গত সোমবার (২০ মার্চ ২০২৩) ‘হৃদয়ে জাগে একাত্তর’ গ্রন্থের মোড়ক উন্মেচন হয়ে গেল সুনামগঞ্জের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি পাবলিক লাইব্রেরিতে। সেখানে প্রধান অতিথির ভাষণে পৌর মেয়র নাদের বখত বলেছেন, ‘এই গ্রন্থের মাধ্যমে আগামী প্রজন্ম জানতে পারবে কারা স্বাধীনতা যুদ্ধে বিরোধিতা করেছিল।’ এই বই সম্পর্কে এমন কথা খুবই খাঁটি কথা। গ্রন্থকার অন্তত গণহত্যার ভয়াবহতার অনুপুঙ্খ বর্ণনা হাজির করতে পেরেছেন বিভিন্ন প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে সরাসরি আলাপচারিতা থেকে রসদ নিয়ে। কিন্তু কথা হলো ‘আগামী প্রজন্ম’র পূর্বপ্রজন্ম কিংবা পূর্বসূরিরা একাত্তরের যুদ্ধকালে যুদ্ধাপরাধীদের দ্বারা সংঘটিত হত্যাকা- ও নির্যাতন সম্পর্কে কম বেশি সকলেই জানতেন এবং জানেন। তাছাড়া এরচেয়ে তাৎপর্যবহ ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে তাঁরা (‘আগামী প্রজন্ম’র পূর্ব প্রজন্ম) যুদ্ধবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে কোনওরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। এমনকি বঙ্গবন্ধুর যুদ্ধাপরাধীর বিচার নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে প্রণীত দালাল আইনকে উপেক্ষা করা হয়েছে, কার্যত কার্যকর করা হয়নি, বরং একশ্রেণির মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা নিয়ে রাজকাররা সামাজিক ও রাজনীতিকভাবে পুনর্বাসিত হয়ে সমাজে ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং অর্থনীতিকে শক্তিশালী করেছে, যে-অর্থনীতি এখন সাহায্য করে চলেছে দেশের ভেতরে জঙ্গিবাদী উত্থানকে উসকে দিতে, সাম্প্রদায়িকতাকে উজ্জীবিত করতে।
দিরাই-শাল্লার চিহ্নিত রাজাকারদের বিরুদ্ধে পূর্বপ্রজন্মের বিখ্যাত রাজনীতিবিদরা নিজেদের নির্বাচনী স্বার্থে অর্থাৎ ভোটে জয় লাভ করার স্বার্থে রাজাকারদের বিরুদ্ধে কোনও আইনী বা সামাজিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। অথচ তাঁরা প্রত্যেকে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে দেশ স্বাধীন করেছিলেন এবং এমনকি দেশের ভেতরে প্রখ্যাত রাজনীতিক হিসেবে ছিলেন উচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। এমনকি সুনামগঞ্জের পৌর রাজনীতিও তার ব্যতিক্রম নয়।
শেষ পর্যন্ত দিরাই-শাল্লার পরিসর প্রেক্ষিতে মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিতদের পক্ষে দাঁড়িয়ে গণহত্যার বিচার দাবি করার কার্যক্রমের সূত্রপাত করেছেন অমর চাঁদ দাশ নামের একজন বামপন্থী। তারই ধারাবাহিকতায় বেরিয়েছে মানসী সাহার ‘হৃদয়ে জাগে একাত্তর’। তিনিই এখানে এই বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানের মূল উদ্যোক্তা।
আমরা আশাকরি, মুক্তিযুদ্ধকালে স্বাধীনতাবিরোধীদের দ্বারা সংঘটিত হত্যাকা- ও নির্যাতনের কাহিনী উন্মোচন করা ‘হৃদয়ে জাগে একাত্তর’-এর মতো আরও বই রচিত হবে প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণে সমৃদ্ধ হয়ে এবং আগামী প্রজন্মের পক্ষে জানতে পারাই কেবল নয়, সেই সঙ্গে বরং তাঁদের মধ্যে এই সব যুদ্ধাপরাধী ও তাদের মানসপুত্র উত্তরসূরিদের সমাজ থেকে নির্মূলকরণের আন্দোলনের সূচনা করবে।