মোসাইদ রাহাত ::
ঐতিহ্যবাহী বাড়ি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত শাল্লা উপজেলার কৃষ্ণপুর গ্রামের ‘সরকার বাড়ি’। ১৯৩৭ সালে এই ‘সরকার বাড়ি’টি নির্মাণ করেন তখনকার জমিদার ভারত চন্দ্র সরকার। তবে বাড়িটির অন্য আরেকটি পরিচিতি হল দুর্গম শাল্লা উপজেলার প্রথম দালান বাড়ি হিসেবে। যার আগে এ উপজেলায় পাথর, ইট, বালুর কোন বাড়িই ছিলনা। ২ একর জায়গার উপর ৮টি করে বড় বড় কক্ষ দিয়ে দুইতলা বিশিষ্ট এই বাড়িটি ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী জ্বালিয়ে দেয়ার পর থেকেই পড়ে রয়েছে অবহেলায়। স্থানীয় এবং জনপ্রতিনিধিদের দাবি বাড়িটি সংরক্ষণে সরকারের বিশেষ দৃষ্টির। তারা বলছেন এভাবে অযতœ-অবহেলায় ঐতিহ্যবাহী বাড়িটি পড়ে থাকলে বিলীন হয়ে যাবে। পরবর্তী প্রজন্ম জানতে পারবে না বাড়িটির ইতিহাস।
সরেজমিনে দুর্গম হাওর উপজেলা শাল্লার ৪নং ইউনিয়নের কৃষ্ণপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, অযতœ-অবহেলায় থাকা বাড়িটির দরজা জানালা সবই ভেঙে গেছে। তাছাড়া বাড়িটির ছাদের দেয়ালে ফাটল ধরেছে। খসে পড়ছে দেয়ালের আস্তরণ। তবে বাড়িটির দেয়ালে এখনো রয়ে গিয়েছে শিল্পীর অনিন্দ্য কারুকাজ। আছে পাকিস্তানিদের বারুদে পুড়িয়ে যাওয়ার ক্ষতচিহ্ন। দুই একর জায়গাজুড়ে বাড়ির সীমানা। যুদ্ধের পর থেকে সেখানে বসবাস শুরু করেন স্থানীয়রা। তবে সবার দাবি বাড়িটি এ উপজেলার ঐতিহ্যের গুরুত্ব বহন করছে। এটি সংরক্ষণ করা প্রয়োজন।
কৃষ্ণপুর গ্রামের বাসিন্দা ও সাবেক ইউপি সদস্য আরব আলী বলেন, এই বাড়িটি শাল্লা উপজেলার প্রথম দালান বাড়ি। এর আগে এই উপজেলা কুঁড়েঘর থাকলেও দালান ঘর ছিল না। এখানে জমিদার ভারত চন্দ্র সরকার থাকতেন। তিনি এ এলাকায় খুব জনপ্রিয় একজন জমিদার ছিলেন। তিনিই বাড়িটি তৈরি করেন। এ বাড়িতে বড় পূজা হতো, বাড়ির উঠানে বসতো বিচার-আড্ডা। তবে যুদ্ধের সময় বাড়িতে পাকিস্তানিরা আগুন দিয়ে দেওয়ার পর থেকে এখানে কেউ থাকে না।
সরকার বাড়ির পাশেই থাকেন কৃষক নিরঞ্জন দাস। তিনি বলেন, বাড়ির দেয়ালে আস্তর সব খুলে যাচ্ছে। দেয়ালেও ফাটল আছে। এছাড়া আগুন দিয়ে জ্বালানোয় বাড়িটি দিন দিন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। পরিবারের লোকজন মাঝে মধ্যে আসেন, আমাদের দেখে যান। তবে আমি মনে করি শাল্লা উপজেলার ইতিহাসের অংশ হিসেবে ঐতিহ্যবাহী বাড়িটি সংরক্ষণ করা জরুরি।
ভারত চন্দ্র সরকারের নাতি নিউইয়র্ক পুলিশের কর্মকর্তা নিয়ন চৌধুরী কল্লোল বলেন, বাড়িটি আমার দাদা তৈরি করেছিলেন। এই বাড়িতেই আমার বাবার জন্ম হয়েছিল। এখানে আমার বাবার অনেক স্মৃতি রয়েছে। তবে পাকিস্তানিরা বাড়িটিকে দুইবারের চেষ্টায় আগুন লাগায়। প্রথম আগুন না জ্বলায় তারা পরবর্তীতে গান পাউডার দিয়ে বাড়িটি জ্বালিয়ে ফেলে। আমরা পরিবারের সবাই জীবন-জীবিকার তাগিদে বাইরে থাকায় বাড়িটির দিকে তেমন একটা নজর দেয়া হয় না। তবে আমি চাইব বাড়িটি যেন সরকার সংরক্ষিত করেন। যাতে ঐতিহাসিক সরকার বাড়ির ইতিহাস পরবর্তী প্রজন্ম জানতে পারে। এতে পরিবারের পক্ষ থেকে সরকারকে যেরকম সহযোগিতা করার প্রয়োজন, আমরা করব।
৪নং শাল্লা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. ছাত্তার মিয়া বলেন, এ বাড়িটি দিন দিন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সবাই মিলে উদ্যোগ নিলে বাড়িটি সংরক্ষণ করা যাবে।
শাল্লা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আবু তালেব বলেন, বাড়িটিতে আমি গিয়েছি এবং বাড়িটির ইতিহাস আমিও জানি। শাল্লা উপজেলার জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক জায়গা। বাড়িটির পরিবারের সাথে আমার কথা হয়েছে। বাড়িটি তারা যদি সংরক্ষণ করতে চান তাহলে আমরা অবশ্যই সহযোগিতা করব। তার জন্য পরিবারের লোকেরা যদি বাড়ির কাগজপত্র সবকিছু নিয়ে আসেন তাহলে আমরাও এটি নিয়ে কাজ দ্রুত করতে পারব।