গত বুধবার (১০ মে ২০২৩) দৈনিক প্রথম আলো’র সাতক্ষীরার নিজস্ব প্রতিনিধির করা একটি সংবাদপ্রতিবেদনের শিরোনাম ছিলো, ‘কলারোয়ায় শেখ হাসিনার গাড়িবহরে হামলার মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামি গ্রেফতার’। সংবাদবিবরণীতে ঘটনাটি সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘পুলিশ, দলীয়-নেতাকর্মী ও মামলার এজহারসূত্রে জানা যায়, ধর্ষণের শিকার এক নারীকে দেখতে ২০০২ সালের ৩০ আগস্ট তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে যান। সেখান থেকে যশোরে যাওয়ার পথে কলারোয়া উপজেলা বিএনপি কার্যালয়ের সামনে তাঁর গাড়িবহরে হামলা ঘটে।’ এই প্রতিবেদনের এক জায়গায় লেখা হয়েছে, ‘এ ঘটনায় উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোসলেম উদ্দিন বাদী হয়ে হয়ে কলারোয়া যুবদলের তৎকালীন সভাপতি আশরাফ হোসেনসহ ২৭ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতপরিচয় ৭০-৮০ জনকে আসামি করে কলারোয়া থানায় মামলা করতে গেলে মামলাটি রেকর্ড করেনি পুলিশ। এ ঘটনার ১২ বছর পর ২০১৪ সালের ১৫ অক্টোবর সাতক্ষীরা আদালতে একটি মামলা করা হয়। আদালত কলারোয় থানায় মামলাটি রেকর্ড করার আদেশ দেন।’
হামলার ঘটনা, থানায় মামলা রেকর্ড না করা, ১২ বছর পর মামলা দায়ের ও আদালতের নির্দেশে থানায় মামলা রেকর্ড করা এবংবিধ ঘটনার সামাজিক-রাজনীতিক সংস্কৃতির চর্চা আকাশ থেকে বা মানুষের চলিতকর্মের সঙ্গে এমনি এমনি ওতপ্রোত হয়ে যায় না, প্রকৃতপ্রস্তাবে মানুষের বিরুদ্ধে মানুষের এই অমানবিক চর্চার আদি অকৃত্রিম উৎস প্রতিষ্ঠিত সমাজসংস্থিতির শ্রেণিচরিত্র। সত্যি করে বলতে গেলে বলতে হয় যে, প্রতিষ্ঠিত পুঁজিবাদী আর্থব্যবস্থার চরিত্রবৈশিষ্ট্যই এর জন্যে সর্বাবস্থায় ও সর্বপ্রকরণে দায়ি। এই ব্যবস্থাপ্রকরণটিকে বদলে না দিলে এমন ঘটনার (হামলার ঘটনা, থানায় মামলা রেকর্ড না করা, ১২ বছর পর মামলা দায়ের ও আদালতের নির্দেশে থানায় মামলা রেকর্ড করা এবংবিধ ঘটনা) পুনরাবৃত্তি চলতেই থাকবে, দেশের সর্বত্রÑ রাজনীতিক দল, প্রতিষ্ঠান, সংঘ-সংস্থা ইত্যাদিসহ ব্যক্তিগত পর্যায় পর্যন্ত। অর্থাৎ কেবল রাজনীতিক পরিসরে নয়, ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে শুরু করে প্রান্তিক ব্যক্তি পর্যায় পর্যন্ত বৃহৎ পরিসরে, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের প্রতিটি স্তরে এবংবিধ ঘটনা ঘটতেই থাকবে এবং বাস্তবে এবংবিধ ঘটনা দেশের ভেতরে বিভিন্ন প্রকারপ্রকরণে, ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রখাতে, বহুবিচিত্র চারিত্র্যলক্ষণে সমাবৃত হয়ে এখনও ঘটেই চলেছে অপ্রতিহত গতিতে। এসব সকলেরই জানা। আমাদের সুনামগঞ্জও এই অমানবিক সংস্কৃতি চর্চার বহির্ভূত নয়।
দেশজুড়ে বিস্তৃত এই অমানবিক ও অসহনীয় অপসাংস্কৃতিক চর্চার নিরসন চাই। কিন্তু কীভাবে সেটা সম্ভব আমাদের সম্পাদকীয় দপ্তর থেকে সেটা বলে দেওয়া সম্ভব নয়। এটা জাতিকে অসভ্যতার পঙ্কিলতা থেকে উদ্ধার করার অনুরোধে দলমত নির্বিশেষ সকল রাজনীতিকদের সামাজিক-রাজনীতিক দায়িত্ব। কারও পক্ষে এর বিরোধিতা করার কোনও অজুহাত থাকতে পারে না। দেশ পুঁজিবাদী ব্যবস্থার পরিসরে হলেও ধাপে ধাপে উন্নয়নের পথে এগিয়ে চলেছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এই সময়ে অন্তত দেশের মানুষ যে-কোনও অন্যায়ের ও সংঘটিত অপরাধের বিচারের নিশ্চয়তা চাইতেই পারেন। কোনও হত্যাকা-ের বিচার প্রতিহত করার লক্ষ্যে রাজনীতিক ছত্রছায়ায় বসে দায়মুক্তিকে আইনি বৈধতা দেওয়া (যেমন বঙ্গবন্ধু হত্যার ক্ষেত্রে করা হয়েছিল), অকারণে থানায় মামলা না নেওয়া, কিংবা রাজনীতিক প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে আইনি প্রতিকারের পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা ইত্যাদি এবংবিধ সকল কার্যকলাপের বেআইনি চর্চাকে চিরতরে উৎখাত করতে হবে। অন্যথায় উন্নয়ন যে-মাত্র আর ধরনেরই হোক না কেন তা মানবিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়ে অত্যাচারী ও অত্যাচারিতের দ্বান্দ্বিক সংস্কৃতিকেই প্রতিপালন করে যাবে। মানুষের জীবনে শান্তি, সুখ, শারীরিক-মানসিক সুস্থতা ও মেধার বিকাশের সুযোগ আসবে না কোনও দিনই।