1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
  3. [email protected] : wp-needuser : wp-needuser
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ০৭:৫০ পূর্বাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

নদীর দেশে কেন পর্যটন বিকশিত হয় না?

  • আপডেট সময় শুক্রবার, ৯ জুন, ২০২৩

আমীন আল রশীদ ::
আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ভ্রমণ কর বাড়ানো হয়েছে। প্রস্তাব অনুযায়ী দেশের ভেতরে কিংবা বিদেশে যেতে বিমানে উঠলেই বাড়তি ভ্রমণ কর দিতে হবে। অর্থমন্ত্রীর ভাষায়, জনসাধারণের অপ্রয়োজনীয় বিদেশ ভ্রমণ কমিয়ে কৃচ্ছ্রসাধনের অভ্যাস তৈরি ও রাজস্ব জোগানে নতুন খাত সৃষ্টির জন্য এই সিদ্ধান্ত। বোঝাই যাচ্ছে, এর ফলে বিমানে যাত্রীর সংখ্যা কমবে। বিশেষ করে দেশের বাইরে যারা বিমানে যাওয়া-আসা করে অভ্যস্ত। ফলে এর প্রভাব পড়তে পারে দেশের এভিয়েশন খাতে। তবে দেশের ভেতরে আকাশপথ ছাড়া অন্য কোনও উপায়ে চলাচলে কোনও কর দিতে হয় না। হবে না। ফলে যারা বিদেশ যেতে নিরুৎসাহিত হবেন, তারা বরং নিজের দেশটাই ঘুরে দেখতে পারেন।
আমাদের সৌভাগ্য যে পুরো বাংলাদেশটিই দারুণ পর্যটনকেন্দ্র। বিশেষ করে নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদীকে কেন্দ্র করে যে ধরনের পর্যটন বিকশিত হতে পারতো, তা হয়নি। কেন? এই কেন’র উত্তর খোঁজা এবং দেশে নদী পর্যটনের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ খতিয়ে দেখা এই লেখার উদ্দেশ্য।
বাংলাদেশের মানুষের পরিচয় নির্ণয় হয় প্রধানত দুভাবে; ১ বাংলা ভাষা এবং ২. নদী। ১৯৪৭-এ দেশভাগের পরের বছর থেকেই ১৯৫২ সাল পর্যন্ত মাতৃভাষা বাংলার অধিকার প্রতিষ্ঠায় এই ভূখ-ের মানুষ রক্ত দিয়েছিল। সেই ভাষা আন্দোলনের সিঁড়ি বেয়ে ১৯৭১ সালে বিশ্বের মানচিত্রে জন্ম নেয় স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ। ভাষার ওপর দাঁড়িয়ে একটি দেশের জন্মই পৃথিবীর অন্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশকে আলাদা করেছে। একইভাবে বাংলাদেশ পৃথিবীর একমাত্র রাষ্ট্র, যাকে বলা হয় ‘নদীমাতৃক’। অর্থাৎ নদী যে দেশের মা।
সৈয়দ শামসুল হক তাঁর ‘আমার পরিচয়’ কবিতায় লিখেছেন: ‘তেরোশত নদী শুধায় আমাকে কোথা থেকে তুমি এলে।’ অর্থাৎ বাঙালির আত্মপরিচয় তার নদী। যদিও বাংলা ভাষার কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে নদীর প্রসঙ্গ সবচেয়ে বেশি এসেছে প্রকৃতি ও রূপসী বাংলার কবি হিসেবে খ্যাত জীবনানন্দ দাশের কবিতায়- যার জন্ম দখিনের জনপদ বরিশালে। নদীবিধৌত এই জনপদের নদী ও প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যই যে তার ভেতরে কবিত্বের বীজ বপন করেছিল তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
