বিশেষ প্রতিনিধি ::
সুনামগঞ্জের হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধের কাজে অনিয়ম. দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও নীতিমালা ভঙ্গ করে প্রকল্প গ্রহণ ও কাজের নি¤œমান নিয়ে প্রতিবাদ করায় প্রতিবাদী কৃষকদের হুমকি-ধমকি দেওয়া হচ্ছে। প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) লোকজন দুর্নীতির মাধ্যমে প্রকল্প অনুমোদন করিয়ে কাজেও দুর্নীতি করছেন বলে কৃষকদের অভিযোগ। বাস্তবায়নকারী অসাধু কর্মকর্তাদের সহায়তায় অল্প ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধকে পুরো ক্ষতিগ্রস্ত দেখিয়ে সরকারি বরাদ্দ লোপাটের চেষ্টার বিরুদ্ধেও ইতোমধ্যে মানববন্ধনসহ প্রতিবাদী কর্মসূচি পালন করেছেন হাওর আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ। তবে মাঠ পর্যায়ের কৃষকরা দুর্নীতির প্রতিবাদ করায় তাদেরকে হুমকি ধমকিসহ মামলা-হামলার হুমকিও দেওয়া হচ্ছে। এ ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছেন হাওর আন্দোলনের নেতৃবৃন্দসহ সুধীজন।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, সুনামগঞ্জের হাওরে এবার প্রায় ২০৩ কোটি টাকা ব্যয়ে কৃষকের বোরো ফসল রক্ষায় ৫৪৫ কিলোমিটার অস্থায়ী ফসলরক্ষা বেড়িবাঁধ নির্মাণের কাজ চলছে। প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে ১০৭৬টি। ইতোমধ্যে বরাদ্দের ৭৫ কোটি টাকা ছাড় দেওয়া হয়েছে। সরকারি হিসেবে এ পর্যন্ত কাজ হয়েছে ৬০ ভাগ।
কৃষক ও জনপ্রতিনিধিদের অভিযোগ, বন্যার দোহাই দিয়ে ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরে হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধের বরাদ্দ গেল বারের চেয়ে দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ানো হয়েছে প্রকল্পও। এতে সরকারের বিপুল টাকা অপচয় ও লোপাটের চেষ্টা চলছে। এছাড়াও বিভিন্ন স্থানে কৃষকদের বদলে অকৃষক, ফড়িয়া ও ভূমিহীনদের দিয়ে প্রকল্প অনুমোদন করিয়ে কাজ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে গত ২৩ জানুয়ারি জেলার প্রতিটি উপজেলায় মানববন্ধন করে প্রতিবাদ করেছে হাওর বাঁচাও আন্দোলন। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি পানিসম্পদ উপমন্ত্রীর মতবিনিময় অনুষ্ঠানে সুনামগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট পীর ফজলুর রহমানও এতো বরাদ্দ ও প্রকল্প নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
হাওর আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ জানান, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও প্রকল্প বাস্তবায়নকারী উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়ের দুর্নীতিবাজ একটি চক্র আর্থিক সুবিধা নিয়ে প্রকল্প অনুমোদন দিয়ে অল্প ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধগুলোতেও বিপুল বরাদ্দ দিয়েছে। সরকারি অর্থ অপচয় রোধে এবং অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধের দাবিতে বিভিন্ন স্থানে কৃষকরা প্রতিবাদও করেছেন। অনেক স্থানে দুর্নীতির প্রতিবাদ করে বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। তাদেরকে ভয় পাইয়ে দিতে আনা হচ্ছে চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগও। এতে প্রতিবাদকারী কৃষকরা বিপাকে পড়েছেন।
জানা গেছে, গত ২৮ জানুয়ারি শাল্লা উপজেলার আনন্দপুরে অল্প ক্ষতিগ্রস্ত একটি বাঁধে বিপুল বরাদ্দ দেওয়া ও বাঁধ রক্ষার নামে গাছ কর্তনের বিরুদ্ধে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেন কৃষকরা। এ ঘটনায় পিআইসির সভাপতি রেজু মিয়া কৃষকদের বিরুদ্ধে থানায় চাঁদাবাজির অভিযোগ করেন। পুলিশ ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্টরাও পিআইসির সভাপতির হয়ে এলাকায় এসে কৃষকদের হুমকি-ধমকি দিয়েছেন এমন অভিযোগও পাওয়া গেছে।
একইভাবে ধর্মপাশা উপজেলার সুখাইর রাজাপুর দক্ষিণ ইউনিয়নের রাজাপুর গ্রামের একটি প্রকল্প নিয়ে প্রতিবাদ করেন কৃষকরা। কৃষকদের অভিযোগ গাজিনগর থেকে পুকুলিয়া লঞ্চঘাট পর্যন্ত বাঁধটি হলে কৃষকরা উপকৃত হবেন এবং সরকারের অর্থ অপচয় রোধ হবে। কিন্তু এই প্রকল্পটি ইউপি চেয়ারম্যানের দৌলতপুর গ্রামে নেওয়া হচ্ছে। এতে সরকারের বিপুল অর্থ অপচয়সহ কৃষকদের তেমন উপকার আসবেনা। এ ঘটনায় প্রতিবাদ করায় পিআইসি সভাপতি আলমগীর কবীর কৃষকদের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করে তাদেরকে হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন।
সুখাইর রাজাপুর গ্রামের কৃষক জিয়াউর রহমান বলেন, এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হলে সরকারের বিপুল অর্থ অপচয় হবে। এর চেয়ে বরং গাজিনগর থেকে পুকুলিয়া লঞ্চঘাট পর্যন্ত হলে কৃষকরাও উপকৃত হবেন এবং সরকারের অর্থও অপচয় রোধ হবে। আমরা প্রতিবাদ করায় উল্টো আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে পিআইসি সভাপতি।
হাওরের কৃষি ও কৃষক রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্যসচিব অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন তালুকদার বলেন, কৃষকরা যাতে দুর্নীতি ও অনিয়মের প্রতিবাদ না করতে পারেন এ জন্য দুর্নীতিবাজ চক্র কৃষকদের শুধু হুমকি ধমকিই দিচ্ছেনা, তাদের বিরুদ্ধে থানা ও প্রশাসনে মিথ্যা অভিযোগও আনছে। প্রতিবাদ করে লাঞ্ছিত ও অপমানিত হওয়ার ভয়ে কৃষকরা এখন কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছেন।
হাওর বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন রায় বলেন, দুর্নীতিবাজ চক্র একজোট হয়ে দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন দিয়ে কোটি কোটি টাকা বাণিজ্য করছে। এতে সরকারের বিপুল অর্থ অপচয় হচ্ছে। নিয়ম-নীতি লঙ্ঘন করে প্রকল্প দেওয়ায় কৃষকরা প্রতিবাদ করায় তাদেরকেও হুমকি ধমকি দেওয়া হচ্ছে। এতে প্রতিবাদী কৃষকরা ভয় পেয়ে যাচ্ছেন, যা হাওরবাসীর জন্য উদ্বেগের।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী-১ মামুন হাওলাদার বলেন, রাষ্ট্রের যে কেউ বৈধভাবে প্রতিবাদ করতে পারে। এ জন্য তাদেরকে হুমকি-ধমকি দেওয়াটা অনুচিত। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কেউ হুমকি-ধমকি দিলে আমরা ব্যবস্থা নেব।