সবকিছুই আপন গতিতে এগিয়ে চলেছে। প্রতিবাদহীন সমাজে মানুষের ব্যক্তিগত হাহাকারকে উপেক্ষা করে সুসংগঠিত সিন্ডিকেট তার কাজটি করেই চলেছে। কিছুই থামছে না। সরকারের শীর্ষ পর্যায় পর্যন্ত বিষয়টি জানা। তাঁরাও কিছু করতে পারছেন না। উল্টো শর্ষের ভূতের এই লুণ্ঠনে বিপুল পরিমাণ অর্থ কামিয়ে নিচ্ছে ওই সিন্ডিকেট।
দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী বাংলাদেশ ব্যাংকও অর্থ পাচারের অবাধ ছিদ্রটি বন্ধ করতে পারছে না। একদিকে কাঁচা মরিচের দাম বাড়ছে, অন্যদিকে বাসভাড়া বলগাহীন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের বেতনও অসহনীয়ভাবে বেড়ে চলেছে। রাষ্ট্রের কত কর্মকর্তা টাই-স্যুট-পাঞ্জাবি পরে কোটি টাকার গাড়িতে নির্বিঘেœ ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য প্রয়োজন হয় কিছু আইনের। এই আইনের রক্ষকদের মধ্যে থাকে বিভিন্ন সংস্থা। সংস্থাগুলোর মধ্যে থাকে প্রবল জবাবদিহি, কখনো তা প্রশাসনের ভেতরে, কখনো বা প্রকাশ্যে। এই জবাবদিহির বিষয়টির কোনো চেষ্টাই এ দেশে হয়নি; বরং নানাভাবে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার ফাঁকফোকর দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে। শুধু ঢাকা শহর নয়, বিভাগীয় শহর থেকে শুরু করে জেলা শহরে যে পরিমাণ গাড়ির শোরুম দেখা যায় তাতে অবাক লাগে, এই দেশটা কোথায়? এত বিত্তবান লোক কোথা থেকে এল?
এর আগে বহুবার বলেছি, বাংলাদেশের দারিদ্র্যের কারণ আসলেই বিত্তবান মানুষ। দেশটা সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা বহু প্রাচীনকাল থেকে। যাকে বাংলার সুবেদার ইসলাম খাঁর সেনাপতি মির্জা নাথান বলেছিলেন, ‘বাংলা হচ্ছে অচেনা চির বসন্তের দেশ।’ ছোট্ট ৫৬ হাজার বর্গমাইলের মধ্যে পাহাড়, সমুদ্র, সমতলভূমি, হাওর, এমনকি মাটির নিচে খনিজস¤পদ সবই আছে।
একসময় মুঘল স¤্রাট আওরঙ্গজেব শুধু পূর্ব বাংলা থেকে এক কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করতেন। পরবর্তীকালে ইংরেজরা এ দেশটাকে লুণ্ঠন করে ছোবড়া বানিয়ে দিয়েছে, কিন্তু উর্বরতার কারণে শস্য স¤পদ আহরণ করে এ অঞ্চলের মানুষ বেঁচে আছে। ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর পাকিস্তানিরাও একই পথ অনুসরণ করে। এসবের বিরুদ্ধে তীব্র গণ-আন্দোলন ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পরে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ হয়েছে পৃথিবীর মানচিত্রে। এবারের শাসকগোষ্ঠী এবং স¤পদের রক্ষক বিদেশিরা নয়, স্বদেশের।
