স্টাফ রিপোর্টার ::
সুনামগঞ্জে পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেসি কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়েছে। শনিবার সকাল ১০টায় জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সম্মেলন কক্ষে এই কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। কনফারেন্সে ফৌজদারি মোকদ্দমা নিষ্পত্তিতে প্রতিবন্ধকতা ও সমাধান বিষয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানসহ দেশে প্রচলিত অন্যান্য আইনের আলোকে পারস্পরিক আলোচনা ও মতবিনিময়ের মাধ্যমে সুনামগঞ্জ জেলার ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার বিভিন্ন সমস্যাসমূহ চিহ্নিতকরণ ও সেগুলোর সম্ভাব্য সমাধান নির্ধারণ এবং বিচার প্রার্থী মানুষের প্রার্থিত বিচারিক সেবাসমূহ দ্রুত ও সহজে প্রদান সুনিশ্চিত করণ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রস্তুত করা হয়।
চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত কনফারেন্সে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ বেগম মোসাম্মৎ জাকিয়া পারভীন। তিনি বলেন, আমার যোগদানের পরপর ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছিল। এই সময় থেকে আজ পর্যন্ত যেসব মামলা হয়েছে, দায়ের করা মামলার নথিতে ইনজুরি সার্টিফিকেট থাকে না, পিএম রিপোর্ট নেই, ইউকেএস রিপোর্ট পাওয়া যায় না, ইনকুয়েস্ট রিপোর্টও থাকে না। তখন আমাদের খুব যন্ত্রণা হয়। একজন মানুষের প্রতি ন্যায়বিচার পরিচালনা করতে নানা অসুবিধায় পড়তে হয় আমাদের।
তিনি বলেন, আজ এসব বিষয় নিয়ে কনফারেন্সের আয়োজন করা হয়েছে। এই কনফারেন্সে মামলা পরিচালনায় আমাদের যতটুকু বিলম্ব, বুঝার ভুল বা দিকনির্দেশনা দরকার তা আলোচনা করে সক্রিয় হবো। যাতে মানুষ দ্রুততম সময়ের মধ্যে ন্যায়বিচার পেতে পারে।
তিনি বলেন, মারামারি বা খুনের ঘটনায় বিচার শুরু হয় পুলিশের রিপোর্ট থেকে। যদি ওই জায়গায় অবহেলা হয়, তখন বিচারকার্য পরিচালনা করতে কষ্ট হয় আমাদের। সঠিক ও সকল নথিপত্র সংযুক্ত করে না দিলে কীভাবে বিচার করা যাবে। এই জন্য অপেক্ষা করতে হয় মাসের পর মাস। তিনি বলেন, মারামারি বা খুনের ঘটনায় প্রথমে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগের রেজিস্ট্রার থেকে তথ্য উদ্ধার করা যায় অনেকটা। ওই কমপ্লেক্স থেকে চিকিৎসা নেয়া হয় প্রথম। একজন তদন্তকারী অফিসার এই জরুরি বিভাগ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে নিতে পারেন। আহত বা নিহতের প্রাথমিক চিকিৎসার তথ্য নথিতে যুক্ত করতে হবে।
সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ বেগম মোসাম্মৎ জাকিয়া পারভীন বলেন, ন্যায়বিচার বা সুবিচার করা কারো একার সম্ভব নয়। সংশ্লিষ্ট সকলের সমন্বয় থাকতে হবে। তবেই দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচারকার্য স¤পন্ন করা সম্ভব হবে। তিনি আরও বলেন, পারিবারিক মামলার প্রতিবেদন পাওয়া যায় না। প্রতিবেদন না পাওয়ায় থানার অবহেলা রয়েছে। কোনো ঘটনায় মামলা হলে দ্রুত তদন্তকাজ শেষ করে সকল নথিপত্র দাখিল করার নির্দেশনা দেন মোসাম্মৎ বেগম জাকিয়া পারভীন। তিনি আরও বলেন, পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেসি কনফারেন্স ফৌজদারি মামলায় ন্যায়বিচার নিশ্চিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। এর মাধ্যমে ন্যায়বিচার নিশ্চিৎ করার পথে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা দূর হবে। বিচার বিভাগের সব অংশীদারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের বিচার পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করা সহজ হবে।
কনফারেন্সের শুরুতেই সভাপতি হিসেবে স্বাগত বক্তব্য রাখেন চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ রোকন উদ্দিন কবির। তিনি বলেন, একটি দেশের গণতান্ত্রিক সফলতা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার উপর নির্ভর করে। কোনো দেশের সরকারের কৃতিত্বের পরিমাণ করার সর্বোচ্চ মাত্রাটি হচ্ছে বিচার বিভাগের দক্ষতা এবং যোগ্যতা। মানুষের সমস্যা সমাধানের শেষ আশ্রয়স্থল হচ্ছে আদালত। আদালতের প্রতি মানুষের বিশ্বাস ও আস্থা আছে বলেই বার বার আদালতের দ্বারস্থ হন। আদালত যদি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে তবে ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের সংবিধান আমাদের সর্বোচ্চ আইন। সংবিধানে বলা হয়েছে, প্রত্যেক নাগরিকের সুযোগের সমতা তৈরি করতে রাষ্ট্র সচেষ্ট থাকবে। সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান। আইনে আশ্রদানের অধিকারী।
