সাংবাদিকতায় এক অনন্য নাম হাসান শাহরিয়ার। হাওরের মাঠে-ঘাটে খেলে বেড়ে উঠা সন্তান বিশ্বের কাছে হয়ে উঠেন একজন জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। তাই তিনি ছিলেন সুনামগঞ্জ তথা আমাদের গর্ব ও অহংকার। সুনামগঞ্জ থেকে সাংবাদিকতায় তাঁর হাতেখড়ি। স্বীয় মেধা, পরিশ্রম ও ধর্মে তিনি সাংবাদিকতায় অনন্য অবদান রেখে যশস্বী হয়েছেন। তিনি বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। আন্তর্জাতিক অর্জনে তিনি অনন্য অবদান রেখেছেন। অর্জন করেছেন স্বীকৃতি ও সম্মান। শুধু সাংবাদিকতাই নয় সাংবাদিক সংগঠনেও তাঁর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত অনন্য। তিনি পাকিস্তানের করাচী প্রেসক্লাবের যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন। তিনি ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ছিলেন। তিনি বৈদেশিক সাংবাদিক সংস্থার (ওকার) সভাপতি ছিলেন। ছিলেন আন্তর্জাতিক কমনওয়েলথ সাংবাদিক সংস্থা (সিজেএ) সভাপতি। তার আগে এসব সংস্থায় সুনামগঞ্জ তথা বৃহত্তর সিলেটের কেউ অধিষ্ঠিত হতে পারেননি।
১৯৬২ সাল থেকেই তাঁর সাংবাদিক জীবনের শুরু। তিনি তখন সুনামগঞ্জ কলেজের ছাত্র। নিযুক্ত হন সুনামগঞ্জ ইত্তেফাক-এর প্রতিনিধি। এই সময় তিনি সুনামগঞ্জের সাপ্তাহিক ‘সুরমা’ পত্রিকার ছোটদের পাতা সম্পাদনা করতেন। তিনি সাথী ভাই হিসাবে অত্যন্ত সুনাম অর্জন করেন। তিনি ১৯৬৪ সালে করাচী চলে যান এবং সেখানে করাচী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে বিএ অনার্স এবং এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। তখনই তিনি করাচীর সাংবাদিকতায় আত্মনিয়োগ করেন।
তিনি করাচীর প্রখ্যাত ‘দৈনিক ডন’ পত্রিকার সিনিয়র রিপোর্টার ছিলেন। তিনি মধ্যপ্রাচ্যের ‘খালিজ টাইমস’, ভারতের ‘ডেকান হেরাল্ড’ পত্রিকা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘নিউজ উইক’-এর প্রতিনিধি ছিলেন। তিনি ঢাকার দৈনিক ইত্তেফাকের নির্বাহী সম্পাদক হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেন। তিনি করাচী প্রেসক্লাবের যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ বৈদেশিক সাংবাদিক সংস্থা ‘ওকাব’ এবং ঢাকা জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ছিলেন। তিনি কমনওয়েলথ প্রেস ইউনিয়ন ‘সি.জে.এ’ কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন। সাংবাদিকতায় অনন্য অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি তাঁকে ফেলোশীপ প্রদান করে। তিনি “অতীত অতীত নয়”, “শেষ ভাল যার সব ভাল তার”, “যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা” এবং “নিউজ উইক এ বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ, বিজয় এবং অতঃপর” শীর্ষক বই লিখেছেন।
হাসান শাহরিয়ার বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় সাংবাদিকতায় দক্ষ ও পারদর্শী ছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে মহান জাতীয় সংসদে গভীর শোক প্রকাশ করা হয়েছে এবং বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল তাকে মরণোত্তর সম্মাননা প্রদান করেছেন। তিনি সিলেট কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ ও সুনামগঞ্জ শহীদ জগৎজ্যোতি পাঠাগারের আজীবন সদস্য ছিলেন।
সাংবাদিক হাসান শাহরিয়ার বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর করাচী থেকে ফিরে এসে ঢাকার দৈনিক ইত্তেফাকে চীফ রিপোর্টার হিসাবে যোগদান করেন। পরে বিশেষ প্রতিনিধি ও ইত্তেফাকের নির্বাহী সম্পাদক নিযুক্ত হন। তিনি ইত্তেফাকের প্রতিনিধি হিসাবে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্ধিরা গান্ধির সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। এছাড়াও তিনি বিশ্বের অনেক নেতার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন এবং কমপক্ষে ২০ থেকে ২৫টি দেশ সফর করেছেন।
সাংবাদিক হিসেবে হাসান শাহরিয়ার ছিলেন শীর্ষস্থানীয় এবং তিনি বিভিন্ন দেশে সম্মান লাভ করেছেন। তিনি ২০২১ ইংরেজির ১০ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ১৯৪৬ ইংরেজির ২৫ শে এপ্রিল সুনামগঞ্জ-এ জন্মলাভ করেন। তাঁর পিতা মরহুম মকবুল হোসেন চৌধুরী আসাম বাংলার একজন খ্যাতনামা সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ ছিলেন। তিনি সিলেটের যুগবাণী, যুগভেরী এবং কলকাতার দৈনিক সুলতান পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। তিনি তদানিন্তন আসাম প্রদেশের একজন এমএলএ ও হুইপ ছিলেন। প্রখ্যাত সাংবাদিক হাসান শাহরিয়ার-এর অগ্রজ হোসেন তওফিক চৌধুরী একজন আইনজীবী ও কলামিস্ট।
হাসান শাহরিয়ার মৃত্যুতে মহান জাতীয় সংসদের এক শোক প্রস্তাবে তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয় এবং প্রেস কাউন্সিল তাঁকে আজীবন সম্মাননা প্রদান করেছে। এমন কীর্তিমানের মৃত্যুতে সুনামগঞ্জ তথা সারাদেশের অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হয়েছে। সাংবাদিকতার ইতিহাসে হাসান শাহরিয়ার তাঁর অবদানের জন্য স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন। আমরা তাঁর স্মৃতি ও অবদানের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি।
[লেখক : সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক সুনামকণ্ঠ]