বিশেষ প্রতিনিধি ::
শাল্লায় হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণকাজে প্রকৃত কৃষকদের বদলে মধ্যস্বত্তভোগী, অকৃষকদের দিয়ে প্রকল্প গ্রহণসহ অক্ষত, অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে বিপুল বরাদ্দ দিয়েছে কাবিটা স্কিম প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন কমিটি। প্রকল্প প্রতি ১-৩ লক্ষ টাকা ঘুষ নেওয়া হয়েছে এমন অভিযোগও উঠেছে। তাছাড়া দুর্নীতির মাধ্যমে গৃহিত প্রকল্পে প্রকৃত কৃষকদের বঞ্চিত করে অকৃষকদের প্রকল্প দেওয়ায় কাজেও ধীরগতি লক্ষ্য করা গেছে। মধ্যস্বত্তভোগীদের সঙ্গে আতাত করে পানি উন্নয়ন বোর্ডের এএসওর নির্দেশে সার্ভেয়াররা প্রিওয়ার্কে কম ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধকে অধিক ক্ষতিগ্রস্ত দেখিয়ে দেড় থেকে তিন গুণ বরাদ্দের প্রস্তাব করেছে। এভাবে ১৯৭টি প্রকল্পের মধ্যে অন্তত একশ প্রকল্পে অতিরিক্ত বরাদ্দ দিয়ে সরকারের প্রায় ১০ কোটি টাকা অপচয়ের প্রস্তাব ও অনুমোদন করেছে কমিটি।
শাল্লা উপজেলা জেলার দুর্গম উপজেলা। চারদিকেই হাওরবেষ্টিত। এই উপজেলায় চলতি বছর হাওরের বোরো ফসলরক্ষায় ১৯৭টি ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। গত জুন মাসের ভয়াবহ বন্যায় সারাজেলার চেয়ে সবচেয়ে কম অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শাল্লায়। হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধ ছিল বন্যার পানির অন্তত ৩-৫ ফুট নিচে। ফলে ফসলরক্ষা বাঁধ ভাঙ্গার কোনো সুযোগ নেই। তবে বর্ষায় নৌ চলাচলের জন্য ও মাছ ধরার জন্য কিছু মানুষ ধান কাটার পর বাঁধের আংশিক অংশ কেটে দেন। কিন্তু গত অক্টোবর মাসে পানি উন্নয়ন বোর্ডের এসও আব্দুল কাইয়ুমের নেতৃত্বে সার্ভেয়াররা প্রিওয়ার্ক শুরু করেন। আব্দুল কাইয়ুমের নির্দেশে সার্ভেয়াররা অল্প ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধকেও অধিক ক্ষতিগ্রস্ত দেখিয়ে ১৫-২৫-৪০ লাখ টাকা পর্যন্ত বরাদ্দ দেন। এভাবে অন্তত ১০০টি বাঁধে অতিরিক্ত দেড় থেকে তিন গুণ বরাদ্দ দেওয়ায় সরকারের অন্তত ১০ কোটি টাকা অপচয় হবে।
সরেজমিন কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অনেক বাঁধে বাঁধ এলাকার কৃষকরা পিআইসির (প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি) জন্য আবেদন করলেও আবেদনগুলো ফেলে রেখেছিল উপজেলা কমিটি। তাই যারা বাঁধ এলাকার কৃষক না এবং জমিও নেই তারা আর্থিক লেনদেন করে পিআইসি অনুমোদন করিয়ে নিয়েছে। এতে বঞ্চিত হয়েছেন প্রকৃত কৃষকরা। এই সুযোগে মধ্যস্বত্বভোগীরা পিআইসি প্রতি ১-৩ লক্ষ টাকা ঘুষ নিয়ে পিআইসি অনুমোদন করিয়ে নিয়েছে। ১৯৭টি পিআইসি থেকে অন্তত ২ কোটি টাকার অবৈধ লেনদেন হয়েছে বলে জানা গেছে। পিআইসি অনুমোদনের নামে এসও আব্দুল কাইয়ুমের সাবেক মোটর সাইকেল ড্রাইভার সহিনুর মিয়া আব্দুল কাইয়ুমের হয়ে বিভিন্ন পিআইসি থেকে ঘুষ নিয়েছেন এমন ভিডিও এই প্রতিবেদকের হাতে রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শাল্লায় ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণে বরাদ্দ ছিল ২৪ কোটি টাকা। এবার এই বরাদ্দ দেড়গুণ বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ৪০ কোটি টাকা করা হয়েছে। ১০৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের জন্য গ্রহণ করা হয়েছে ১৯৭টি প্রকল্প। প্রকল্প গ্রহণে দুর্নীতি ও অনিয়মের পাশাপাশি মাটি আনা ও স্লোবের ডিজাইনেও দুর্নীতি করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের টেকনিক্যাল টিম। কাছ থেকে মাটি এনে বাঁধে ফেলা হলেও বরাদ্দ ধরা হয়েছে দূরের। এমনকি ক্লোজারের নিচের পানির অংশেও কমপেকশন ধরে সরকারের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। তাছাড়া সড়ক ও জনপথ, এলজিইডি ও স্থানীয় সরকারের অক্ষত রাস্তায়ও প্রকল্প গ্রহণ করে বিপুল টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে বলে কৃষকদের অভিযোগ।
