বজ্রপাতে বিশ্বে যত মানুষ মারা যায়, তার এক-চতুর্থাংশই বাংলাদেশে। প্রাকৃতিক এ দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির ঘটনা ঘটে দেশের হাওর, বাঁওড় ও বিল এলাকার জেলাগুলোয়। ঝড়-বৃষ্টির সময় খোলা মাঠ, জলাশয়, নৌকা ও পথঘাটে যারা চলাচল বা কাজ করে তারাই এর শিকার হয়। বিগত কয়েক বছরে বজ্রপাতের ঘটনা ১৫ শতাংশ বেড়েছে, যা গবেষণায় উঠে এসেছে। আর একজনের মৃত্যুর সঙ্গে অন্তত ১০ জন বজ্রাঘাতে আহত হয়ে থাকে বলে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত, যাদের স্থায়ীভাবে প্রতিবন্ধী হয়েই বেঁচে থাকতে হয়।
বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, দেশে প্রতি বছর গড়ে ৩০০ জনের মৃত্যু হয় বজ্রাঘাতে। ১৯৯০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ৫ হাজার ৬০০ জনের। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ আড়াই হাজার লোক প্রাণ হারিয়েছে ২০১৫ থেকে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। বজ্রপাতের শিকার মানুষের বড় অংশই কৃষক, যারা সবার মুখে অন্ন তুলে দিতে মাঠে যান। সেখানেই মরে পড়ে থাকেন। গত ২২ এপ্রিলও (২০২৩) ধান কাটতে গিয়ে বজ্রাঘাতে প্রাণ হারিয়েছেন সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, নেত্রকোণার আট কৃষক। চিরবিদায়ের এত এত করুণ গল্প, এত মৃত্যুর পরও বিষয়টি খুব একটা দৃষ্টি কাড়তে পারছে না ঊর্ধ্বতন মহলের। এ উপেক্ষার কারণ হয়তো বজ্রপাতে সাধারণ মানুষের মৃত্যু। কোনো পর্যায়ের নীতিনির্ধারকরা যেহেতু এর শিকারে পরিণত হন না, তাই এটা নিয়ে তোড়জোড়ও কম।
সুনামগঞ্জের বৃদ্ধ কৃষক আবুল কাশেমের মতে, আগেও বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যু হতো কিন্তু তা এখনকার তুলনায় অনেক কম। তার মতে, আগে আকাশে মেঘ দেখে বোঝা যেত যে ঝড়-বৃষ্টি আসছে এবং গ্রামের মাঠেঘাটে কাজ করা কৃষক বাড়ি ফিরে যেতেন। এখন তা বুঝতে পারলেও বাড়ি যাওয়ার সময়টুকুও তারা পান না, তার আগেই অকস্মাৎ শুরু হয়ে যায় ঝড়-বৃষ্টি-বজ্রপাত। তাই যে যেখানে থাকেন সেখানেই কোনো বড় গাছ বা অন্য কিছুর নিচে আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা করেন। যেখানে এর কিছুই থাকে না, তারাই মূলত বজ্রবিদ্যুতের শিকার হন।
বজ্রপাতের এ বর্ধিত প্রকোপের পেছনে অন্তর্নিহিত কারণটি কী – মানুষের অসচেতনতা; আবহাওয়ার কোনো বদল, নাকি তার সঙ্গে জুড়ে রয়েছে পরিবেশের কোনো বদলও; নাকি অন্য কিছু? এ দুর্যোগ বাংলার মানুষের কাছে তো নতুন কোনো ঘটনা নয় এবং তাতে যে প্রাণহানির শঙ্কা আছে, তাও অজানা নয়। তাই এর পেছনের অন্তর্নিহিত কারণ খুঁজতে গিয়ে গবেষকরা বলছেন, দেশের বেশির ভাগ জেলার বার্ষিক তাপমাত্রা (বার্ষিক গড় তাপমাত্রা, বার্ষিক গড় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা, বার্ষিক গড় সর্বনি¤œ তাপমাত্রা) বৃদ্ধির প্রবণতা অঞ্চলানুযায়ী ভিন্ন। একই সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিম বায়ুঘটিত বর্ষার পরিমাণ গঙ্গা উপত্যকায় ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। ঊর্ধ্বমুখী তাপমাত্রা ও নি¤œমুখী বর্ষার সম্মিলিত প্রভাব – এ দুইয়ের ফলে দেশে চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া, তথা বজ্রপাতের প্রকোপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত রুদ্র-রুষ্ট বিরূপ এ প্রকৃতি, উঁচু বৃক্ষ নিধনসহ নানা কারণেই বজ্রপাত বাড়ছে প্রতি বছর। বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। বিশেষ করে গ্রামের মানুষের কাছে বজ্রপাত এখন ভয়াবহ আতঙ্কের বিষয়। এপ্রিল থেকে মে-জুন পর্যন্ত বজ্রপাতের মৌসুম। তবে ইদানীং সেপ্টেম্বর-অক্টোবরেও বজ্রপাতে প্রাণহানির ঘটনা ঘটতে দেখা যায়।