জীবনানন্দ বারবার ফিরে আসতে চেয়েছেন নদীর কাছে। এমনকি মৃত্যুর পরেও ভোরের কাক হয়ে, শঙ্খচিল শালিকের বেশে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে। পৌষের রাত্রিতে শুয়ে থেকেছেন নদীর কিনারে। নদীর জলে খুঁজেছেন নিজের প্রতিকৃতি। নদী তার কাছে সৌন্দর্যের বারতাও নিয়ে আসে। তাই বারবার নদীর গোলাপি ঢেউয়ের কাছে ফিরে আসেন। নদী তার কাছে এক অপার রহস্য বটে। নদীর জলে তিনি শুনতে পান প্রেম ও নক্ষত্রের গান। তিনি গোধূলি নদীর মৌনজলে রূপসীর মতো প্রিয়ার মুখখানা দেখে ধীরে, ধীরে আরও ধীরে শান্তি ঝরতে দেখেন; আকাশ হতে স্বপ্ন ঝরতে দেখেন। তার করুণ চোখও মাঝে মধ্যে পথ ভুলে ভেসে যায় ময়জানি নদীর পাশে। যখন হৃদয়ে তার তাতার বালির মতো তৃষা জেগে ওঠে, তখন নদীর আঁধার জলে ভরে যায় তার বুক। তিনি দেখেন গ্রামবালিকা ¯œান সেরে তার শাড়ি যখন দুপুরের রোদে নদীর তীরে শুকোতে দেয়, তখন তা যেন হলুদ পাতার মতো সরে যায়।
যদিও সেই নদী আজ বিপন্ন। সড়ক উন্নয়নের জোয়ারে সেতু ও কালভার্টের ধাক্কায় বহু নদী এখন মৃতপ্রায়। নৌ যোগাযোগের দিন বোধহয় ফুরিয়ে আসছে। অথচ এই নদীকে কেন্দ্র করেই বদলে যেতে পারে পুরো দক্ষিণবঙ্গের অর্থনীতির চেহারা।
বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার কিংবা বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ যেমন গর্ব করে, তেমনি তার গর্ব করার মতো আরেকটি জিনিস হচ্ছে নদী। শুধু মৎস্যস¤পদের বিশাল আধারই নয়, বরং নদীকেন্দ্রিক পর্যটনেই ঘুরে যেতে পারে দখিনের জনপদের অর্থনীতির চিত্র।
২.
নদী পর্যটনের প্রধান ঝুঁকি ঝড়ের মৌসুমে। এই সময়টুকু বাদ দিয়ে সারা বছরই পর্যটকরা নদী উপভোগ করতে পারেন। আবার প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সামগ্রী সঙ্গে থাকলে সাহসীরা ঝড়ের মৌসুমেও নদীতে ঘুরতে পারেন। নৌকা বা ট্রলার নদীর তীরে বেঁধে রেখে তার ভেতরে কিংবা নদীর তীরে তাঁবু টানিয়ে রাতযাপনও করতে পারেন। অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এরইমধ্যে এই ধরনের পর্যটনের সুযোগ দিচ্ছে।
সাধারণ মানুষের মধ্যে এরকম ধারণা রয়েছে যে, পর্যটন মানেই অবকাঠামো, তারকা হোটেল, রেস্তোরাঁ, বার-ড্যান্স ক্লাব ইত্যাদি। অথচ কোনও ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ না করেই শুধু বাংলাদেশের নদীগুলোই যে পর্যটনের বিরাট উৎস হতে পারে- সেই ভাবনাটি এখন ধীরে ধীরে মানুষ বুঝতে শুরু করেছে।