সরেজমিন উপজেলার ভেরাডহর, কলাকান্দি, শাসখাই, আনন্দপুর, মৌরাপুর, মাউতি বিল, মোক্তারপুরের ব্রিজ হতে খল্লিপর পাশে সহ উপজেলা সদরের বেশিরভাগ প্রকল্প ঘুরে দেখা গেছে, বাঁধের অন্তত ৭০ ভাগ অক্ষত। কিন্তু পাউবোর টেকনিক্যাল টিম সুবিধাভোগীদের কাছ থেকে আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে সব বাঁধকে পুরো ক্ষতিগ্রস্ত দেখিয়ে ১৫-৪০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত বরাদ্দ দিয়েছে। এতে ১০০টি বাঁধে অন্তত ১০ লক্ষ টাকা করে সরকারের ১০ কোটি টাকা অপচয় হবে। তাছাড়া বরাদ্দ বাড়িয়ে দিয়ে অন্তত ২ কোটি টাকা ইতোমধ্যে হাতিয়ে নিয়েছে চক্র।
শাল্লা উপজেলার আনন্দপুর গ্রামের কৃষক ও সাবেক জনপতিনিধি কালাই মিয়া তালুকদার বলেন, শাল্লা কলেজ থেকে শাহ আরেফিন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত কয়েকটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এই প্রকল্পগুলোতে যে পরিমাণ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তাতে সরকারের অন্তত ১ কোটি টাকা অপচয় হবে। দেড়গুণ থেকে তিনগুণ পর্যন্ত অতিরিক্ত বরাদ্দ দিয়ে সরকারের টাকা নষ্ট করা হবে। এলাকাবাসী ফসলরক্ষা বাঁধ নিয়ে কর্মসূচি পালন করায় সুবিধাভোগীরা চাঁদাবাজির অভিযোগসহ হুমকি ধমকি দিচ্ছে।
মৌরাপুর গ্রামের কৃষক শিশু সরকার বলেন, আমাদের এলাকায় কয়েকটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে যেখানে ২-৩ গুণ অতিরিক্ত বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। শুধু অতিরিক্ত বরাদ্দই নয় যাদের জমি নেই, এই এলাকার মানুষও নয় তাদেরকেও পিআইসি দেওয়া হয়েছে। দুর্নীতির পাশাপাশি এভাবে এলাকার প্রকৃত কৃষকদের বঞ্চিত করে বাইরের হায়ার করা তাদের পছন্দের লোকদের পিআইসি দিয়ে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিতেই এমন দুর্নীতি করা হয়েছে।
ডুমরা গ্রামের কৃষক সুধাকর দাস বলেন, শাল্লায় হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের শুরু থেকেই দুর্নীতি ও অনিয়ম হচ্ছে। প্রকৃত কৃষকদের বঞ্চিত করে মধ্যস্বত্বভোগীদের পিআইসি দেওয়া হয়েছে। অনেক স্থানে ভূমিহীনও পিআইসি পেয়েছে। এই সুযোগে দুর্নীতিবাজ চক্র বিপুল অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। তাছাড়া সময় শেষ হয়ে আসলেও এখনো কাজ অর্ধেকও শেষ করতে পারেনি। যার ফলে কৃষকরা আতঙ্কে আছেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের শাল্লা উপজেলার সেকশন অফিসার মো. আব্দুল কাইয়ুমকে টেকনিক্যাল বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি কোন উত্তর দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, আপনার যা ইচ্ছে লিখেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী-২ শামসুদ্দোহা বলেন, আমাদের কাছে হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধের কাজে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ এসেছে। আমরা অভিযোগগুলো তদন্ত করে ব্যবস্থা নেব।