পরিবেশবিজ্ঞানীরা বলছেন, সাধারণত কিউমুলোনিম্বাস বা ঝড়োপুঞ্জ মেঘ থেকে বজ্রপাত ও বৃষ্টি হয়। তাই একে বজ্রগর্ভ মেঘও বলা হয়ে থাকে। কয়েক বছর ধরে এপ্রিল-মে মাসে দেশে বজ্রগর্ভ মেঘের পরিমাণ বেড়েছে। তার একটা অন্যতম কারণ বাতাসে জলীয়বাষ্পের আধিক্য, আরেকটা হলো তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া। আর এ তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত দূষণ। বায়ুতে দূষণের মাত্রা যত বাড়ছে, গড় তাপমাত্রা ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ভৌগোলিক অবস্থানের দিক দিয়ে বাংলাদেশ ঝড়, খরা, বন্যা ও বজ্রাঘাতপ্রবণ অঞ্চল। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাপমাত্রা বাড়ছে। এতে যেকোনো দুর্যোগই বৃদ্ধি পায়। এর মধ্যে বজ্রসহ বৃষ্টিপাতের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। ক্রমবর্ধমান উষ্ণতা ও পরিবেশগত ভারসাম্যহীনতা – সব মিলিয়ে যেন বজ্রগর্ভ মেঘ তৈরির আদর্শ পরিবেশ এ দেশের বায়ুম-ল। দিন শুরুর পর সকাল ১০টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত সূর্যের তাপমাত্রা বেশি থাকে। এ সময় সূর্যের প্রখর কিরণটা ভূমিতে পড়ে, যা বজ্র তৈরিতে উপযোগী। তবে বিভিন্ন মৌসুমে বজ্রপাতের তারতম্য থাকে। অনেক সময় রাতের আবহাওয়াও সকালে বজ্রপাত সৃষ্টিতে উপযোগী হতে পারে।
দেশের সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোণা, সিরাজগঞ্জ, ময়মনসিংহ, দিনাজপুর, পাবনা, নওগাঁ, বগুড়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, জামালপুর, গাইবান্ধা ও টাঙ্গাইল সবচেয়ে বেশি বজ্রপাতপ্রবণ জেলা। ফলে এ ১৫ জেলায় মৃত্যুও বেশি। এর মধ্যে মার্চ-এপ্রিল ও মে মাসে বজ্রপাত বেশি হয় হাওরাঞ্চলে – কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট ও নেত্রকোণা জেলায়।
জুন, জুলাই, আগস্টে হয়ে থাকে সুনামগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, মানিকগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, টাঙ্গাইল ও বরিশালে। অন্যদিকে কুড়িগ্রাম ও পঞ্চগড়েও বজ্রপাত বেশি হয়। সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বরে পার্বত্য চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও কক্সবাজারে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয়।
শহরের চেয়ে গ্রামীণ এলাকায় বজ্রপাতে মৃত্যুর হার অনেক বেশি। বিশেষ করে ফাঁকা মাঠে চাষের কাজ করতে গিয়ে মৃত্যু হচ্ছে অনেকের। এর অন্যতম কারণ হিসেবে কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহার করা উন্নত যন্ত্রপাতিকে দায়ী করছেন পরিবেশবিদরা। কেননা এসব যন্ত্রে আকর্ষিত হয় বিদ্যুৎ। সেই সঙ্গে ফাঁকা মাঠে কোনো উঁচু জায়গা বা গাছ না থাকায় মানুষের ওপর বজ্রপাতের ঘটনা অনেক বেশি হচ্ছে। একেকটি বজ্রপাতের সময় প্রায় ৬০০ মেগা ভোল্ট বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়, যেখানে একজন মানুষের মৃত্যুর জন্য মাত্র ১০০ ভোল্ট বিদ্যুৎই যথেষ্ট।
আমেরিকান মেট্রোলজিক্যাল সোসাইটির জার্নালে প্রকাশিত ‘লাইটিং ফ্যাটালিটিস ইন বাংলাদেশ ফ্রম ১৯৯০ থ্রু ২০১৬’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রবন্ধ বলছে, ২৬ বছরে বজ্রপাতে মারা যাওয়া ৩ হাজার ৮৬ জনের মধ্যে ৯৩ শতাংশই গ্রামের বাসিন্দা। তারা মূলত কৃষিকাজে যুক্ত। আর প্রতি ১০ লাখ জনসংখ্যার মধ্যে প্রাকৃতিক এ দুর্যোগে বছরে মৃত্যু হয়েছে প্রায় একজনের। তবে ২০১১ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে সেই হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় দুজনে। মূলত বর্ষার শুরুর দিকে সবচেয়ে বেশি (৬২ শতাংশ) বজ্রাঘাতে মৃত্যু হয়। এছাড়া বর্ষার মধ্যবর্তী সময়ে ৩৩, বর্ষা পরবর্তী মৌসুমে ৪ দশমিক ৫ ও শীতকালে মৃত্যু হয় ১ দশমিক ৫ শতাংশের। গবেষণায় আরো ওঠে এসেছে, সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে দিনের সকাল ও দুপুরের বজ্রঘাতে। কেননা এ সময়ে শ্রমিক ও কৃষকরা মাঠেঘাটে কাজে ব্যস্ত থাকেন। আকস্মিক এ দুর্যোগের সময়ে দ্রুত সরে যাওয়ার নিরাপদ স্থান না থাকার কারণে মাঠেই তাদের মৃত্যু হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং বেসরকারি সংগঠন ‘ডিজাস্টার ফোরাম’-এর তথ্যমতে, কৃষিকাজের সময় ৭০ শতাংশ, সাড়ে ১৪ শতাংশ বাড়ি ফেরার পথে এবং গোসল কিংবা মাছ শিকারের সময় ১৩ শতাংশের মৃত্যু হয়েছে বজ্রাঘাতে। তবে শহরের ভবনগুলোয় বজ্রপাত প্রতিরোধক দ- থাকায় হতাহতের সংখ্যা কম।
