কোনও কোনও চিন্তক আমাদের দেশের আমলাদেরকে ‘মেকলেচেলা’ বলে রীতিমতো গালমন্দ করতে কসুর করেন না। কিন্তু পরম পরিতাপের বিষয় এই যে, বোধ করি আমলাদের এইভাবে গালমন্দ করার বিষয়টি খুব একটা নিরর্থক কীছু নয়। কারণ তাঁরা এখনও ব্রিটিশ-ভারতের আমলাদের মতোই রয়ে গেছেন এবং ব্রিটিশের অনুপস্থিতিতে নিজেরাই ব্রিটিশ হয়ে বসে আছেন। দেশের বর্তমান প্রশাসনের অভ্যন্তরে এর একটি বাস্তবসম্মত ও তাৎপর্যম-িত রূপও আছে। আর এই ‘বাস্তব রূপ’টি তার কদাকার মুখ ব্যাদন করে প্রকাশ্যে প্রকটিত হয় যখন একজন মন্ত্রী বলেন, ‘দেশে যত আইনই থাকুক না কেন, আমলারা কিচ্ছু কেয়ার করেন না। তাঁরা তাঁদের মতো করে চলেন। আমি মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে বলছি। দেশি-বিদেশি, উদ্যোক্তা, সাধারণ মানুষ আমলাদের কাছে গেলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে। সার্বিক সিস্টেমটাই এ রকম।’ এই বাক্য কটি প্রতিবেদনের শুরুতেই আছে। প্রতিবেদনটি ছাপা হয়েছে দৈনিক কালের কণ্ঠের পাতায় গত মঙ্গলবারে (২৩ মে ২০২৩)।
শিরোনাম ছিল, ‘সাধারণ মানুষ আমলাদের কাছে গেলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে : কৃষিমন্ত্রী’।
বিষয়টি যতোটা না গুরুত্ববহ তার চেয়ে ‘প্রকাশ্যগোপন’ সত্যের যথাযথ উন্মোচনে এককাঠি বাড়া। আমরা তেমন কীছু বলতে চাই না। এই মওকায় কেবল ইতিহাসের পাতায় একটু চোখ ফেরাতে চাই।
সেই ১৮৩৬ সালে যখন ব্রিটিশ শাসিত ভারতের নিজস্ব শিক্ষাপদ্ধতি বাতিল করে পশ্চিমা শিক্ষাপদ্ধতি কায়েম করা হয় তখন এই আরোপিত শিক্ষানীতির প্রবক্তা লর্ড ব্যাবিংটন মেকলে পরিকল্পনা করেছিলেন যে, তিনি তাঁর প্রতিষ্ঠিত শিক্ষানীতির সহায়তায় ভারতে এমন এক আমলাশ্রেণির মানুষ তৈরি করবেন যারা রক্তমাংসচর্মগুণে দেখতে হবে ভারতীয় কিন্তু চিন্তাচেতনা অর্থাৎ মনেমগজে ও কাজেকর্মে হবে ইংরেজ। তাঁরা ভারতীয় হয়েও ভারতীয়দেরকে ইংরেজদের হয়ে শাসন করবে অর্থাৎ আসলে তারা হবে ইংরেজদের সেবাদাস, ভারতীয়দের জন্যে ঘরশত্রু ‘বিভীষণ’। ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে এই ধরণের আমলারাই ‘মেকলেচেলা’ বলে বিখ্যাত। মন্ত্রীমহোদয় বোধ করি, আমাদের আমলাতান্ত্রিকতার ভেতরে আন্তর্ঘাতমূলক কাজে ব্যাপৃত ‘বিশেষ ধরণের এই আমলা বা আমলাশ্রেণির খপ্পরে পড়ে গিয়েছিলেন। তার প্রতিক্রিয়াই পাওয়া যায় তার উপরোক্ত মন্তব্যে। বর্তমান নয়া-উপনিবেশিক কালপর্বে প্রভু ইংরেজদের সশরীরে অনুপস্থিতির পরিসরে এই মেকলেচেলারা নিজেরাই জনগণের প্রভু হয়ে উঠেছে এবং প্রকৃতপ্রস্তা্েব নয়া-উপনিবেশিকতার পরিসরে পুরনো প্রভুর দাসত্বকেই শিরোধার্য করে চলেছে। তাদের প্রভু এখনও পুরনো ঔপনিবেশিকরাই, জনগণের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক প্রভু-ভৃত্যের। এই সম্পর্কের ব্যবহারিক প্রকাশকে উপলব্ধিতে নিতে পেরেছেন আমাদের মন্ত্রী মহোদয় এবং সত্যটি প্রকাশ করেছেন। তাঁকে ধন্যবাদ ও অভিনন্দন।
‘সার্বিক সিস্টেমটাই এ রকম’। মন্ত্রী এই ‘সিস্টেম’টি বদলানোর কথা সরাসরি বলেন নি। কিন্তু সেটা বদলানোর প্রয়োজন যে আছে সেটা তার মন্তব্যের তাৎপর্য কিংবা নিহিতার্থ থেকে যে-কেউ উপলব্ধি করতেই পারেন। অন্তত আমরা করছি এবং বিদগ্ধমহলের ধারণা এই যে, জনগণও বদলের অপেক্ষায় আছেন। চেতনার স্তরে বদল তো শুরু হয়েই গেছে, মন্ত্রীমহোদয়ের মন্তব্য তারই প্রত্যক্ষ প্রমাণ।