সুনামকণ্ঠ ডেস্ক ::
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সংসদ সদস্য (এমপি) প্রার্থী বাছাইয়ে মনোযোগ দিয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। ইতিমধ্যে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার জরিপের তথ্যের ভিত্তিতে দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০ জন এমপির মনোনয়ন অনেকটাই চূড়ান্ত করেছেন। তবে বাকি ১০০ আসনে মনোনয়ন দলটির তৃণমূল নেতাদের মতামত, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার জরিপের তথ্য যাচাই-বাছাই করে দেওয়া হবে। কারণ আগামী নির্বাচনে টানা চতুর্থবার জয়ের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে চায় ক্ষমতাসীন দলটি।
দলের একাধিক সূত্র বলছে, আওয়ামী লীগের বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচির সঙ্গে দলটির অনেক ডাকসাইটে নেতা থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে রয়েছে নানা বিতর্কিত কর্মকা-ের অভিযোগ। দ্বাদশ নির্বাচনের মাত্র ১ বছর বাকি। আগামী নির্বাচন যেহেতু একটা বড় চ্যালেঞ্জ, তাই নির্বাচনি প্রক্রিয়াগুলোর মধ্যে প্রার্থী মনোনয়নকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু মনে করে দলটি। সে ক্ষেত্রে দলের সভাপতি শেখ হাসিনা এ কাজটি আগেভাগেই চূড়ান্ত করতে চান।
এরই অংশ হিসেবে সদ্যবিদায়ি বছরে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী যাদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো অভিযোগ নেই, এমন ২০০ জন এমপির নাম চূড়ান্ত করে রেখেছেন তিনি। বাকি ১০০ এমপির মনোনয়নের ক্ষেত্রে আরও যাচাই-বাছাই করতে চান শেখ হাসিনা। কারণ তাদের বিরুদ্ধে রয়েছে বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ। এ ছাড়া তৃণমূলে নেতায়-নেতায় দ্বন্দ্ব টিকিয়ে রাখা, স্থানীয় নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থীকে সমর্থন, জনসমর্থন নেই, নির্বাচিত হওয়ার পর জনস¤পৃক্ততা নেই- এসব অভিযোগে অনেক এমপি, মন্ত্রী ও দলের কেন্দ্রীয় নেতা আগামী নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন থেকে বঞ্চিত হতে পারেন।
গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর দলের প্রথম সভাপতিম-লীর বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ ছাড়া গত ১ জানুয়ারি বিএনপির এমপিরা পদত্যাগ করায় শূন্য হওয়া ৬টি আসনের উপনির্বাচনে নৌকার মনোনয়ন দিতে স্থানীয় সরকার ও মনোনয়ন বোর্ডের বৈঠক হয়। দুই বৈঠকেই সভাপতিত্ব করেন শেখ হাসিনা। দুই বৈঠকে উপস্থিত নেতাদের আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিতে নির্দেশনা দেন তিনি।
নেতাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনারা খোঁজখবর নেন, আমাদের যারা এমপি রয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে কোথায় কী দোষ-ত্রুটি এবং দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের কী ধরনের অভিযোগ রয়েছে। কারণ নির্বাচন চ্যালিঞ্জং ইস্যু। পাশাপাশি আর মাত্র ১ বছর বাকি। এ সময়ের মধ্যে নির্বাচনি প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে। তবে কোনো বিতর্কিত কাউকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হবে না। আমিও খোঁজখবর নিচ্ছি। আমার কাছে অনেকেরই আমলনামা রয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে বিতর্কিত কর্মকা-ের অভিযোগ রয়েছে, তাদের আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন দিলে ভরাডুবি হতে পারে।
অপরদিকে গত ২৪ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের ২২তম জাতীয় সম্মেলনের আগে ৮ বিভাগের বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক টিমের নেতারা শেখ হাসিনার হাতে দলীয় এমপি-মন্ত্রীদের ফিরিস্তি তুলে দেন। এর ওপর ভিত্তি করেও অনেক ডাকসাইটে নেতা দলীয় মনোনয়ন থেকে বঞ্চিত হবেন। তাদের মধ্যে দলের অনেক প্রভাবশালী নেতা এবং এমপি-মন্ত্রীও রয়েছেন। ফলে দলের সভাপতির চূড়ান্ত করা ২০০ জন এমপির বাইরে ১০০ আসনে প্রার্থিতায় পরিবর্তন আসতে পারে। এতে অনেকেরই এমপি হওয়ার ‘আশার গুড়ে বালি’ পড়বে।
সূত্র আরও জানায়, আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা সাবেক ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কৃষক লীগ, শ্রমিক লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, যুব মহিলা লীগসহ সহযোগী সংগঠনের নেতাদের দিয়েও একটি জরিপ চালিয়েছেন। এতে অনেক নেতার বিরুদ্ধেই বিতর্কিত কর্মকা-ের অভিযোগ উঠে এসেছে। এসব অভিযোগে দলের পক্ষ থেকে পৌরসভাসহ উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে নৌকার মনোনয়ন পাওয়া নেতাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া, এমপি বলয়, বিদ্রোহীদের পক্ষে অবস্থান বা ইন্ধনে দলের অভ্যন্তরে কোন্দল সৃষ্টির বিষয়টি উঠে এসেছে। এমনকি অনেক এমপি-মন্ত্রীর নিজ নিজ নির্বাচনি এলাকার অবস্থাও নাজুক। গত একাদশ নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর তারা অনেকেই জনবিচ্ছিন্ন। জনবিচ্ছিন্ন হলেও এলাকায় তৈরি করেছেন নিজস্ব বলয়। এতে তৃণমূলের ত্যাগী-পরিশ্রমী, পরীক্ষিত, ও দুর্দিন-দুঃসময়ে আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় থাকা অনেক নেতা রাজনীতি থেকে দূরে সরে গেছেন।