সারা বিশ্বে প্রতিদিন ৫০ হাজারের বেশি বজ্রাঘাতের ঘটনা ঘটে। তবে বাংলাদেশে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষের মৃত্যুর হার যতটা, তার চেয়ে অনেক বেশি মৃত্যু হয় বজ্রপাতে। এমনকি সরকার এটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘোষণা করলেও এ খাতে নেই তেমন বরাদ্দ। অথচ জীবন রক্ষায় মাঠে, হাওর, বাঁওড়ে বা কৃষিকাজের ফাঁকা এলাকায় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ জরুরি। যেন বজ্রপাতের সময় কৃষকরা সেখানে অবস্থান বা আশ্রয় নিতে পারেন। তাছাড়া বজ্রপাতের ১৫ মিনিট আগেই আবহাওয়া অধিদপ্তর জানতে পারে কোন কোন এলাকায় ধেয়ে আসছে প্রাণঘাতী দুর্যোগটি। ফলে এটাকে মোবাইল মেসেজের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষকে জানিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করতে পারলে এত করুণ মৃত্যুর ঘটনা ঘটত না। এছাড়া আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম বা প্রাক-সতর্কীকরণ ব্যবস্থা ও লাইটেনিং অ্যারেস্টর বা বজ্রপাতনিরোধক স্থাপনের মাধ্যমে মানুষকে রক্ষার পদক্ষেপ নেয়া যায়। বিশ্বের দেশে দেশে এসব প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে। ঘূর্ণিঝড়ে যেমন সতর্কতা সংকেত দেয়া যায়, ঠিক তেমনি বজ্রপাতের ক্ষেত্রেও পূর্ব সতর্কতার পদ্ধতি এটি। ভারতের উড়িষ্যাসহ বেশকিছু অঞ্চলে আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম বেশ কাজে লাগছে। বাংলাদেশের সিলেটেও এ প্রযুক্তি স্থাপন করা হয়েছে, যদিও সেগুলো কাজ করতে আরো বছরখানেক লাগবে বলে জানিয়েছেন প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা।
বজ্রপাত থেকে প্রাণক্ষয় কমাতে হলে যা যা ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন, তার কোনোটিই দেশে ঠিকঠাক মতো হয় না। এ গলদ শুরু হয় খোদ আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস থেকেই। সরকারের এ সংস্থা বর্তমানে যেভাবে পূর্বাভাস দেয় সেটা খুব একটা কার্যকর নয়। কারণ সেখানে বলা হয়- ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ওই এলাকায় বজ্রপাত হতে পারে বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু গ্রামের মানুষের পক্ষে গোটা দিন বাড়িতে বসে থাকা বা সবসময় পূর্বাভাস দেখা সম্ভব হয় না। আবার গ্রামের সাধারণের পক্ষে আবহাওয়ার কিতাবি পূর্বাভাস বোঝাও বেশ কঠিন। তাই কাজে বের হয়ে প্রায়ই বজ্রবিদ্যুতের শিকার হতে হয় কৃষক-শ্রমিককে।
বেড়ে চলা বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা সত্যিই একটি সতর্কবার্তা। তাই আরো সতর্ক হতে হবে, পরিবেশ দূষণ রোধ করতে হবে। মানুষের পাশাপাশি সরকারকেও সক্রিয় হতে হবে, জোরদারভাবে আবহাওয়ার পূর্বাভাস ও সতর্কবার্তা সবার মধ্যে প্রচার করতে হবে কঠোর পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে। একই সঙ্গে গবেষণা সম্প্রসারণের জন্য গবেষকদের অনুপ্রাণিত করতে হবে যাতে উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে বজ্রপাতের তীব্রতা, নিখুঁত সময় ও আরো নতুন তথ্য জানা যায়। সবশেষে, মানুষ ও সরকার – দুজনকেই নিরন্তর হাতে হাত মিলিয়ে এগিয়ে যেতে হবে দূষণমুক্ত পরিবেশ গড়ার লক্ষ্যে।
ওবায়দুল্লাহ সনি: সাংবাদিক