1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
  3. [email protected] : wp-needuser : wp-needuser
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৭:১৫ পূর্বাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

স্যার’ সংকটের সমাধান কী? : আমীন আল রশীদ

  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ৩০ মার্চ, ২০২৩

শিক্ষক ও সরকারি কর্মকর্তাদের ‘স্যার’ সম্বোধন করার রেওয়াজ বহু পুরনো। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এমনকি প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষককেও তার চেয়ে বয়স্ক মানুষেরা ‘স্যার’ বলে ডাকেন- বাংলাদেশে এটি খুব সাধারণ দৃশ্য। কিন্তু তারপরও মাঝে মধ্যে ‘স্যার’ ইস্যুতে যে জটিলতা সৃষ্টি হয়; ‘স্যার’ না ডাকায় ক্ষুব্ধ ডিসি, ইউএনও ইত্যাদি শিরোনামে যে সংবাদ শিরোনাম হয়, তার কারণ কী এবং এ থেকে উত্তরণের উপায় কী?
যাদের এখন স্যার সম্বোধন করা হয়, একসময় তাদের মহাশয়, গুরুমশাই, হুজুর ইত্যাদি ডাকা হতো। বিশেষ করে শিক্ষকদের গুরুজি, গুরুমশাই আর ক্ষমতাবান লোকদের হুজুর। রাজাকে তার অধীনস্থরা হুজুর বলতেন। এখনও মাদ্রাসার শিক্ষকদের হুজুর বলা হয়। ‘হুজুর’ শব্দটি এসেছে আরবি ‘হাজি’র থেকে। যার অর্থ উপস্থিত। অর্থাৎ কাউকে ‘হুজুর’ বলা মানে এটি বোঝানো যে তিনি উপস্থিত আছেন। পরবর্তীতে হুজুর ও মহাশয়ের জায়গা দখল করে ‘স্যার’। স্যার শব্দটি এই ভূখ-ে এসেছে ব্রিটিশ আমলে থেকে। যদিও শব্দটির উৎপত্তি নিয়ে নানারকম মত প্রচলিত আছে। কেউ কেউ মনে করেন, শুরুতে ঝওজ বলতে বুঝানো হতো ঝষধাব ও জবসধরহ, পরবর্তীতে ঝবৎাধহঃ ও জবসধরহ. অর্থাৎ কারও কাছে নিজেকে দাস অথবা চাকর হিসেবে সঁপে দেওয়ার রেওয়াজ থেকেই শব্দটির উৎপত্তি। যদিও এখন আর এই অর্থে এটি ব্যবহৃত হয় না। বরং এখন স্যার বলা হয় হুজুর, মহাশয়, মাননীয়, জনাব ইত্যাদির প্রতিশব্দ হিসেবে। যে কারণে অনেক সময় মাদ্রাসার শিক্ষকদেরও ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করা হয়। সেই একই যুক্তিতে এখন যাদের স্যার বলা হয়, তাদের হুজুর বললেও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু মুশকিল হলো আমাদের ডিসি, এসপি, ইউএনও বা প্রশাসনের লোকেরা হুজুর শুনলে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠবেন। অথচ স্যার ও হুজুর একই অর্থে ব্যবহৃত হয়। এমনকি তাদের যদি মহাশয়, মাননীয়, জনাব ইত্যাদি বলে সম্বোধন করা হয়, তাতেও তারা গোস্বা করবেন। তারা মূলত স্যার শব্দটিই শুনতে চান। কিন্তু কেন?
