স্টাফ রিপোর্টার ::
ভাটিবাংলার কৃতী সন্তান, শোষিত-নিপীড়িত মানুষের বিপ্লবী কণ্ঠস্বর, সঙ্গীত ও সমাজমুক্তি যুগলমন্ত্রে দীক্ষিত, মরণোত্তর দেহদানকারী কমরেড শ্রীকান্ত দাশ স্মরণে মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও লেখক তাজুল মোহাম্মদ সম্পাদিত এবং সাহিত্য প্রকাশ কর্তৃক প্রকাশিত ‘মুক্তিযোদ্ধা শিল্পী সংগ্রামী কমরেড শ্রীকান্ত দাশ’ স্মারকগ্রন্থের প্রকাশনা অনুষ্ঠান শনিবার (২৫ মার্চ) সকাল ১১টায় সিলেট জেলা পরিষদ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়েছে। অনুষ্ঠানে শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ, আইনজীবী, লেখক-সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষজন উপস্থিত ছিলেন।
সিলেট মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির উপাচার্য প্রফেসর ড. মোহাম্মদ জহিরুল হকের সভাপতিত্বে ও অ্যাডভোকেট আনোয়ার হোসেন সুমনের পরিচালনায় প্রকাশনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এম এম আকাশ।
অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন গ্রন্থের সম্পাদক ও বাংলা অ্যাকাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক মুক্তিযুদ্ধ গবেষক তাজুল মোহাম্মদ। অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন গণতন্ত্রী পার্টি কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ব্যারিস্টার মো. আরশ আলী, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি সিলেট জেলা কমিটির সাবেক সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা কমরেড বেদানন্দ ভট্টাচার্য, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী সিলেটের সভাপতি কবি এনায়েত হাসান মানিক ও খেলাঘর সিলেটের সভাপতি অধ্যাপক তাপসী চক্রবর্তী লিপি।
এছাড়া অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন সুনামগঞ্জ সিপিবি’র সাবেক সভাপতি কমরেড প্রভাংশু চৌধুরী, কমরেড শ্রীকান্ত দাশ’র ছেলে দুরন্ত দাশ, সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট এমাদ উল্লাহ শহিদুল ইসলাম, দিরাই উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মঞ্জুরুল আলম চৌধুরী, সুনামগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট শহীদুজ্জামান চৌধুরী, কমরেড অমর চাঁদ দাস, বীর মুক্তিযোদ্ধা ব্রজেন্দ্র লাল দাস, দিরাই সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মিহির রঞ্জন দাস, ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি সিলেটের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট শামসুল ইসলাম, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি সিলেটের সভাপতি কমরেড সৈয়দ ফরহাদ হোসেন, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি সিলেটের সভাপতি কমরেড গণতন্ত্রী পার্টি সিলেটের সভাপতি মো. আরিফ মিয়া, বাসদ (মার্কসবাদী) সিলেটের সমন্বয়ক কমরেড উজ্জ্বল রায় প্রমুখ।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. এম এম আকাশ বলেন, কমরেড শ্রীকান্ত দাশ ছিলেন সর্বাংশে ও সব দিক থেকে একজন প্রকৃত ‘গণমানুষের’ লোক। সাধারণ মানুষ বিশেষত মেহনতি মানুষের প্রতি তাঁর ছিল অকৃত্রিম ভালোবাসা। তাদের সাথে তাঁর ছিল নাড়ির বন্ধন। হাওরের পানিতে যেভাবে মাছ বিচরণ করে, মানুষের মাঝে শ্রীকান্ত দাশের অবস্থান ছিল অনেকটা তেমনই – সহজ, সরল, স্বাভাবিক, সাবলীল। এতে ছিল না বিন্দুমাত্র কৃত্রিমতার ছোঁয়া। তিনি ছিলেন একজন নিষ্কলুষ মানবদরদী। একই সাথে ছিলেন একজন নির্ভেজাল কমিউনিস্ট। সে কারণে তার মানবিকতা ছিল ‘বিপ্লবী মানবিকতা’ এবং তার কমিউনিস্ট দীক্ষা ছিল গভীর মানবিকতায় পুষ্ট। তিনি কমিউনিস্ট পার্টি, উদীচী, কৃষক সমিতি, ক্ষেতমজুর সমিতি ইত্যাদি সংগঠনের কাজে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। যুক্তফ্রন্টের সময়ের আগে থেকেই রাজনৈতিক সংগ্রামে তিনি সামিল ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন আত্মসচেতন সাহসী মুক্তিযোদ্ধা। আমৃত্যু তিনি মাঠে-ময়দানে বাস্তব সংগ্রামের লড়াকু সৈনিক ছিলেন।
তিনি বলেন, কমরেড শ্রীকান্ত দাশের কর্মকা-ের অন্য আরেকটি বিশেষ ক্ষেত্রও ছিল। তিনি একই সাথে ছিলেন সাংস্কৃতিক জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি নিজে গান গাইতেন, গান রচনা করতেন, গান শেখাতেন। জনসভা, সমাবেশ, বৈঠকে গান গাইতেন। গানের মাধ্যমে জনগণ, বিশেষত কৃষক সমাজকে সচেতন ও সংগ্রামে উজ্জীবিত করতেন। তিনি ছিলেন উদীচী’র একজন অনুপ্রেরণাদানকারী উৎসাহী সংগঠক ও নেতা। এটি মোটেই কাকতলীয়ভাবে ঘটে যাওয়া কোনো ব্যাপার ছিল না। শ্রীকান্ত দাশের জীবনাদর্শ এবং ব্যক্তি হিসেবে তাঁর প্রকৃতি উভয়ের সাথে তা ছিল একান্তভাবেই সামঞ্জস্যপূর্ণ।
সভাপতির বক্তব্যে প্রফেসর ড. মোহাম্মদ জহিরুল হক বলেন, সাম্যবাদী আন্দোলনের মাঠ পর্যায়ের আলোকবর্তিকা ছিলেন প্রয়াত কমরেড শ্রীকান্ত দাশ। জীবনভর লাল নিশান অসীম সাহসে বুক চিতিয়ে উড়িয়েছেন। ছিলেন দুঃসাহসী, দুরন্ত ও দুর্বিনীত গণসংগ্রামী অনন্য এক মানুষ। মানবমুক্তির মহান সংগ্রামে রত ছিলেন আজীবন। শোষণ ও বঞ্চনামুক্ত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে সমবেত থেকেছিলেন আমৃত্যু। আদর্শিক লক্ষ্যে ছিলেন একেবারেই অবিচল। তিনি সমাজতন্ত্রের দীক্ষাসহ নিয়েছিলেন মানুষ, জীবন, সমাজ, পৃথিবীকে ভালোবাসার পাঠ। পার্থিব বিষয় সম্পদে ছিলেন উদাসীন। তবে মানুষের কষ্ট লাঘবে ছিলেন একনিষ্ঠ, দৃঢ় ও উদার। তাঁর প্রয়াণে স্বজন হারানোর গভীর বেদনায় কষ্টনীল হয়েছে অজ¯্র রাজনৈতিক সহচর ও পরিবার।
উল্লেখ্য, ভাটি অঞ্চলের হাওর জনপদের বিপ্লবী কমরেড শ্রীকান্ত দাশ ২০০৯ সালের ১৯ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। জীবিতকালে আইনগত হলফপূর্বক প্রতিশ্রুতি থাকায় তার দেহ দান করা হয় সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।