বিশেষ প্রতিনিধি ::
সুনামগঞ্জে বেসরকারি উদ্যোগে টাঙ্গুয়ার হাওরে ঘুরে বেড়ানোর জন্য তৈরি হয়েছে শতাধিক দৃষ্টিন্দন হাউসবোট। এর বেশিরভাগই বাইরের জেলার উদ্যোক্তারা নির্মাণ করেছেন। স্থানীয়ভাবেও কিছু উদ্যোক্তা তৈরি করেছেন এই জলযান। আরামে জলপথে সপরিবারে ঘুরে বেড়ানোর জন্য দিনদিন আকর্ষণীয় নামের বাহনটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠছে। তবে ভাড়া অত্যধিক থাকার কারণে এই হাউসবোট ভাড়া নিতে পারেননা ভ্রমণপ্রিয় সাধারণ মানুষ। তারা স্থানীয় ছোট ছোট ইঞ্জিন চালিত নৌকাতেই পর্যটন করেন। তাছাড়া সরকারও এসব হাউসবোট থেকে কোন রাজস্ব পাচ্ছেনা। রাজস্বের আওতায় নিয়ে আসতে রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া চালু, হাউসবোট পরিচালনায় গাইডলাইনসহ নানা বিষয় যুক্ত করার দাবি ওঠেছে। তবে পরিবেশবিদরা ইকোটুরিজমের দাবি জানিয়েছেন। একই সঙ্গে পর্যটকবাহী নৌকাতে প্লাস্টিকের বর্জ্য যাতে ব্যবহার না হয় এবং পর্যটকরা যাতে অবাধে হাওরে প্লাস্টিকের বর্জ্য ফেলে হাওরের প্রকৃতির বিনাশ না করে হাউসবোটগুলোকে নজরদারি ও জবাবদিহিতার আওতায় আনার দাবি ওঠেছে।
সুনামগঞ্জের তাহিরপুর, মধ্যনগর উপজেলা নিয়ে বিস্তৃত আন্তর্জাতিক রামসার সাইট খ্যাত বিশ্ব ঐতিহ্য টাঙ্গুয়ার হাওর। জীববৈচিত্র্যের আধার এই হাওরে রয়েছে দেশের বৃহৎ হিজল করচের বাগ। পর্যটকদের কথা চিন্তা করে নির্মিত হয়েছে সুউচ্চ টাওয়ার। টাঙ্গুয়ার হাওরের নীলাভ জলে অবগাহন করেন পর্যটকরা। শীত ও বর্ষায় ভিন্ন রকম সৌন্দর্য্য নিয়ে পর্যটক চোখে ধরা দেয় হাওরটি। তবে শীতে লাখো পরিযায়ী পাখির ডানার ওড়ালে মুখর থাকে মৌন হাওর।
মেঘালয়ের পাদদেশে অবস্থিত এই হাওরটিকে ঘিরেই মূলত গত দুই দশক ধরে টাঙ্গুয়ার হাওরে পর্যটন শুরু হয়েছে। দেশ বিদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ছুটে আসছেন পর্যটকরা। তবে গত তিন-চার বছর ধরে পর্যটনে ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে হাউস বোটগুলো। কাঠের তৈরি শীতাতপ ও বিদ্যুতায়িত হাউসবোটগুলো ইন্টেরিয়র ও স্থপতি দিয়েও ডিজাইন করানো হয়েছে। চার-ছয় কক্ষের প্রতিটি হাউসবোটের কক্ষ অত্যন্ত সুসজ্জিত। রয়েছে আকর্ষণীয় চেয়ার, সোফা ও উন্নত বাথরুম। আধুনিক সুযোগ সুবিধা থাকায় আরামে রাতও কাটানো যায় প্রতিটি কক্ষে। যে কারণে সৌখিন পর্যটকরা সপরিবারে এই বাহনটিই ঘুরতে বেছে নেন। তাদের কথা বিবেচনা করেই উদ্যোক্তারা ত্রিস্টার মানের হাউসবোটে আধুনিক সুযোগ সুবিধার সমন্বয়ে সজ্জিত করেছে।
উদ্যোক্তাদের বেশিরভাগ বাইরের জেলার হলেও প্রতিটি হাউসবোটে যারা কাজ করেন তারা সবাই স্থানীয়। তাছাড়া হাওরের খাবার হিসেবে স্থানীয় চাল, মাছ ও হাঁসের মাংস থাকে আপ্যায়নে। ভ্রমণ ভাড়া প্যাকেজের সঙ্গেই যুক্ত থাকে এসব খাবার। প্রতিটি হাউসবোটে দুইদিন ও এক রাত থাকা খাওয়াসহ ভাড়া প্রায় ১ লাখ থেকে দেড় লক্ষ টাকা খরচ হয়। তবে স্থানীয় বোটগুলোতে ৫-২০ হাজার টাকার মধ্যে ঘোরাঘুরি করা যায়।
