1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
  3. [email protected] : wp-needuser : wp-needuser
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৭:২৪ পূর্বাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

দিপালী দি’কে ভুলি কেমন করে : রমেন্দ্র কুমার দে মিন্টু

  • আপডেট সময় বুধবার, ৩১ মে, ২০২৩

সমাজ আসলে মানুষের সৃষ্টি। মানুষ একা একা সামাজিক মানুষ হিসেবে বসবাস করতে পারে না। তার জন্য মানুষের সঙ্গ, সাহচর্য, স্নেহ-মমতা প্রয়োজন। মানুষের প্রয়োজনেই সমাজের মধ্যে নানারূপ সামাজিক পরিবর্তন আনার চেষ্টা করে। সমাজ পরিবর্তনশীল। সমাজ মানুষের জন্য, সমাজের জন্য মানুষ নয়। মানুষের গুণাবলির বিকাশ সাধনের জন্য সচেতন মানুষেরাই তার মেধা ও প্রজ্ঞাকে কাজে লাগিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণ সাধনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে যায়। মানবতাবাদে উদ্বুদ্ধ মানুষই সত্যিকার অর্থে মানুষের বসবাসের উপযোগী সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ে তুলতে সক্ষম। তারাই সত্যিকারের মানুষ, দেশপ্রেমী, সমাজ সংগঠক এবং সত্যাশ্রয়ী। যার প্রতি শ্রদ্ধা ভালবাসা অম্লান হয়ে থাকে। এমনই ষাটের দশকের এক নারীনেত্রী ভূমিকা রেখে গেছেন সমাজের জন্য, দেশের জন্য। যিনি আজীবন আলোর পথের যাত্রী হিসেবে দেশের জন্য, সমাজের জন্য অবদান রেখে গেছেন, তিনি আমার শ্রদ্ধেয় দিদি শ্রীমতি দিপালী চক্রবর্তী। আজ তাঁর ২০তম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০০৩ সালের ৩১ মে, ৭০ বছর বয়সে আমরা দিদিকে হারিয়েছে। ১৯৩৩ সনের জানুয়ারি মাসের ৫ তারিখে জগন্নাথপুর উপজেলার ভবানীপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারে দিদি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সত্যেন্দ্র চৌধুরী এবং মাতা হীরালতা চৌধুরী। বাল্যকালে তিনি গ্রামেই লেখাপড়া করেছেন।
দিপালী দিদি’র পরিবারে সংগীতচর্চার প্রচলন থাকায় তিনি সুনামগঞ্জে এসেও এ চর্চা অব্যাহত রাখেন। তিনি নিজেও ধামাইল গান গাইতেন। দিদি’র বিয়ে হয় দক্ষিণ সুনামগঞ্জ বর্তমানে শান্তিগঞ্জ উপজেলার হাঁসকুড়ি গ্রামের মনোরঞ্জন চক্রবর্তী মহাশয়ের সঙ্গে। মনোরঞ্জন চক্রবর্তী মহাশয় ছিলেন পলাশের জমিদার এস্টেটের ম্যানেজার। সেই সুবাদে পরবর্তীকালে সুনামগঞ্জ শহরের উকিলপাড়ায় পলাশের জমিদার বাড়িতে বসবাস করতেন। পলাশের অন্যতম জমিদার মন্মথ নাথ রায় (পিলু চৌধুরী) দিদি’র পরিবারের সঙ্গে একই বাসায় বসবাস করতেন। পিলু চৌধুরী ছিলেন অত্যন্ত সঙ্গীতপিপাসু এবং একজন উঁচুমানের এ¯্রাজ বাদক। তিনি দিদি’র পরিবারের সবাইকে পরম যতœ ও মমতায় জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই বাসায়ই কাটিয়ে গেছেন।
সামাজিক যোগাযোগ ও আমাদের মূলবাড়ি জগন্নাথপুর থাকায় আগে থেকেই আমাদের যোগাযোগ ছিল। দিদি’র অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়ায় তিনি উচ্চশিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। কিন্তু উনার পড়াশোনার স্পৃহা শেষ হয়ে যায়নি। আমি এসএসসি পরীক্ষা দেই ১৯৬৩ ইংরেজিতে। দিদিও ওই সময় প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে এসএসসি পরীক্ষা দেন এবং ধারাবাহিকভাবে এইচএসসি, বিএ পর্যন্ত ডিগ্রি অর্জন করেন। বয়স তাঁর কাছে বাধা সৃষ্টি করতে পারেনি। পড়াশোনা ও জ্ঞান অর্জনে তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞাই তাঁকে লক্ষ্যে পৌঁছে দিয়েছে। তৎকালীন সময়ে একজন গৃহকর্তী নারীর পড়াশোনা চর্চা করা এবং সামাজিক ক্রিয়া-কর্মে যুক্ত থাকার নজির খুবই বিরল। এর জন্য পরিবারের সার্বিক দিক সামাল দিয়ে স্বামী-সন্তানদের সেবা-যতেœর কোনো ঘাটতি হয়নি।