বাংলাদেশে নদী পর্যটনের কিছু চ্যালেঞ্জও আছে। প্রধান চ্যালেঞ্জ নিরাপত্তা। যারা সাঁতার জানেন না তাদের অনেকেই নদী ভ্রমণে ভয় পান। যদিও বছরের অধিকাংশ সময়ই শান্ত নদীতে নৌডুবির শঙ্কা নেই বললেই চলে। তবে নদীতে নৌকা ট্রলার নিয়ে না ঘুরেও নদী পর্যটন হতে পারে। অর্থাৎ স্থলপথে কোনও নদীর তীরে গিয়ে নদী ও নদীপাড়ের মানুষের জীবন-জীবিকা দেখাও এক ধরনের ভ্রমণ। বরং এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে কমিউনিটি ট্যুরিজমও গড়ে উঠতে পারে। অর্থাৎ নদীপাড়ের মানুষদের বাড়িতে রাতযাপন, তাদের সঙ্গে খাওয়া এবং তার বিনিময়ে ওই পরিবারকে কিছু টাকা দেওয়া যেতে পারে। অর্থাৎ এটি এক ধরনের বাণিজ্যিক আতিথেয়তা। পৃথিবীর অনেক দেশেই এই ধরনের কমিউনিটি ট্যুরিজমের ধারণা আছে। বাংলাদেশেও কেউ কেউ এটা নিয়ে কাজ শুরু করেছেন। এর মধ্য দিয়ে নদীপাড়ের অসচ্ছল মানুষদের নতুন এক ধরনের আয়ের পথও উন্মুক্ত হতে পারে। সেজন্য ওই পরিবারগুলোকে আগ্রহী করে তোলার ক্ষেত্রে সরকারও ভূমিকা নিতে পারে। তবে মোদ্দা কথা পর্যটকরা যেখানে ঘুরবেন, যেখানে থাকবেন, রাতযাপন করবেন এবং খাবেন- সেসব জায়গায় তাদের সঙ্গে অবশ্যই মানবিক ও অতিথির মতো আচরণ করতে হবে। এই ধরনের ট্যুরিজম গড়ে তোলা গেলে, অর্থাৎ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা গেলে বিদেশিরাও বাংলাদেশের কক্সবাজার ও সুন্দরবনের বাইরে শুধু নদী দেখার জন্যও হয়তো আসতে শুরু করবেন।
৩.
নদী পর্যটনের একটা বড় চ্যালেঞ্জ বা সমস্যা হলো মানুষের অসচেতনতা এবং কা-জ্ঞানের অভাব। যেমন, বরিশাল বিভাগের বিখ্যাত একটি জায়গা পেয়ারা বাগান। প্রতি বছর অসংখ্য মানুষে স্থলপথে এবং নৌপথে পেয়ারা বাগান ঘুরতে যান। কিন্তু অনেক সময়ই দেখা যায়, ট্রলারে উচ্চস্বরে অনেকে গান বাজাতে থাকেন, যা আশপাশের মানুষের বিরক্তির কারণ হয়। অনেক সময় তারা ট্রলারে যেসব খাবার নিয়ে যান, তার উচ্ছিষ্ট এমনকি প্লাস্টিকের থালা-বাটি-গ্লাস, চিপস ও বিস্কুটের প্যাকেটও অবলীলায় নদীতে ফেলে দূষণ ঘটান। এসব কাজ বন্ধ করতে একদিকে যেমন পর্যটকদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো দরকার, তেমনি স্থানীয় প্রশাসনেরও উচিত এ বিষয়ে নজরদারি বাড়ানো। অথচ নদী ও নদী তীরবর্তী জনপদের সৌন্দর্য দেখতে গিয়ে কেউ যাতে নদী ও প্রাণ-প্রকৃতির জন্য হুমকি তৈরি না করেন, সে বিষয়ে সচেতন থাকা জরুরি।
বাংলাদেশের মানুষের দ্রুত বড়লোক হতে চাওয়ার মানসিকতা এবং কালচারাল সমস্যাও এখানে পর্যটন বিকাশের ক্ষেত্রে বড় বাধা বলে মনে করা হয়। যেমন, কোথাও পর্যটন সম্ভাবনা তৈরি হলেই সেখানে যেসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে, সেখানে পর্যটকদের কাছ থেকে গলাকাটা দাম নেওয়া, মানুষকে ঠকানো, বিভ্রান্ত করা এবং বিশেষ করে নারীদের লক্ষ্য করে টিজ করা; বিদেশি দেখলে তার পিছু নেওয়া; ছোট পোশাকে কোনও নারীকে দেখলে তার দিকে তাকিয়ে থাকা কিংবা বাজে মন্তব্য করার মতো ঘটনাগুলো গ্রামাঞ্চল ও সমুদ্রসৈকতে পর্যটন বিকশিত হবার ক্ষেত্রে অন্তরায় তৈরি করে।
