দেশের বিল ইজারানীতির মূল কথা হলো মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের সদস্যদের নিয়ে গঠিত সমিতিকে নির্দিষ্ট রাজস্ব আদায় করে বিল ইজারা দেওয়া হবে। অর্থাৎ বিল ইজারা পেতে পারেন কেবল আদি-অকৃত্রিম জেলে সম্প্রদায়ের লোক, যাঁরা সমাজে কৈবর্ত অথবা মাহিমল বলে সবিশেষ বিখ্যাত। এই হলো বিল ইজারা দেওয়ার নীতির মূল কথা, আইন অন্তত তাই বলে। কিন্তু এই নীতি কোথাও মানা হচ্ছে না, কাগজে কলমে মৎস্যজীবী সম্প্রদায়কেই বিল ইজারা দেওয়া হচ্ছে বলে সাধারণত প্রতিপন্ন হয়, কিন্তু বিলের মালিকানা চলে যায় অমৎস্যজীবী ধনী লোকের দখলে। বিল ইজারা দেওয়ার সার্বিক প্রকরণ-প্রক্রিয়া ও বিষয়াদির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন ও প্রশাসনের বাইরের লোকজনেরা সকলেই বিল ইজারা দেওয়ার নীতির এইরূপ বরখেলাফি (মৎস্যজীবী সমিতিকে ইজারা দেওয়ার নামে অমৎস্যজীবীকে ইজারা দেওয়ার দুর্নীতি) সম্পর্কে পুরোপুরিই অবগত আছেন। অর্থাৎ তারা অবগত আছেন যে, কার্যত ও বাস্তবিক পক্ষে বিল ইজারা পাচ্ছেন কোনও না কোনও ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ অথবা বিপুল অর্থের মালিক অমৎস্যজীবী রাজনীতিক ক্ষমতার মদদপুষ্ট অন্য কেউÑ ইজারানীতি অনুসারে কোনও মৎস্যজীবী নন। সুতরাং দেশে বিদ্যমান বিল ইজারা নীতিটি একটি ত্রুটিপূর্ণ নীতি, এই নীতি বহাল থাকলে রাষ্ট্র ঘোষিত মৎস্যজীবী সমিতিকে বলি ইজারা দেওয়ার নীতি কখনওই কার্যকারিতা লাভ করবে না অর্থাৎ বাস্তব হয়ে উঠবে না, বরং মৎস্যজীবীবান্ধব রাষ্ট্রকে মৎস্যজীবী শ্রেণির বিরোধী করে তুলবে। যে-ইজারানীতিতে মৎস্যজীবীর অনুকূলে ইজারাপ্রাপ্তি নিশ্চিত না হয়ে অমৎস্যজীবীর অনুকূলে নিশ্চিত হয়ে পড়ে, সে-রূপ ত্রুটিপূর্ণ ইজারানীতি অবশ্যই রহিত করা উচিত এবং নীতিটিকে মৎস্যজবী সমিতি কিংবা সম্প্রদায়ের হাতে বিল ইজারা দেওয়া যাতে নিশ্চিত হয় সে-বিধান রেখে সংশোধন করে নেওয়া অবশ্য কর্তব্য।
অভিজ্ঞ মহলের ধারণা এই যে, বিল ইজারার জন্য মৎস্যজীবী সমিতির পক্ষ থেকে যে-রাজস্ব সরকারকে দিতে হয় তার পরিমাণ এতই বেশি যে, মৎস্যজীবী সমিতিকে সরকার নির্ধারিত ইজারার সে-টাকা ধনী ব্যক্তির কাছে বিল বিক্রির শর্তে সংগ্রহ করতে হয় এবং কাগজে কলমে বিলের মালিক সমিতি হলেও কার্যত বিলের মালিকানা বর্তায় ইজারার টাকা যিনি দিলেন তাঁর হাতে। বিল ইজারানীতি প্রণয়ন ও প্রয়োগের এই কেরদারিসমা (কেরদানি+ক্যারিসমা) শেষ পর্যন্ত বিপুল পুঁজির অধিকারী অর্থাৎ টাকাওয়ালা ব্যবসায়ী