তিনি আরও বলেন, সুবিচার প্রাপ্তি হচ্ছে একজন নাগরিকের জন্মগত অধিকার। আমরা কাউকে ন্যায়বিচার প্রাপ্তি হতে বঞ্চিত করব না। ন্যায়বিচার দিতেও বিলম্ব করব না।
তিনি বলেন, ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার সাথে বিচার বিভাগ, পুলিশ বিভাগ, স্বাস্থ্য বিভাগ একে অপরের পরিপূরক হিসাবে কাজ করছে। কাজে আরও বেশি পার¯পারিক সমন্বয় থাকলে নবদিগন্ত উন্মোচিত হবে। ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থা যেসব কাঠামোর উপর প্রতিষ্ঠিত, সেটাকে করবে আরও বেশি বিকশিত।
চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ রোকন উদ্দিন কবির আরও বলেন, ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার সাথে প্রত্যেক বিভাগ প্রত্যক্ষ এবং ওৎপ্রোতভাবে জড়িত। তাই সংস্থা সমূহের যেকোনো একটি অঙ্গ যদি দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন না করে, তখন বিচার বিভাগের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তাই সকলে মিলে সচেতনভাবে কাজ করতে হবে। আইনের শাসন আমাদেরই বাস্তবায়ন করতে হবে।
তিনি বলেন, ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ হয়। এরপর থেকে চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ১ লাখ ৫ হাজার ৩২টিরও বেশি মামলা নি®পত্তি হয়েছে। আপনার আমার সকলের সহযোগিতা থাকলে নি®পত্তির ধারাবাহিকতা আরও বৃদ্ধি পাবে।
কনফারেন্সে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন পুলিশ সুপার মোহাম্মদ এহসান শাহ, অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নিশাদুজ্জামান, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এ.কে.এম আব্দুল্লাহ বিন রশিদ, সিভিল সার্জন ডা. আহম্মদ হোসেন।
অনুষ্ঠানে মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বেগম ইসরাত জাহান, পিপি অ্যাড. খায়রুল কবির রুমেন, অ্যাডিশনাল পিপি অ্যাড. সামছুল আবেদীন, জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি মো. তৈয়বুর রহমান বাবুল, সাধারণ স¤পাদক মো. আব্দুল হক, গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী ইকবাল সিকদার, জেল সুপার সফিউল আলম, সদর মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ মো. ইখতিয়ার উদ্দিন চৌধুরী, জামালগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ মীর মো. আব্দুন নাসের, ডিবি ওসি নন্দন কান্তি ধর, সিআইডি ইন্সপেক্টর বিকাশ চন্দ্র দাস।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিজিবি’র কমান্ডিং অফিসার মাকসুদুল আলম, সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মিছবাহ উদ্দিন আহমদ, জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুল হালিম, সিনিয়র সহকারী জজ আনিসুর রহমান প্রমুখ।
মুক্ত আলোচনার আগে বিচার বিভাগ নিয়ে উপস্থাপনা করেন সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটবেগম মৈত্রী ভট্টাচার্য্য। ফৌজদারি মোকদ্দমা নি®পত্তিতে প্রতিবন্ধকতা এবং প্রস্তাবিত সমাধান বিষয়ে উপস্থাপনা করেন সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মুহাং হেলাল উদ্দিন।
অনুষ্ঠান শুরুতেই কোরআন থেকে তেলাওয়াত করেন চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের জুডিসিয়াল পেশকার মো. নাজমুল হোসাইন এবং গীতা থেকে পাঠ করেন চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের প্রধান তুলনা সহকারী যোগল কিশোর গোস্বামী।
পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেসি কনফারেন্সে সকল থানার অফিসার ইনচার্জ, সিআইডি, ডিবি, বিজিবি, র্যাব কর্মকর্তা, প্রবেশন কর্মকর্তা, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রতিনিধি ও স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন।