পড়ছে। ক্লাস সিক্স বা সেভেনের দ্রুতপঠন বইয়ে পড়েছিলাম। গল্পটার নাম ছিল ‘মামলার ফল’। এক গ্রামে সৈয়দ আলী ও মেহের আলী নামে দুই বন্ধু ছিল, যারা পরস্পর প্রতিবেশীও। তাদের বন্ধুত্ব কারও কারও ভালো লাগছিল না। গ্রামের মাতবর একদিন সৈয়দ আলীকে বললেন, মেহের আলীর আমগাছের ডালটি যে আপনার উঠোনে এসে পড়েছে, তাতে আপনার ক্ষতি হচ্ছে না? কেটে দেন না কেন? মেহের আলী ভাবল, নিকট বন্ধুর গাছের ডাল কাটব তার আর পারমিশনের দরকার কী? সে ডালটি কেটে ফেলল। অমনি মাতবর গিয়ে সৈয়দ আলীকে বলল, যত বড় বন্ধুই হোক, আপনার পারমিশন না নিয়ে গাছের ডাল কাটা ঠিক হয়নি। আপনি মামলা করেন। সৈয়দ আলী থানায় মামলা করে দিল। পুলিশ এসে মেহের আলীর উঠোনে গাছের কাটা ডাল পেল। ব্যস, মেহের আলীর হাজত বাস হয়ে গেল। কয়েক দিন পরে মেহের আলীর একটি মুরগি সৈয়দ আলীর বাড়ির আঙিনায় গিয়ে আর ফেরত এল না। মেহের আলী মুরগি গুমের মামলা করে দিল বন্ধুর নামে। এভাবে দুই বন্ধু মামলায় জড়িয়ে পড়ল। আর মামলার খরচ জোগানোর জন্য দুই বন্ধু তাদের জমিজমা বিক্রি করতে লাগল মাতবরের কাছে। কয়েক বছর পরে যখন মামলার রায় বেরোল, দেখা গেল মুরগি হত্যার অপরাধে সৈয়দ আলীর জরিমানা হয়েছে দশ টাকা। আর গাছের ডাল কাটার অপরাধে মেহের আলীর জরিমানা হয়েছে পাঁচ টাকা। আদালত থেকে বাড়ি ফিরে দুই বন্ধু লাভ-লোকসান হিসাব কষতে বসে দেখল, কেবল বসতভিটা ছাড়া তাদের সব জমিজমাই চলে গেছে মাতবরের কবজায়।
১৯৭৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত খান আতা পরিচালিত ‘সুজন সখী’ চলচ্চিত্রে নীলুফার ইয়াসমীনের কণ্ঠে একটি গান আছে- ‘আগুন জ্বলে রে নেভানোর মানুষ নাই/ কাইজার বেলায় আছে মানুষ মিলের বেলায় নাই…’। আমাদের সমাজের সেই বাস্তবতা চার যুগ পরেও খুব একটা পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয় না।
মহিউদ্দিন খান মোহন, সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক