বিশেষ প্রতিনিধি ::
সুনামগঞ্জে শহর থেকে গ্রাম Ñ সারা জেলার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে সুদের জাল। ফাঁদে ও বিপদে পড়ে সুদের জালে আটকা পড়ে নিঃস্ব হচ্ছে অসহায় মানুষ। সুদখোরদের অমানবিক অত্যাচার নীরবে সহ্য করছেন অনেকে। হারাচ্ছেন ভিটা বাড়ি। এমনকি সুদের টাকা পরিশোধ করেও রেহাই না পেয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন অনেকে। সম্প্রতি সুদের কারবারিদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে আত্মহননের দুটি ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় জেলাজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়। সুদখোরদের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলনসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনকে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার দাবি জানিয়েছেন সাধারণ মানুষজন।
বিভিন্ন এলাকার স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জেলার প্রতিটি গ্রামেই রয়েছে ছোট বড়ো সুদের কারবারি। তারা স্টাম্পে স্বাক্ষর রেখে, সাদা চেকে স্বাক্ষর রেখে লেনদেন করে। পরবর্তীতে চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ নেয়। কেউ অপারগতা প্রকাশ করলে স্টাম্প ও চেকের ভয় দেখিয়ে তাদের জিম্মি করে সুদ আদায় করে। তবে কৌশলে সুদখোররা স্টাম্পের লেখায় সুদের প্রসঙ্গ এড়িয়ে ভিন্ন বিষয় উল্লেখ করে রাখে।
সুনামগঞ্জ জেলা শহরে এভাবে সুদের কারবার করে এমন একাধিক সিন্ডিকেট আছে বলে জানিয়েছেন সচেতন মানুষজন। যারা সুদগ্রহিতা তারা সুদে-আসলে টাকা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় বাসা বাড়ি পর্যন্ত দলিল করে লিখে দিয়েছেন। গ্রাম এলাকার অনেক সুদের কারবারিদের হাতে শিক্ষকরাও জিম্মি। বেতনের চেক দিয়ে আগাম সুদ নিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে অনেক পরিবার। এভাবে সুদখোররা সুদের জালের বিস্তার করে তারা নিঃস্ব করছে অনেক পরিবারকে। সম্প্রতি সুদখোরদের জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে বেশ কয়েকজন আত্মহত্যা করেছেন। আত্মহত্যার আগে তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সুদখোরদের অত্যাচারের করুণ বর্ণনা দিয়েছেন।
গত ১ জুন শুক্রবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে স্টেটাস দেন দিরাই উপজেলার রাজানগর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সৌম্য চৌধুরী। তিনি তার আইডি থেকে লিখেন, ‘আমার পরিণতির জন্যয় দায়ী হবিবুর রহমান হবু এবং জসিম উদ্দিন। হবিবুর রহমান হলো ১নং সুদখোর, হবিবুরের কাছ থেকে আমি টাকা এনেছিলাম, তা সুদ করে দেই সাবেক মেয়র মোশারফ মিয়াকে নিয়ে। ওদের টাকা দিতে গিয়ে সব হারিয়ে পথে এসে দাড়িয়েছি। যাদের কাছে আমি এই লেখা পাঠাচ্ছি আপনাদের কাছে আমার মিনতি, আপনারা জুলুমবাজদের বিচারের কাঠগড়ায় দাড় করাবেন। আমি হয়তো দেখতে পাবোনা, কিন্তু সমাজ আপনাদের কৃতি দেখাবে? বিদায়’।
পুলিশ শনিবার (৩ জুন) রাত ১০টার দিকে সৌম্য চৌধুরীর মরদেহ কমলগঞ্জ-শ্রীমঙ্গল সড়কের ফুলবাড়ি থেকে উদ্ধার করে। মৃতদেহ উদ্ধারের আগে তিনি নিজ ফেসবুক একাউন্টে ‘হবিবুর একজন নিচু সুদখোর’ মন্তব্য করে লিখেন, সুদের টাকায় সে দিরাইয়ে তিনটি বাড়ি করেছে। এই উপজেলার সজল দাস, অসিত দেবনাথ, চিনি ঠাকুর, পুতুল দাসসহ আরো কয়েকজন সুদখোরের নামও উল্লেখ করেন। তাকে নিঃস্ব করার পরও সুদের টাকার জন্য মামলা দিয়ে হয়রানির কথাও তিনি উল্লেখ করেন। এরপর দিন শনিবার রাত ১০টার দিকে তার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
এভাবে গত বছর আগস্ট মাসে তাহিরপুর উপজেলার বালিজুরি ইউনিয়নের পাতারি গ্রামের যুবক ফয়সাল আহমেদ সৌরভ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে সুদ কারবারিদের নাম উল্লেখ করে তাদের অত্যাচারে বর্ণনা দিয়ে পোস্ট করেছিলেন। পরে তিনি গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন।