যারা স্যার শব্দটি শোনার জন্য ব্যাকুল থাকেন বা স্যার না শুনলে ক্ষুব্ধ হন, এটি তাদের মানসিক সংকট। চিন্তার সীমাবদ্ধতা। সর্বোপরি এটি তাদের ক্ষমতার বিকার। তারা মনে করেন, স্যার না বললে তাদের বোধহয় উপযুক্ত সম্মানটি দেওয়া হচ্ছে না। অথচ বিশ্বের অনেক দেশেই অধ্যাপকদেরও নাম ধরে ডাকার রেওয়াজ আছে। জনপ্রতিনিধি এবং প্রশাসনের শীর্ষ ব্যক্তিদেরও মি. অমুক বলে ডাকাই তাদের কাছে স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের দেশে একজন জেলা প্রশাসককে যদি মি. রহমান বা মিজ সালমা বলে কোনও সেবাগ্রহীতা সম্বোধন করেন, তাহলে নির্ঘাৎ ওই জেলা প্রশাসক চেয়ার থেকে লাফ দিয়ে উঠবেন এবং সেবাগ্রহীতাকে সেবা দেওয়া তো দূরে থাক, তাকে রুম থেকে বের করে দেবেন (দুয়েকজন ব্যতিক্রম থাকতে পারেন)।
কেন এমনটি হয়? :
বলা হয়, এটি হচ্ছে ব্রিটিশ শাসনের ভূত। মগজে শাসনের ভূত। আমাদের দেশের লোকেরা দায়িত্ব বা ক্ষমতা পেলেই শাসন করতে চায়। বিশেষ করে যাদের হাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থাকে। যে কারণে জনপ্রতিনিধি, তিনি ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য হন কিংবা মন্ত্রী – তাদের স্যার বলার কোনও রেওয়াজ নেই এবং তাদের স্যার না বললে তারা মাইন্ডও করেন না। কিন্তু খুব ব্যতিক্রম না হলে একজন ইউএনও সাহেবও স্যার না শুনলে মনে করেন সেবাগ্রহীতা জনগণ বোধহয় তাকে সম্মান দিচ্ছে না। অর্থাৎ জনগণ তাকে সম্মান দিলো কী দিলো না, সেটি নির্ভর করছে স্যার ডাকার ওপরে। এটি তার চিন্তার সীমাবদ্ধতা। বোধের বিকার।
বাস্তবতা হলো, সরকারি অফিসে সেবা নিতে গিয়ে সাধারণ মানুষ সংশ্লিষ্ট অফিসারকে বরাবরই ‘স্যার’ বলে আসছেন। এটিকে তারাও স্বাভাবিক বলে মনে করেন। এমনকি দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীদেরও স্যার বলার রেওয়াজ আছে। সমাজের অতি সাধারণ মানুষ যখন কোনও সরকারি অফিসে কোনও কাজের জন্য যান, তারা এমনকি আনসারকেও স্যার বলেন। তারা মনে করেন, এটিই স্বাভাবিক এবং আনসার থেকে শুরু করে সচিব সিনিয়র সচিব – এদের ব্যাপারে সবসময়ই সাধারণ মানুষের মনে এক ধরনের ভীতি কাজ করে। কারণ, তারা জানেন, তাদের কলমের খোঁচা ও স্বাক্ষরে অনেক কিছুই বদলে যায়। মূলত এই ভীতি থেকেই সেবাগ্রহীতা জনগণের ঠোঁটের আগায় ‘স্যার’ শব্দটি লেগে থাকে। আর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যেহেতু বছরের পর বছর ধরে এভাবে ‘স্যার’ শুনে অভ্যস্ত এবং ‘স্যার’ শব্দের সঙ্গে এক ধরনের ক্ষমতাচর্চার বিষয় রয়েছে, ফলে যখন কেউ তাদের ‘স্যার’ না বলে ভাই বা আপা সম্বোধন করেন, তখন তাদের অনেকেই অসম্মানিত বোধ করেন।
সরকারি কর্মকর্তাদের কারা স্যার বলতে চান না? :
প্রধানত দুই পেশার মানুষ কাউকে স্যার বলতে চান না। এক. সাংবাদিক, দুই. শিক্ষক। পেশাগত কারণে সাংবাদিকদের সঙ্গে যেহেতু রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এমনকি রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, ¯িপকারেরও ব্যক্তিগত পরিচয় থাকে, সখ্য থাকে এবং এরকম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের তারা যেহেতু ভাই ও আপা সম্বোধন করেন, ফলে সাংবাদিকরা