বাদল কৃষ্ণ দাস ::
বজ্রপাত রীতিমতো আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। বৃষ্টি আর ঝড় হলেই বজ্রপাতে একাধিক মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে। গত ২৩ এপ্রিল সুনামগঞ্জের তিন উপজেলায় হাওরে ধান কাটার সময় বজ্রপাতে ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হন আরও দুজন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে তিনজন ছাতক, দু’জন দোয়ারাবাজার ও একজন তাহিরপুর উপজেলার বাসিন্দা ছিলেন।
এদিকে, বুধবার (৩ মে) বজ্রপাতের ক্ষয়ক্ষতি রোধে জেলা পর্যায়ে জনসচেতনতামূলক কর্মশালার অংশ হিসেবে জামালগঞ্জ উপজেলাতেও কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়েছে। লাইফ স্টাইল, হেলথ এডুকেশন এন্ড প্রমোশন, স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরো, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে, বর্ণমালা ফাউন্ডেশনের আয়োজিত কর্মশালায় জানানো হয়- বজ্রপাতে নিহতের ৭০ শতাংশই কৃষক।
ফিনল্যান্ড ভিত্তিক বজ্রপাত বিষয়ক গবেষণাসংস্থা ভাইসালার প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে আরও জানা যায়, বাংলাদেশে প্রতি বছর বজ্রপাতে গড়ে ১৬৫ জন মানুষের মৃত্যু হয়। বাংলাদেশে বজ্রপাতে যারা মারা যান, তাদের ৭০ ভাগই কৃষক বা যারা খোলা মাঠে কাজ করেন। বাড়ি ফেরার পথে ১৪ শতাংশ এবং গোসল ও মাছ ধরার সময় ১৩ শতাংশের বজ্রপাতের ফলে মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু বজ্রপাত প্রতিরোধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেই। আর প্রকল্পের নামে অর্থের অপচয় হলেও বজ্রপাতে মৃত্যু ঠেকানো যাচ্ছে না। এবারও ঝড় বৃষ্টির মৌসুম শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়েছে বজ্রপাত।
বিশ্লেষকদের মতে- শহরে বেশিরভাগ ভবনে বজ্রনিরোধক দ- থাকায় বজ্রপাতে মৃত্যু তেমন হয় না। কিন্তু গ্রামে তা না থাকা ও বড় গাছপালা কমে গিয়ে খোলা মাঠের কারণে সেখানে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বেশি। তাদের কথা দেশের হাওর এলাকায় বজ্রপাতে মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। কারণ সেখানকার বেশিরভাগ ফসলি জমিতে বড় কোনো গাছ নেই।
বজ্রপাতের ধর্ম হচ্ছে তা মাটিতে আঘাত হানার আগে সবচেয়ে উঁচু যে জায়গাটি পায় সেখানে গিয়ে পড়ে। বৃক্ষহীন হাওর এলাকায় কৃষকের শরীরই মাটির চেয়ে উঁচু থাকে। তাই বজ্রপাতের সময় মাঠে বা খোলা জায়গায় যেখানে উঁচু কোনো গাছ নেই বা বজ্রনিরোধক ব্যবস্থা নেই সেখানে যারা থাকেন তারা শিকার হন।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের দেয়া তথ্যানুযায়ী প্রতি বছর বাংলাদেশে গড়ে বজ্রপাতে কমবেশি ২৬৫ জনের মৃত্যু হয়। গত এক যুগে তিন হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছেন। ২০২১ সালে মারা গেছে ৩৬৩ জন, ২০২০ সালে ২৩৬ জন, ২০১৯ সালে ১৬৮ জন, ২০১৮ সালে ৩৫৯ জন, ২০১৭ সালে ৩০১ জন, ২০১৬ সালে ২০৫ জন এবং ২০১৫ সালে ১৬০ মারা গেছেন। প্রতি বছর মার্চ থেকে মে মাসের মধ্যে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।