এর আগে তিনি ফেসবুকে লিখেন, ‘আমি গলায় দড়ি দিলাম তোই রফিকের লাগি তোই আমারে কাবু করিয়া লাষ বানাইলি, তোই ভাল থাক বেইমান, সফিকের কাছ থেকে ১ লক্ষ টাকা আনছিলাম সুদে, তিন লক্ষ টাকা সুদ দিয়েও সাড়ে তিন লক্ষ এখনো পায়, এই রফিক আর সফিকের লাগি আত্মহত্যা করলাম, ভাল থাক আমার পরিবার, মা ফাইজা আমায় ক্ষমা করো, মা বাবা ভাই বোন তোমরা ক্ষমা করিয়ে, বউ তোমাকে কিছু বলার নেই… ইতি এক কাপুরুষ’।
এভাবে সুদখোরদের নাম উল্লেখসহ তাদের মানসিক অত্যাচারের কথা উল্লেখ করে গত বছরের ১৮ আগস্ট রাতে ফেসবুকে স্টেটাস দিয়েছিলেন তিনি। বাড়ি থেকে আধা কিলোমিটার দূর রক্তি নদীর পাশে গলায় ফাঁস দিয়ে গাছে ঝুলে আত্মহত্যা করেন। এভাবে এক বছরের মধ্যে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে সুদের কারবারিদের অত্যাচার সইতে না পেরে আত্মহত্যা করেন দুজন।’
এছাড়াও দুই বছর আগে সুনামগঞ্জের প্রতিষ্ঠিত লাইব্রেরি ব্যবসায়ী দ্বীপায়ন সরকার সুদখোরদের কাছ থেকে সুদ এনে দুই মূল টাকার দুই গুণ বেশি সুদ পরিশোধ করার পরও রেহাই পায়নি। সুদ কারবারিদের মানসিক অত্যাচার সইতে না পেরে তিনি ঢাকা পালিয়ে যান। সেখানে দুর্ঘটনায় মারা যান।
ভুক্তভোগী ও সুধীজন জানান, আত্মহত্যাকারী এই দুইজনই নয় নীরবে অনেকে তাদের মানসিক যন্ত্রণা সইছে। অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাদের কাছে বাধ্য হয়ে বাড়িঘর লিখে নিঃস্ব হতে হচ্ছে।
জানা গেছে, তিন বছর আগে সুনামগঞ্জ বিডি হলে আয়কর মেলা হয়েছিল। সারা জেলার সুদখোরদের তালিকা করে তাদেরকে আয়করের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছিলেন সুনামগঞ্জ চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি খায়রুল হুদা চপল। সংশ্লিষ্টরা আশ্বাস দিলেও সুদের কারবারিদের তালিকা আর করা হয়নি এবং তাদেরকে করের আওতায়ও নেওয়া হয়নি।
নিহত সৌম্য চৌধুরীর স্ত্রী ইলা চৌধুরী বলেন, সুদখোর হবু, জসিম, চিনু, সজল, অসিত আমাদের সাজানো সংসার নষ্ট করে দিয়েছে। স্টাম্প ও চেক রেখে জিম্মি করে তিলে তিলে আমার স্বামীকে কষ্ট দিয়েছে। সুদের টাকা পরিশোধ করার পরও মামলা দিয়েছিল। অবশেষে তারা আমার স্বামীকে মানসিক যন্ত্রণা দিয়ে মেরেই ফেললো।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক সমিতির সভাপতি হারুনুর রশিদ বলেন, গ্রাম এলাকার অনেক গরিব শিক্ষক বেতনের চেক আগাম সুদখোরের কাছে জমা দিয়ে সুদে টাকা নিয়ে সংসারের জরুরি কাজে ব্যয় করেন। এভাবে অনেক শিক্ষক নিঃস্ব হচ্ছেন। শুধু শিক্ষকই নয় সাধারণ মানুষও প্রভাবশালী সুদখোরদের কাছ থেকে সুদ নিয়ে বাসা-বাড়ি জায়গা-জমি হারাচ্ছে। দুশ্চিন্তায় অসুস্থ হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে।
সুনামগঞ্জ চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি ও সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান খায়রুল হুদা চপল বলেন, আমি আয়কর মেলায় সুদখোরদের তালিকা করে তাদেরকে করের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছিলাম। তারা সুদের নেশায় এতটাই বুদ যে মানবিক জ্ঞান হারিয়েছে। প্রতিনিয়ত জুলুম করছে। মানুষের ঘরবাড়ি লিখে নিচ্ছে। মামলা দিচ্ছে। তাদেরকে সামাজিকভাবে বয়কটের পাশাপাশি আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনকেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাই।
দিরাই থানার ওসি কাজী মোক্তাদীর হোসেন বলেন, সৌম্য চৌধুরী চেক ডিজঅনার মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামি ছিলেন। মৌলভীবাজারে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। তার পরিবারের পক্ষ থেকে সুদখোরদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য কোনো অভিযোগ দেওয়া হয়নি। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।