এর পরের ইতিহাস সবারই জানা। কালক্রমে এটি একটি উচ্চবিত্তের দেশে পরিণত হচ্ছে। সরকারের জমিজমা আমলা, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীরা ভোগ করেন। বিদেশি ঋণ দ্বারা প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে প্রচুর স¤পদ লুণ্ঠন করে বিদেশে পাচার করা হচ্ছে। এ দেশে যেহেতু আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা যায়নি এবং নানা ধরনের সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে, কাজেই সবকিছুর খেসারত দিতে হয় জনগণকে। রাজধানী তো বটেই, টাঙ্গাইলের মতো একটি জেলা শহরে রাস্তার দুই ধারে অসংখ্য আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের দোকান গড়ে উঠেছে। সেখানকার ভোক্তা কারা? নিশ্চয়ই বিশাল এক বিত্তবান শ্রেণি গড়ে উঠেছে। শহরগুলোতে কোনো ফাঁকা জায়গা নেই, জলাশয় নেই, এক ইঞ্চি জায়গাও রাখা হচ্ছে না। সেখানেই গড়ে উঠছে বড়-ছোট দোকান। কখনো কখনো মনে হয়, বাংলাদেশ একটা দোকানের দেশ। দোকানের দেশ হলেই তো হয় না, সেই সঙ্গে দোকান সংস্কৃতিও গড়ে ওঠে।
একশ্রেণির অর্থনীতিবিদ দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করেছেন, নষ্ট করেছেন; যাঁদের অর্থনীতিবিদ না বলে ধনবিজ্ঞানী বলা চলে। এই ধনবিজ্ঞানীরা বাজার অর্থনীতিকে গড়ে তুলেছেন। তাঁরা সত্যিকার অর্থে সা¤্রাজ্যবাদের আধুনিক অপকৌশলকে বাজার অর্থনীতির মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। এই ঢুকিয়ে দেওয়ার ফলে একটা বিকৃত ভোক্তাসমাজ গড়ে উঠছে। এর উৎস সন্ধান করলে দেখা যাবে, শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যেই একধরনের ভোগ্যপণ্যের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। গণমাধ্যমে ভোগ্যপণ্যের অবারিত প্রচার শিশু থেকে শুরু করে তরুণ পর্যন্ত একটা নতুন মানসলোক গড়ে তুলেছে। সব ন্যায়-অন্যায় এবং সত্য-মিথ্যাকে বিভ্রান্ত করে এক অদ্ভুত মূল্যবোধ গড়ে তোলে। যে মূল্যবোধের নিয়ন্তা হলো অর্থ-টাকা। টাকার শক্তিকে যেভাবে শেখানো হয়, সেখানে টাকার মূল্যকে বোঝানো হয় না। একটা ধারণা দেওয়া হয়- টাকা দিয়েই সব হয়, টাকা দিয়ে সব কেনা যায়। সম্মান, যশ, প্রতিপত্তি, ক্ষমতা – সব কেনা যায়। কিন্তু যা কেনা যায় না, যা মানুষের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তা শেখানো হয় না। ফলে টাকার এই শক্তিকে মহাশক্তি বলে মনে করা হয়। সেখানেই সবচেয়ে বড় সংকট!
এই টাকা মানুষকে অমানবিক প্রাণী হিসেবে গড়ে তুলছে। সমাজে সুখী এবং নিরাপদ মানুষের প্রবল অভাব দেখা দিয়েছে। আজকে মানুষের জীবনধারণের জন্য যে ন্যূনতম প্রয়োজনগুলো, তার ক্ষেত্রে তীব্র সংকট তৈরি হয়েছে। যে সমাজের অধিকাংশ মানুষ মধ্যবিত্ত, নি¤œবিত্ত এবং একেবারেই ছিন্নমূল, তাদের জন্য কোনো পথ নেই। অথচ রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে সব শ্রেণির মানুষের জীবনযাপনকে স্বস্তিদায়ক করা।
কাঁচা মরিচের দাম যদি এক হাজার টাকা হয়ে যায় এবং কদিন পরে সীমান্তে কাঁচা মরিচের ট্রাক আসার সংবাদে যদি তা তিন শ টাকায় নেমে আসে, তাহলে এ দায় কার? স¤পূর্ণভাবে চিহ্নিত সিন্ডিকেটের এবং তার সঙ্গে সরকারের একটা যোগসাজশ থাকাটা স্বাভাবিক। ঈদের সময় বাসভাড়া তিন গুণ হয়ে যায়, কখনো কখনো চার গুণ। রাস্তা নিয়ন্ত্রণের জন্য যে পুলিশ বাহিনী আছে, তাদের জনবলের কোনো কমতি নেই। যাত্রীদের ওপর এই নিষ্ঠুর নির্যাতন তারা চেয়ে চেয়ে দেখছে। কোনো ব্যবস্থা নেয় না।