দিপালী দিদি’র বাসার সামনে ছিল একটি খালি ঘর। পূর্বে এ ঘরটি জমিদারি কাজে ব্যবহৃত হত। সেখানে শ্রদ্ধেয় পিলু চৌধুরীর অনুমতি নিয়ে দিদি গড়ে তুলেন মহিলা সমিতি। সুনামগঞ্জের কয়েকজন মান্য ব্যক্তিত্ব যাদের এই সমিতি গঠনে ভূমিকা ছিল তারা হলেন- প্রবীণ অ্যাডভোকেট রফিকুল বারী সাহেবের স্ত্রী রাবেয়া বারী, আওয়ামী লীগ নেতা ও তৎকালীন এমপি অ্যাডভোকেট আব্দুর রইছ সাহেবের স্ত্রী রফিকা রইছ। দিদি এই মহিলা সমিতিতে সেলাই প্রশিক্ষণ দিয়ে অনেক মহিলাকে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেন।
দেশে স্বৈরাচারী আইয়ুব সরকারের ’৬২ সালের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে দেশব্যাপী তুমুল আন্দোলন গড়ে উঠে। তখন পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র-জনতা ছিলেন আন্দোলন মুখর। দিদি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল আদর্শে বিশ্বাসী। সে সময় পূর্ব পাকিস্তানে ছাত্র রাজনীতিতে এক শক্তিশালী সংগঠন ছিল পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন। সুনামগঞ্জ মহকুমাসহ সিলেট জেলায় ছিল ছাত্র ইউনিয়নের একচ্ছত্র প্রভাব। কলেজে অধ্যয়নের সময় দিদি ছাত্র ইউনিয়নে জড়িয়ে পড়েন। এই সুবাদে তিনি ছাত্র ইউনিয়নের মধ্যমণি হয়ে উঠেন। উনার বাসায় আমরা অনেক মিটিং করেছি। আমরা যারা সেখানে যাতায়াত করতাম, দিদি তাদের অত্যন্ত আদরের সহিত ¯েœহ-মমতা ও আপ্যায়ন করতেন। যা কখনো ভুলার নয়। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের নেত্রী মতিয়া চৌধুরী, আয়েশা খানমরা সুনামগঞ্জ আসলে দিপালী দিদি’র বাসায় উঠতেন।
দিদি’র ছিল চার ছেলে ও তিন মেয়ে। সবাইকে সযতেœ বিদ্যাশিক্ষায় উপযুক্ত করে গড়ে তুলেছেন। বড়ছেলে মৃণাল চক্রবর্তী মিঠু ছিল অ্যাডভোকেট ও তবলাবাদক। বড়মেয়ে রতœা চক্রবর্তী ছিল উচ্চমানের সংগীতশিল্পী ও সিলেট বেতারের নিয়মিত শিল্পী। দ্বিতীয় ছেলে ড. মৃদুলকান্তি চক্রবর্তী ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগীত বিভাগ তাঁর হাত ধরেই প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি ছিলেন শিল্পী এবং গবেষক। ছোটছেলে মলয় চক্রবর্তী রাজু একজন আইনজীবী ও ভালো সংগীতশিল্পী।
ষাটের দশকে ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে শহীদ দিবসসহ সম্মেলন বা রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তীতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রচলন ছিল। এতে ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী হিসেবে আমার দুই বোন শুক্লা দে, স্বপ্না দেসহ রতœা চক্রবর্তী, কল্পনা ভট্টাচার্য, রথীশ রায়, অভিজিৎ চৌধুরী, দিগি¦জয় চৌধুরী শিবু, সুহেল আহমদসহ অনেকেই সংগীত পরিবেশন করতো। সঙ্গে তবলাবাদক ছিল মৃণাল চক্রবর্তী মিঠু।
মুক্তিযুদ্ধের সময় দিদি ও উনার পরিবার শিলংয়ে ছিলেন এবং তখন তিনি শিলংয়ে রেডক্রসের পক্ষ থেকে শরণার্থীদের সেবাদান কার্যকর ও সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। দেশে ফিরে এসেও তিনি রেডক্রসের পক্ষে কর্ম তৎপরতা চালিয়ে যান।
দিপালী দিদি সমাজে অবহেলিত ও নারী অধিকার নিয়েই সর্বদাই ভূমিকা রেখে গেছেন। সুনামগঞ্জে দিদির হাত ধরেই গড়ে ওঠে মহিলা পরিষদ। তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, সম্পাদক ছিলেন খালেদা ওয়াহাবসহ অঞ্জলি চৌধুরী, নিরুপমা দে, সঞ্চিতা চৌধুরী, মালতী তালুকদার প্রমুখ। তারা মহিলা পরিষদে অনন্য ভূমিকা রাখেন। বর্তমানে এই সংগঠন সমাজে অত্যন্ত শক্তিশালী ভূমিকা রেখে এগিয়ে যাচ্ছে।
আজকের দিনে নারীরা পদে পদে নির্যাতিত হচ্ছেন, অধিকার বঞ্চিত হচ্ছে, সেখানে দিদির আদর্শকে অনুসরণ করে যাবে বলে আশা রাখি। দিপালী দিদি একজন আলোকিত মানুষ হিসেবে সমাজ ও দেশের জন্য, নারীদের অধিকার আদায়ে কাজ করেছেন। তাঁর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা নিবেদন করতে চাই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের কয়েকটি চরণ দিয়ে-
“মুদিত আলোর কমল-কলিকাটিরে
রেখেছে সন্ধ্যা আঁধার-পর্ণপুটে
উতরিবে যবে নব-প্রভাতের তীরে
তরুণ কমল আপনি উঠিবে ফুটে।”
শ্রদ্ধেয় দিপালী চক্রবর্তী তাঁর আদর্শ এবং কর্মের মাধ্যমে আমাদের মধ্যে চিরজীবী হয়ে থাকবেন।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com