প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ‘স্যার’ বলতে চান না। এখানে সাংবাদিকদের ইগো এবং ক্ষমতাচর্চার বিষয়টিও কাজ করে। এটি রাজধানীকেন্দ্রিক এবং মূলধারার পরিচিত সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে বেশি দেখা যায়। কিন্তু জেলা বা উপজেলা পর্যায়ের সাংবাদিকরা সাধারণত ডিসি, এসপি এবং ইউএনওদেরও স্যার বলেন। যেহেতু অধিকাংশ সাংবাদিকই ‘স্যার’ বলেন, ফলে তাদের মধ্যে কেউ যখন ‘স্যার’ না বলেন, তখনই জটিলতা সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ সবসময় ‘স্যার’ শুনে অভ্যস্ত অফিসারের তখন এটি গায়ে লাগে। তিনি মনে করেন, ওই সাংবাদিক বা শিক্ষক বা অন্য কোনও পেশার মানুষটি বোধহয় তাকে সম্মান দিচ্ছেন না। অর্থাৎ ‘স্যার’ শব্দের উৎপত্তি যা-ই হোক না কেন, তিনি এটিকে সম্মানসূচক মনে করেন এবং কেউ তাকে ‘স্যার’ না বললেই তিনি রেগে যান। এই রেগে যাওয়ার পেছনে আছে তার নিজেকে ক্ষমতাবান ভাবা এবং সংবিধান ও আইনবলে তিনি যে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, অর্থাৎ জনগণের সেবা করাই যে তার মূল কাজ – সেটির বিস্মৃতি।
যে জনগণের করের পয়সায় তার বেতন হচ্ছে, সেই জনগণকে যেভাবে সম্মান করা উচিত ছিল, প্রশাসনের কর্তারা ঠিক সেটির বিপরীতে হাঁটেন। তারা বরং জনগণকেই তাদের প্রজা ভাবেন। জনগণকে প্রজা ভাবার এই মানসিকতার পেছনে রয়েছে ব্রিটিশ কলোনিয়াল ভূত। অথচ সেই ব্রিটেনেও সরকারি কর্মচারীদের এভাবে স্যার বলার রেওয়াজ নেই। কেউ চাইলে স্যার বলতে পারেন, নাও বলতে পারেন। কিন্তু স্যার না বলায় তুলকালাম কা- হয়েছে – এরকমটি শোনা যায়নি।
তাহলে সমাধান কী? :
সমাধান খুব সহজ। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় একটি পরিপত্র জারি করে বলে দিতে পারে যে সরকারি অফিসে সেবা নিতে যাওয়া জনগণ কাউকে স্যার বলতে বাধ্য নন। কেউ যদি স্যার বলেন সেটি তার স্বাধীনতা। কিন্তু স্যার না বললে কারও সঙ্গে অশোভন আচরণ করা বা তাকে সেবা থেকে বঞ্চিত করা হলে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এক্ষেত্রে সরকারি কর্মচারী আইনেও ‘সম্বোধন’ নামে একটি নতুন ধারা যুক্ত করে বিষয়টি পরিষ্কার করা যায়।
পরিশেষে, সরকারি কর্মকর্তাদের ‘স্যার’ বলা না বলা কোনও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। এটি নিয়ে কিছু দিন পরপর যে জটিলতা সৃষ্টি হয়, সেটিও অনাকাক্সিক্ষত, অপ্রয়োজনীয় এবং হাস্যকর। বরং সরকারি অফিসের লোকজন ঠিকমতো জনগণকে সেবা দিচ্ছেন কিনা; সরকারের একটি প্রতিষ্ঠানেও সাধারণ মানুষ বিনা পয়সায় সেবা পাচ্ছে কিনা; সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ঠিকমতো কাজ করছেন কিনা; তারা কীভাবে জনগণকে হয়রানি করছেন; জনগণের করের পয়সায় গৃহীত উন্নয়ন প্রকল্প থেকে কী পরিমাণ টাকা খেয়ে ফেলছেন – এসবই হওয়া উচিত মূল আলোচনা। রাজধানী থেকে উপজেলা পর্যন্ত প্রতিটি সরকারি অফিসে এ বিষয়ে সরেজমিন প্রতিবেদন হওয়া দরকার। সরকারি অফিসে সেবাদানের প্রকৃত চিত্র গণমাধ্যম ও সোশাল মিডিয়ায় আসতে থাকলে উল্টো তারাই জনগণকে ‘স্যার’ বলা শুরু করবেন। [সংকলিত]
লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com