প্রতিদিন খবরের কাগজে আমরা দেখতে পাই সরকারি অফিসের দারোয়ান, পিয়ন, ড্রাইভার কোটিপতি হয়েছেন, পুলিশ বাহিনীর বিরুদ্ধেও নানান সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, ক্রমবর্ধমান হারে এদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বিচারব্যবস্থায় দীর্ঘসূত্রতার ফলে কোর্ট-কাচারিতে প্রচুর টাকা লেনদেন হচ্ছে বটে, কিন্তু সমাধান হচ্ছে না। আবার এ-ও দেখা যাচ্ছে, একটা ছোট পদধারী, সরকারি দলের নেতা হঠাৎ করে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেলেন। তাঁর বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেই। একদিকে সরকারের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো, নি¤œ পর্যায় থেকে একেবারে উচ্চ পর্যায় দুর্নীতিতে ডুবে থাকে। আবার রাজনৈতিক দলে তাঁদের নির্বাচিত প্রতিনিধিসহ তৃণমূল থেকে শীর্ষ পর্যায় পর্যন্ত একই জোয়ারে ভাসছেন।
শিক্ষাব্যবস্থা এই পরিস্থিতিতে একেবারেই ভেঙে পড়েছে। কিছু শিক্ষক স্কুলে যাওয়াটাকে অযথা মনে করেন। যদিও সেখান থেকে মাস শেষে তাঁরা ভালো টাকা পান। তাঁদের নজর আরও বেশি টাকায়। যে টাকা দিয়ে থাকে কোচিং। কোথাও অবশ্য সত্যিকারের লেখাপড়া নেই। অভিভাবকেরা নম্বর বুঝে গেছেন। সন্তান মানুষ হলো কি না, সেদিকে তাঁদের খেয়াল নেই। কাজেই তাঁদের সন্তান ঢুকে যায় একটা ভোক্তা সমাজে, যেখানে টাকাই সব! কালক্রমে সে-ও হয়ে ওঠে মুদ্রারাক্ষস। এতক্ষণ যা বললাম, তার সবই সবার জানা, নতুন একটি কথাও বলিনি। নতুন কথা হচ্ছে, এ অবস্থার পরিবর্তন। পরিবর্তন কোথা থেকে আসবে?
রুচির দুর্ভিক্ষে যখন দেশের শিক্ষিত মানুষেরা হাবুডুবু খান এবং অদ্ভুত সব ভাইরালকে গিলতে থাকেন, তখন পরিবর্তনের পথে সমাজ কী করে আসবে? কিন্তু তার পরেও পরিবর্তনের পথটা তো খুঁজে নিতে হবে। বিত্তের পাহাড়প্রমাণ অসাম্য। শিক্ষা সুযোগের ক্ষেত্রে যে ব্যবধান, সবই আত্মমর্যাদাবোধ স¤পন্ন মানুষ তৈরিতে ব্যর্থ হচ্ছে। শিক্ষাব্যবস্থা যে সৃজনহীন মানুষ তৈরি করছে, তাতে নতুন কোনো কিছু খোঁজার আকাক্সক্ষা ক্ষীণ হয়ে আসছে। প্রতিটি রাজনৈতিক দলে একটি নতুন ভাবনা খোঁজার জন্য কিছু বিশেষজ্ঞ থাকেন।
দুর্ভাগ্যজনক, সরকারি কাঠামোতে কোনো বিশেষজ্ঞের স্থান নেই। আমলা-অধ্যুষিত সরকার কোনো ধরনের নতুন চিন্তাকে গ্রহণ করতে রাজি নয়। এটা তাদের সংস্কৃতিতেই নেই। এই অসহায় পরিস্থিতিতে ব্যাপক সাংস্কৃতিক আন্দোলন প্রয়োজন। যদি সে রকম কোনো আন্দোলন রচনা করতে না পারা যায়, তাহলে সমাজ দ্রুত পচনের দিকে যায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা যে মানবিক রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলাম, সেই স্বপ্ন দ্রুতই দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। যার লক্ষণ ইতিমধ্যেই দেখতে পাচ্ছি।
লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব