একটা গল্প দিয়েই শুরু করি, রাজনৈতিক গল্প, শোনা গল্প। বহু মানুষের মুখে শুনেছি যখন, তখন গল্পটা অনেকেই জানেন, তারপরও নামগুলো ব্যবহার না করাটাই শ্রেয়।
একজন বিখ্যাত রাজনীতিবিদ। অসংখ্য, অগণিত শিষ্য সব সময় তাঁকে ঘিরে থাকে। এই শিষ্যদের অনেকেই আছেন শুধু গুরুকে সেবা দিয়েই খুশি। সেরকমই সেবা দানকারী একজন শিষ্য একদিন গুরুকে একা পেয়ে বললেন, হুজুর, আপনি কত মানুষকে নেতা বানালেন, আমি এই অধম কলিমুদ্দিন আপনাকে এতোদিন সেবা করে যাচ্ছি, এখনও নেতা হতে পারলাম না। গুরুজি বললেন, তুই নেতা হতে চাইছিস সেটা জানা ছিল না, ইনশাআল্লাহ হয়ে যাবি নেতা। পরের দিন বিশাল জনসভায় গুরুজি তাঁর বক্তব্যের মাঝে গর্জন করে উঠলেন, আইয়ুব খাঁন, আমাদের অস্ত্রের ভয় দেখাইও না, আমার কলিমুদ্দিনের কাছে যে অস্ত্র আছে সেইটাও তোমার কাছে নাই। ব্যাস, আর যায় কোথায়। গোয়েন্দারা ঐদিন রাতেই কলিমুদ্দিনকে ধরে নিয়ে গিয়ে বিশাল প্যাদানির সাথে কি অস্ত্র, কোথায় অস্ত্রের অনুসন্ধান করলো। বেশ কিছুদিন পর অবশেষে কালিমুদ্দিন ছাড়া পেল। জেল গেটে ফুলের মালা নিয়ে বিশাল সংবর্ধনায় পর গুরুজির কাছে কালিমুদ্দিনকে নিয়ে আসা হল। গুরুজি বললেন, কিরে কালিমুদ্দিন, নেতা তো বানাইয়া দিলাম। কালিমুদ্দিন গুরুজির পায়ে পরে বললো, হুজুর, নেতা হওয়ার চেয়ে আপনার সেবা করেই আমি ধন্য।
যাক, বর্তমানে ফিরে আসি। কিছুদিন আগে দেশের একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত একটি ছবি এবং ক্যাপশনে চোখ আটকে গেল। প্রথমত, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল হিসেবে সাত-আট বছরের কোন শিশুই স্কুল ছেড়ে শ্রমিক হিসেবে কাজ করে এটা জানা ছিল না। তারপরও, সাংবাদিকদের আমি সমাজের আয়না হিসেবে মনে করি, যে কারণে ধরেই নিচ্ছি এই শিশুটি একটি ব্যতিক্রম। তাহলে প্রশ্ন জাগে, সে হিসেব জানলো কি করে, কবে থেকে বাজারে যায় এবং বাজারের বর্তমান আর অতীতের দামের পার্থক্য সে কিভাবে করলো। সব ম্যাজিক।
কোভিড-১৯ এর ভয়াল থাবা থেকে বাংলার মানুষকে বিনাপয়সায় তিন ডোজ ভ্যাক্সিন দিয়ে যে নেত্রী বিশ্বকে হতবাক করে দিয়েছেন, কোভিড পরিস্থিতি এবং পরবর্তীতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ যখন সারা বিশ্বের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা টাল-মাটাল, সারা বিশ্বে জিনিসপত্রের দাম দুই-তিনগুন বৃদ্ধি পেয়েছে, সেখানে বিশ্ব মানবতার জননী দশ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুকে ঠাঁই দিয়ে বিশ্বকে যিনি বিস্মিত করেছেন, যিনি দেশের অর্থনীতির হাল এমন শক্ত ভাবে ধরেছেন যে, বিশ্বের নেতারা এক বাক্যে তাঁকে শুধুই প্রশংসার বাণী দিয়ে চলেছেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্য বিশ্ব নেতৃত্বের কাছে একটি উদাহরণ, সেই দেশের একটি পত্রিকা এমন একটি ক্যাপশনের ছবি ছাপালো কার ইন্ধনে সেটাই আমার কাছে বড় প্রশ্ন।
আসলে আমাদের মত মানুষেরা যারা ইত্যাদি পত্রিকার অপসাংবাদিকতা এবং গুজব তৈরির কারখানা দেখেছি, যারা দেখেছি ৫০টাকা দামের শাড়ি কিনতে না পেরে পাঁচশো টাকা দামের জাল পরা বাসন্তীর ছবি, তারা এই ধরনের প্রচারণায় আঁতকে উঠলে দোষের কিছু হবে বলে মনে হয় না। কিন্তু দুঃখ লাগে যখন দেশি-বিদেশি সাংবাদিকমহলের একটি অংশ এই ছবির পক্ষ নিয়ে কথা বলে। দুঃখ লাগে যখন দেখি তথাকথিত বিরোধী রাজনৈতিক দল ইনিয়ে-বিনিয়ে এই ছবির পক্ষে বলে অথচ তারাই স্বাধীনতার মাসে ইফতারের দাওয়াত দিয়ে সাংবাদিকদের মারধর করে। তারা ভুলে যায়, এখন আমরা ঔপনিবেশিক যুগে নেই। বিদেশিদের সমর্থনে বা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতায় বসার দিন শেষ। তারা ভুলে যায় সাংবিধানিক পদকে কটাক্ষ করাকে তাবৎ পৃথিবী শাস্তিযোগ্য অপরাধ মনে করে। সেখানে সাংবিধানিক পদ নয় কিংবা সংবিধানও নয়, খোদ দেশের স্বাধীনতাকে কটাক্ষ করা হয়েছে, স্বাধীনতাকে অপাঙ্ক্তেয় করা হয়েছে, দেশকে প্রশ্নের সম্মুখীন করা হয়েছে।
আমরা বাঙালি, আমরা ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছি, স্বাধীনতার জন্য যে রক্ত দিয়েছি সেটা পৃথিবীর ইতিহাসে নেই। অথচ সেই বাঙালির মাঝে বাংলা শব্দের সঠিক অর্থবোধ যাদের নাই, “স্বাধীনতা” শব্দটিকে যারা উপলব্ধি করতে পারে না, অবশ্যই তাদেরকে সমাজের আয়না হিসেবে অন্তত দেখা ঠিক হবে না। সাংবাদিকতা আর হলুদ সাংবাদিকতার পার্থক্য নির্ণয়ের জন্য প্রেস কাউন্সিলে যাওয়া যেতে পারে কিন্তু এটা তো হলুদ সাংবাদিমতা নয়, এটা সরাসরি দেশদ্রোহীতা। এবং সেই দেশদ্রোহীতার যে শাস্তি হওয়া প্রয়োজন সেটাই হতে হবে এবং শুধু কালিমুদ্দিন নয়, পেছনের হুজুরদেরকেও আইনের আওতায় আনতে হবে। অন্তত আর কিছু না হোক, বছর দশেক এদেরকে পরাধীনতার শৃঙ্খল পরিয়ে প্রতিদিন সরকারি খরচে মাছ-মাংস খেতে দিয়ে “স্বাধীনতা” শব্দটির মূল অর্থ তারা বুঝতে পারলো কিনা সেটা আমাদের জানার চেষ্টা করাটা অতীব জরুরি।
[লেখক আজিজুস সামাদ ডন : বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য]