গত মঙ্গলবার একুশে ফেব্রুয়ারির দিনে প্রকাশিত একটি দৈনিকে একজন লিখেছেন, ‘ভাষা আন্দোলন শুধু প্রতিবাদ নয়, প্রতিরোধের শিক্ষাও দিয়েছে। অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার শিক্ষা ভাষা আন্দোলনই উজ্জীবিত করেছে। সে জন্য মহান ভাষা আন্দোলনের চেতনা চিরস্থায়ী, অনন্য ও বিস্ময়কর। যুগযুগ ধরে এই চেতনা বাঙালি জাতিকে চেতনা সমৃদ্ধ করে ভবিষ্যৎ সৃষ্টির দিকে ধাবিত করবে। এই চেতনার মৃত্যু নাই। এই চেতনা মৃত্যুঞ্জয়ী। এই চেতনা আমাদের অহংকার।’ অতীব উত্তম কথা।
এই সম্পাদকীয় দপ্তর এই বাক্যনিচয়ের কোনওটির প্রতিই বিরাগ পোষণ করছে না, কিন্তু তার সঙ্গে কীছু অবশ্য ‘কথনীয় কথা’ যোগ করে দিতে চায়। যদি স্বয়ং লেখক কিংবা অন্য কেউ এইরূপ ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণকে সঙ্গত মনে না করেন তাতে কোনও আপত্তি নেই। কারণ দৃষ্টিভঙ্গি সঞ্জাত ভিন্নতা পোষণের অধিকার ব্যক্তিপর্যায়ে ভিন্ন ভিন্ন হওয়াই একান্ত স্বাভাবিক ও সঙ্গত, কিন্তু বিবেচনার ভার সাধারণের।
কেউ একজন যখন বলেন, ‘ভাষা আন্দোলন শুধু প্রতিবাদ নয়, প্রতিরোধের শিক্ষাও দিয়েছে। অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার শিক্ষা ভাষা আন্দোলনই উজ্জীবিত করেছে।’ তখন এই কথার সঙ্গে আরও কীছু যোগ করা বোধ করি সময়ের দাবি মাত্র এবং সময়ের অনিবার্য দাবিকে মান্য করে বলে দেওয়া উচিত যে, এখন সমাজসংস্থিতির কোথাও প্রতিবাদ, প্রতিরোধ নেই কিংবা অন্যায় ও অবিচার রুখে দাঁড়াবার উৎসাহ খুব কম মানুষের চেতনায়ই বিদ্যমান আছে। যদি লেখক এই কথা বলতে না চান তাহলে তাঁকে বলতে হবে যে, ইতোমধ্যে সমাজসংস্থিতির পারিপার্শিকতাকে বিধিবদ্ধতার কবচ পরিয়ে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ থেকে সুরক্ষিত করা হয়েছে এবং অন্যায় ও অবিচার চলছে নির্বিচারে, বিচারবহির্ভূত হত্যা যেমন চলে। ভুলে গেলে চলবে না, বঙ্গবন্ধুর খুনের বিচারকে পুরো দুই দশক আইনি কবচ পরিয়েই বিচারবহির্ভূত রাখা হয়েছিল।
সুতরাং ভাষা আন্দোলনের আলোকিত পথ ধরে জাতির চেতনা সমৃদ্ধ করে ভবিষ্যৎ সৃষ্টির দিকে পথ অতিক্রমের বেলায়ও মনে রাখতে হবে, সে-পথ যেনো ‘গোলাম আজমের নাগরিকত্বসহ রাজনীতিক অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া’র রাজনীতির সঙ্গে মিশে গিয়ে একাকার হয়ে না যায়। একুশের চেতনার সঙ্গে একান্ত সম্পৃক্ত প্রতিবাদ-প্রতিরোধের যে-কোনও বয়ান পেশ করার ক্ষেত্রে একুশের চেতনার এই প্রাগতিক চিন্তারধারা থেকে বিচ্যুত হলে চলবে না, বরং বিচ্যুত হলেই সেটা হবে একুশের চিন্তাচেতনার বৈরীত্যকে ধারণ ও লালন করা।
অতীতের বিশ্লেষণ যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি বর্তমানের বিশ্লেষণও, তাহলেই ভবিষ্যতের সঠিক পথ নির্ণয় সম্ভব হতে পারে, অন্যথায় নয়। ভুলে গেলে চলবে না অতীতে যেমন অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রতিরোধে বাঙালি সাহসী হয়েছিল বর্তমানে কিন্তু তেমন সাহসী হয়ে উঠছে না, বরং বলতে গেলে প্রায় ক্ষেত্রেই একুশের আদর্শের বিপরীতে দাঁড়িয়ে মাথা নত করে নিচ্ছে, মুষ্টিমেয় অত্যাচারীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদীহয়ে উঠছে না। নিরপেক্ষতার যুক্তি মেনে অতীতে একুশের বীরত্ব গাঁথার বয়ান করার সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ের সীমাহীন ভীরুতার কথাটুকুও বলতে হবে। চিহ্নিত যুদ্ধবিরোধী যখন নিজেকে স্বাধীনতার সৈনিক বলে গলাবাজি করে তখন তার প্রকৃত স্বরূপটার অবগুণ্ঠন উন্মুচিত করা চাই। তানা হলে একুশের চেতনার নিহিতার্থ শিখা নির্বাপিত প্রদীপের চেয়ে বেশি বেশি হয়ে উঠে না।