দলটির একাধিক শীর্ষ নেতা বলেন, শেখ হাসিনা দলের তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত সবার খবর রাখেন। তার নখদর্পণের বাইরে কেউ নেই। আমরা কে, কোথায়, কী করি, কার কী রকম জনপ্রিয়তা ও কে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেন। সবার আমলনামা শেখ হাসিনার কাছে রয়েছে। একাধিক সংস্থাকে দিয়ে মাঠ জরিপ করিয়ে প্রধানমন্ত্রী আমলনামা নিয়েছেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া হবে। তিনি দল বা নির্বাচন সবকিছুই বিচক্ষণতার সঙ্গে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নেন। ফলে আগামী নির্বাচনে বিতর্কিত নয়, সৎ, শিক্ষিত, মেধাবী, ত্যাগী, পরীক্ষিত ও গ্রহণযোগ্যরাই দলীয় মনোনয়ন পাবেন। যত বড় নেতাই হোন, কাউকে ছাড় দেবেন না তিনি।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য কাজী জাফর উল্ল্যাহ বলেন, কেবল দলীয় সম্মেলন শেষ হলো। তবে জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন উইং কাজ করছে। তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত সবার আমলনামা নেত্রীর কাছে আছে। যারা দলের সিদ্ধান্ত বা স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে অবস্থান অথবা বিদ্রোহীদের মদদ দিয়েছেন তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। দলের সভাপতি শেখ হাসিনা ¯পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন, নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিতে। তবে যারা দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করবেন, তাদের এমপি মনোনয়ন দেবেন না নেত্রী। একই সঙ্গে আমরা বিএনপি-জাতীয় পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মকা- লক্ষ করছি। তবে সব কিছুর সিদ্ধান্ত নেবেন নেত্রী শেখ হাসিনা।
আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর আরেক সদস্য মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন এ প্রসঙ্গে বলেন, দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলের জন্য কাজ করার নির্দেশনা দিয়েছেন। গত ২৬ ডিসেম্বর সভাপতিম-লীর প্রথম বৈঠকে তিনি নির্বাচনের জন্য সবাইকে প্রস্তুতি নিতে বলেছেন। নেত্রীর কাছে সবার আমলনামা রয়েছে। তিনিই সিদ্ধান্ত নেবেন, কাকে মনোনয়ন দেবেন বা কার বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেবেন। তবে আমি এটা বলতে পারি, কোনো হাইব্রিড বা সংগঠনবিরোধী কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িতরা আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন পাবেন না।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক স¤পাদক বিএম মোজাম্মেল হক বলেন, শেখ হাসিনার নির্দেশনা রয়েছে, যদি কেউ দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেন, জনস¤পৃক্ততা নেই, নেতিবাচক কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িত, তাদের মনোনয়ন দেওয়া হবে না। দলের সভাপতি অত্যন্ত বিচক্ষণ, তিনি সবার বিষয়েই খোঁজখবর রাখেন। তিনি বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমেও জরিপ করেন। জরিপে যার যেমন রিপোর্ট, তিনি তেমন ফল ভোগ করবেন।
আর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক স¤পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল প্রার্থী মনোনয়ন প্রসঙ্গে বলেন, গত বছর আমরা সাংগঠনিক কার্যক্রম নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করেছি। এ বছরটা আমাদের নির্বাচনি বছর। তাই এখন থেকে সারা বছরই থাকবে নির্বাচনি প্রস্তুতি। তবে আগামী নির্বাচনে কে মনোনয়ন পাবেন বা পাবেন না, সেটি ঠিক করবে মনোনয়ন বোর্ড। কিন্তু সব কিছুরই সিদ্ধান্ত দেবেন দলের সভাপতি শেখ হাসিনা। ইতিমধ্যে তার কাছে অনেকের আমলনামাই চলে গেছে। যারা দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছেন বা বিতর্কিত, তারা মনোনয়ন পাবেন না। আর যারা ক্লিন ইমেজের, বিভিন্ন সময় বিএনপি-জামায়াতের হামলা-মামলার শিকার হয়েছেন তাদেরই প্রাধান্য দেবেন নেত্রী।
উল্লেখ্য, গত ২৪ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের ২২তম জাতীয় সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দশমবারের মতো দলের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। -সময়ের আলো