অথবা রাজনীতিবিদের স্বার্থোদ্ধারের হাতিয়ারে পর্যবসিত হয় এবং প্রকারান্তরে মৎস্যজীবী সমিতিকে, অনেকেই বলে থাকেন, একটি পকেট সংগঠনে পরিণত করে এবং এমন কি প্রায় ক্ষেত্রেই সংগঠিত মৎস্যজীবী সমিতিগুলো ইজারাদার কর্তৃক বিলের মালিক হয়ে উঠার সপ্রণোদিত প্রচেষ্টার সফল বাস্তবায়ন ভিন্ন অন্য কীছু হয়ে উঠে না। আইনের ফাঁক ব্যবহার করে সংঘটিত এই অন্যায় ও অনৈতিকতাকে প্রতিরোধ করা দরকার। বিদগ্ধমহল মনে করেন, এই অন্যায়-অনৈতিকতা প্রতিরোধ করার জন্য বিল ইজারানীতি বদলানো অবশ্যই দরকার। এই জন্য বিল ইজারা দেওয়ার ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট নিয়ম করতে হবে, যে-নিয়মের বলে বিল ইজারার টাকা মৎস্যজীবী সমিতিগুলো কর্তৃক পরিচর্যাকৃত (অর্থাৎ নির্ধারিত সময় পর্যন্ত ‘রাখ দেওয়া’ সম্পন্ন হওয়ার পর) বিল থেকে আহরিত মাছ বিক্রির টাকা হতে পরিশোধ করার অধিকরী হবেন। কারণ আইন প্রণয়ন কর্তৃপক্ষের জানা থাকা দরকার যে, ইজারাপ্রাপ্তির বিপরীতে দেয় রাজস্ব বা ইজারামূল্য দেওয়ার টাকা গরিব জেলে সমিতির বা সমিতিতে যাঁরা সদস্য হন তাঁদের সকলের আর্থিক সামর্থ্যরেও চেয়েও বেশি। এই জন্য ধনী কারও কাছ থেকে টাকা নিয়ে ইজারামূল্য পরিশোধ করে তাঁরা বিলের মালিক হয়ে উঠতে পারেন না, প্রকারান্তরে বিল ইজারাপ্রাপ্তির আগেই বিক্রি হয়ে যায় এবং এই আইন কার্যত জেলে সম্প্রদায়ের কোনও উপকারে আসে না। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে, সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় যে-কেউ এমন ভাবতেই পারেন বা তাঁর মনে হতেই পারে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এই বিষয়টি জেনেও না জানার ভান করেন বা করছেন। এমন পরিপ্রেক্ষিতে স্বাভাবিকভাবেই জনমনে এই ভাবনার উদ্রেক হতে পারে যে, কোনও একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের প্রতি জেনেশুনে এমন অবিচার করাটা আইনে বৈধ করে নেওয়া হলেও ন্যায়সঙ্গত নয়, এমনকি সেটা সভ্যসমাজের লক্ষণ হতে পারে না।
সম্পাদকীয়র বহর বেড়ে যাবে বলে আপাতত আর কীছু বলতে চাই না। কেবল বলি এই নীতিটি অর্থাৎ বিল ইজারার টাকা মৎস্যজীবী সমিতিগুলোকে ইজারা দেওয়া বিল থেকে আহরিত মাছ বিক্রির টাকা হতে পরিশোধ করার অধিকরী করার নীতি বহাল করতে হবে এবং এই নীতিটি বহাল করলেই বিল ইজারা নেওয়ার ক্ষেত্রে গরিব মৎস্যজীবীদের উপর ধনী অমৎস্যজীবীদের দৌরাত্ম্য অবশ্যই বন্ধ হবে। তাছাড়া নীতিটা বাস্তবায়নও খুব সহজ হবে বলেই মনে হয়।