এদিকে, জামালগঞ্জে অনুষ্ঠিত বজ্রপাতের ক্ষয়ক্ষতি রোধে জনসচেতনতামূলক কর্মশালায় জানানো হয়, বিগত ২০১১ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সারাদেশে ১২ বছরে বজ্রাঘাতে তিন হাজার ১৬২ জনের মর্মান্তিক প্রাণহানি ঘটেছে। বজ্রাঘাতে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের প্রায় ৭০ শতাংশই কৃষক এবং বজ্রঘাতে মৃত্যুর ৯৩ শতাংশই সংঘটিত হয় গ্রামাঞ্চলে। এপ্রিল -জুন মাসে বজ্রবৃষ্টি বেশি হয়, বজ্রপাতের আশঙ্কা বেশি থাকে।
কর্মশালায় জানানো হয়, বজ্রাঘাত থেকে বাঁচার উপায় হল, আকাশে ঘন কালো মেঘ দেখা দিলে ঘরের বাইরে না যাওয়া। খোলা জায়গা খোলা মাঠ অথবা উঁচু স্থানে অবস্থান না করা, খোলা স্থানে থাকলে বজ্রপাত শুরু হলে প্রত্যেককেই ৫০ থেকে ১০০ ফুট দূরে সরে থাকা, বজ্রপাতের সময় ধান ক্ষেত বা খোলা মাঠে থাকলে দ্রুত পায়ের উপর ভর দিয়ে এবং কানে আঙ্গুল দিয়ে মাথা নিচু করে বসে থাকা। দ্রুত দালান বা কংক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় নেওয়া। টিনের চালা যথা সম্ভব এড়িয়ে চলা। উঁচু গাছপালা, বৈদ্যুতিক খুঁটি ও তার বা ধাতব খুঁটি, মোবাইল টাওয়ার ইত্যাদি থেকে দূরে থাকা। বজ্রপাতের সময় গাড়ির ভিতর অবস্থান করলে গাড়ির ধাতব অংশে শরীর না লাগানো, সম্ভব হলে গাড়ি নিয়ে দ্রুত কংক্রিটের ছাউনির নিচে অবস্থান করা। ঘরের জানালার কাছাকাছি ও বারান্দায় অবস্থান না করা। মোবাইল ক¤িপউটার, টিভি ফ্রিজসহ সকল বৈদ্যতিক সরঞ্জাম ব্যবহারে বিরত থাকা ও বন্ধ রাখা। ধাতব হাতলযুক্ত ছাতার বদলে প্রয়োজনে প্লাস্টিক বা কাঠের হাতলযুক্ত ছাতা ব্যবহার করা। ছাউনিবিহীন নৌকায় মাছ ধরতে না যাওয়া। সমুদ্র বা নদীতে থাকলে নৌকার ছাউনির নিচে অবস্থান করা। এসময় ধাতব কল, ধাতব রেলিং পাইপ ইত্যাদি সং¯পর্শ না করা। বিল্ডিংয়ে বজ্রনিরোধক দ- স্থাপন করা। বাসা ও বাড়িতে যথাসম্ভব আলাদা আলাদা স্থানে অবস্থান করা।
জামালগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের হল রুমে অনুষ্ঠিত কর্মশালায় সভাপতিত্ব করেন জামালগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মঈন উদ্দীন আলমগীর। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জামালগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিশ্বজিত দেব। বিশেষ অতিথি ছিলেন জামালগঞ্জ উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান গোলাম জিলানী আফিন্দী রাজু, সাচনা বাজার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মাসুক মিয়া ও সাবেক চেয়ারম্যান মো. নুরুল হক আফিন্দী, ফেনারবাঁক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কাজল চন্দ্র তালুকদার। অন্যান্যের মাঝে উপস্থিত ছিলেন জামালগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার (আর.এম.ও) মো. আব্দুল বাতেন, মেডিকেল অফিসার মো. শরীয়ত উল্লাহ, ডা. মো. ওমর ফারুক, ডা. আয়শা আক্তার সুমি, জামালগঞ্জ উপজেলা পরিষদ মসজিদের ইমাম হাফেজ মো. নুর উদ্দিন, জামালগঞ্জ প্রেসক্লাব সভাপতি তৌহিদ চৌধুরী প্রদীপ, সাধারণ স¤পাদক বাদল কৃষ্ণ দাস, কর্মশালার কো-অর্ডিনেটর কাজী সোহেল আহম্মদ ও অপু মাহমুদ, উপজেলা স্যানিটারি ইন্সপেক্টর মো. আহসান আলী, বেহেলী ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত সদস্যা বেবী রানী তালুকদার ও স্থানীয় সংবাদকর্মীবৃন্দ।