তাহিরপুর উপজেলার গণমাধ্যম কর্মী রাজন চন্দ বলেন, টাঙ্গুয়ার হাওরের পর্যটনকে ঘিরে গত কয়েক বছর ধরে হাউসবোট কালচার শুরু হয়েছে। দেশের ত্রি-স্টার হোটেল-মোটেলের কাছাকাছি এর মান। তাই অনেকেই সপরিবারে ভ্রমণ করতে হাউসবোটগুলো বেছে নেন। বাইরের উদ্যোক্তারাও পর্যটকবান্ধব অবকাঠামোর মাধ্যমে প্রতিটি হাউসবোট সুসজ্জিত করেছেন। থাকা খাওয়ার মানও ভালো। স্থানীয়দেরও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তবে ভাড়া বেশি নেওয়া হচ্ছে এবং এজন্য সরকারও কোনও রাজস্ব পাচ্ছেনা। এগুলোকে রাজস্বের আওতায় এনে একটি গাইডলাইনের মাধ্যমে এগুলো পরিচালিত হলে পর্যটকরাও সুরক্ষিত থাকবেন। তিনি বলেন, টাঙ্গুয়ার হাওরের পর্যটনকে কেন্দ্র করেই এখানকার অর্থনীতি বিকশিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তাই পর্যটনকে গুরুত্ব দিয়ে প্রশাসনকে ভাবতে হবে।
টাঙ্গুয়ার হাওরের শ্রীপুর গ্রামের হাইসবোট পানসীর মালিক মাইজুদ্দিন বলেন, সব মিলিয়ে প্রায় দেড় শতাধিক হাউসবোট আছে। আমাদের এলাকার উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি বাইরের জেলার উদ্যোক্তারাও হাউসবোট তৈরি করেছেন। একটি হাউসবোটে ৫-৬০ লক্ষ টাকার বেশি খরচ হয়। এই টাকা ওঠতে সময় লাগে। তবে দিনদিন পর্যটনপ্রিয় সৌখিন মানুষ সপরিবারে ঘুরে বেড়াতে হাউসবোটকেই বেছে নিচ্ছেন। তাই তাদের কথা বিবেচনা করে হাউসবোটগুলো সুসজ্জিত করা হয়।
তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুপ্রভাত চাকমা বলেন, গত বছর প্রায় ১৩৫টি নৌকা-হাউসবোট রেজিস্ট্রেশন করা হয়েছিল। এবার হাউসবোটের সংখ্যা আরো বেড়েছে। হাউসবোটের জন্য জেলা প্রশাসন উন্মুক্ত মতবিনিময় সভা করে একটি গাইডলাইন তৈরিসহ রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়ার কথা চিন্তা করছে। কিভাবে হাওরে পর্যটকবাহী হাউসবোট পরিচালিত হবে সেই গাইডলাইন তৈরি করা হচ্ছে। তবে পর্যটন খাতকে গুরুত্ব দিয়ে ও উৎসাহ জুগিয়ে এটি করা হবে।
তাহিরপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান করুণাসিন্ধু চৌধুরী বাবুল বলেন, ইকোটুরিজম ছাড়া হাওরের প্রাণ ও প্রকৃতি বাঁচানো যাবেনা। হাউসবোট বা হাওরে নৌযান পরিচালনার সুষ্ঠু নীতিমালা নেই। পর্যটকবাহী জলযান থেকে অবাধে প্লাস্টিকের বর্জ্য ফেলা হচ্ছে হাওরে। এতে বিরাট ক্ষতি হচ্ছে। এগুলো মাথায় রেখেই আমরা ইকোটুরিজম গড়ে তোলার দাবি জানিয়েছি।
জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মকসুদ চৌধুরী বলেন, হাওরে হাসউবোট কালচার জনপ্রিয় হচ্ছে। পর্যটকদের পছন্দের বাহন এগুলো। কিছুদিন আগে এ নিয়ে মতবিনিময় সভা হয়েছে। সেখানে নানা প্রস্তাব এসেছে। সেগুলো মাথায় রেখে এবং পর্যটনকে উৎসাহিত করতে প্রচলিত আইন-কানুনের আলোকে একটি গাইডলাইন তৈরি করার কাজ চলছে। তবে রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়ায় জটিলতা থাকায় এসব পরে করা হবে।