শুধু স্থানীয় বখাটে কিংবা খারাপ লোকেরাই নয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হাতেও নাজেহাল হওয়া কিংবা বিব্রতকর প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার কথাও শোনা যায়। ফলে অনেকেই ইচ্ছা সত্ত্বেও শুধু নদী দেখা কিংবা নদীর তীরে নৌকা বা ট্রলারে পরিবার-পরিজন নিয়ে রাতযাপনের সাহস পান না। অতএব, নদীকেন্দ্রিক পর্যটন বিকাশের ক্ষেত্রে সরকার এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধি তথা কমিউনিটির মানুষকে আগে সচেতন হতে হবে।
একটা সময় পর্যন্ত যোগাযোগ দুর্বলতা ছিল বাংলাদেশের পর্যটন বিকাশের প্রধান অন্তরায়। কিন্তু গত পাঁচ দশকে দেশের যেসব খাতে উন্নয়ন হয়েছে, সড়ক যোগাযোগ তার অন্যতম। ফলে এখন দেশের যেকোনও প্রান্তের নদী দেখতে চাইলে দেশের যেকোনও প্রান্ত থেকে মানুষেরা সহজেই যেতে পারে (কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া)। তবে দক্ষিণাঞ্চলের নদী দেখতে চাইলে রাজধানী ঢাকা থেকে বিলাসবহুল লঞ্চে যাওয়াই ভালো। কেননা, ঢাকা থেকে বরিশালের যেকোনও জেলায় এই ভ্রমণের পথটুকুই একটি বিরাট আনন্দের। অর্থাৎ এই ধরনের পর্যটন শুরুই হবে ঢাকা থেকে।
৪.
বাংলাদেশের নদীমাতৃক এলাকার যেসব নিজস্ব সংস্কৃতি এখন ইন্টারনেটের কারণে বিলুপ্তির মুখে, নদী পর্যটনকে কেন্দ্র করে সেই স্থানীয় সংস্কৃতিরও পুনর্জাগরণ হতে পারে। বিশেষ করে বিদেশিদের জন্য নদীপাড়ের মানুষের জীবননির্ভর এসব সাংস্কৃতিক কর্মকা- একটি বড় আকর্ষণীয় বিষয় হতে পারে। সেজন্য উদ্যোগী হতে হবে সরকারকে। স্থানীয় প্রশাসনকে।
পর্যটকের জানমাল ও সম্ভ্রমের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা গেলে শুধু নদীই হতে পারে বাংলাদেশের পর্যটন বিকাশের একটি বড় মাধ্যম। নদীতে প্রমোদ ভ্রমণ বা নৌবিহারের জন্য বড় বড় নদীতে আধুনিক ক্রুজ নামানো যায়- যেগুলোর মূল টার্গেট হবেন দেশের সচ্ছল মানুষেরা এবং বিদেশি পর্যটকরা। নদী ও গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার যে চ্যালেঞ্জিং যাত্রা- সেটি উপভোগ করতেও নিশ্চয়ই অনেকের আগ্রহ আছে। সেটি মাথায় রেখেও নানাবিধ কর্মসূচি নেওয়া যেতে পারে। যদিও এখানেও প্রশ্ন নিরাপত্তার।
সর্বোপরি, গোটা বিশ্বই যখন নদীকেন্দ্রিক ইকো ট্যুরিজমকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে, সেখানে নদীমাতৃক দেশ হয়েও বাংলাদেশ যথেষ্ট পিছিয়ে। এর একটি বড় কারণ নদী দখল ও দূষণ। সড়ক যোগাযোগ উন্নত করতে গিয়ে দেশের অসংখ্য নদী ও খাল মেরে ফেলা হয়েছে বা তাদের বিপন্ন করা হয়েছে। সুতরাং নদী পর্যটন বিকাশ তথা নদী ভ্রমণে দেশ-বিদেশের পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে চাইলে নদীর দখল ও দূষণ বন্ধে সরকারকে কঠোর হতে হবে। আইনের নিরপেক্ষ প্রয়োগ করতে হবে। নদী যে দেশের মা, সেই মায়ের ওপর সব ধরনের অত্যাচার ও নির্যাতন বন্ধে রাষ্ট্রকে জিরো টলারেন্স বা শূন্য সহনশীল নীতি গ্রহণ করতে হবে।
লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com