সাজ্জাদ হোসেন শাহ ::
তাহিরপুর ও মধ্যনগর উপজেলার আংশিক নিয়ে বিস্তৃত টাঙ্গুয়ার হাওর। গাছ, মাছ ও নানা প্রজাতির অতিথি পাখির অভয়ারণ্য টাঙ্গুয়ার হাওরে প্রতি বছর শীতের শুরুতে ডিসেম্বর থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি পাখির আগমন হলেও এবার আশানুরূপভাবে দেখা মেলেনি অতিথি পাখির। শীত এলেও পাখি না আসায় কলকাকলিতে মুখরিত হয়নি টাঙ্গুয়ার হাওরপাড়।
হাওরে এ বছর যে পরিমাণ পাখি এসেছে তা একেবারেই সামান্য। এজন্য দেশ/বিদেশ থেকে টাঙ্গুয়ার হাওরে পাখি দেখতে আসা পর্যটকরা বিগত বছরগুলোতে নির্বিচারে পাখি শিকার করাকেই দায়ী করছেন। তবে বিগত বছরগুলোর তুলনায় পাখি শিকার অনেকাংশে কমেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তারা বলছেন, সুনামগঞ্জের সাবেক জেলা প্রশাসক সাবিরুল ইসলাম দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই নজর দেন টাঙ্গুয়ার হাওর ও তাহিরপুর উপজেলার পর্যটন শিল্পের প্রতি। তিনি আসার পর তাহিরপুর উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের সহযোগিতায় পাখি শিকারিদের গ্রেপ্তার করে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অর্থদ- ও কারাদ- প্রদান করায় টাঙ্গুয়ার হাওরে এখন পাখি শিকার অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এসেছে। তবে প্রশাসনের নজর ফাঁকি দিয়ে এক শ্রেণির কিছু অর্থলোভী লোক এখনো চুপিসারে পাখি শিকার করছে।
প্রতিবছর শীতের শুরুতেই ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি পাখির আগমন হলেও এবার আশানুরূপ পাখি না আসার কারণ হিসেবে টাঙ্গুয়ার হাওরের দায়িত্বে থাকা কমিউনিটি গার্ড ও নিরাপত্তায় নিয়োজিত আনসার সদস্যদের দায়িত্বহীনতাকেই দায়ী করছেন হাওরপাড়ের জনগণ ও সচেতন মহল। এদিকে থাকা, খাওয়া ও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকার পরও প্রতিদিনই দেশ-বিদেশ এবং বিভিন্ন জেলার হাজার হাজার পর্যটক কষ্ট সহ্য করে পাখি দেখতে আসছেন হাওরে। কিন্তু পাখির দেখা না মেলায় হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন তারা। টাঙ্গুয়ার হাওরের গাছ, মাছ ও পাখি সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ না করায় ক্ষুব্ধ হচ্ছেন আগত পর্যটকরা।
জানা যায়, তাহিরপুর উপজেলা ও পার্শ্ববর্তী মধ্যনগর উপজেলার আংশিক নিয়ে গঠিত টাঙ্গুয়ার হাওরটি ১০০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। এটি ভারতের মেঘালয় পাহড়ের পাদদেশ পর্যন্ত বয়ে গেছে। তুষারপাত ও শৈত্য প্রবাহ থেকে নিজেদের রক্ষার তাগিদে প্রতি বছর শীত প্রধান দেশ সুদূর সাইবেরিয়া, চীন, মঙ্গোলিয়া, নেপালসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে এসব পাখি ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে আসে টাঙ্গুয়ার হাওরে। একটানা ডানা মেলে আকাশে উড়ার ক্লান্তিতে পাখিরা প্রথমে কিছুটা ঝিমিয়ে পড়লেও প্রচুর খাবার সমৃদ্ধ টাঙ্গুয়ার হাওরে বিচরণ করে তারা যেন সজিবতা ফিরে পায়।
স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, টাঙ্গুয়ার হাওরে এক সময় প্রায় ২১৯ প্রজাতির পাখির অবস্থান ছিল। এর মধ্যে ৯৮ প্রজাতি পরিযায়ী, ১২১ প্রজাতির দেশি ও ২২ প্রজাতির হাঁসজাত পাখি বিচরণ করত এই টাঙ্গুয়ার হাওরে। আগত পাখির মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলো- বিরল প্রজাতির প্যালাসেস ফিসিং ঈগল, মৌলভীহাঁস, পিয়ারী, কাইম, রামকুড়া, মাথারাঙ্গা, বালিহাঁস, লেঞ্জা, চোখাচোখি, বেগুনি কালেম প্রভৃতি।
এখন এসব পাখি নেই বললেই চলে বলে পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কাশমীর রেজাসহ টাঙ্গুয়ার হাওরপাড়ের স্থানীয় বাসিন্দারা জানান। এর কারণ হিসেবে তারা জানান, এক শ্রেণির অসাধু পাখি শিকারি ও পাখি ব্যবসায়ীদের কারণে দিন দিন টাঙ্গুয়ার হাওরে এই পাখির সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এছাড়াও হাওরের নানা প্রজাতির জলাবন, হিজল কড়চ, নলখাগড়া, চাইল্যাবন প্রায় বিলুপ্তির পথে। মূল হাওরের ভেতরে ইঞ্জিনচালিত নৌকার মেশিনের শব্দ এবং রাতের আঁধারে মাছ ধরার জালসহ বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ দিয়ে অতিথি পাখি শিকার করাও অন্যতম কারণ। তবে গত বছর থেকে টাঙ্গুয়ার মূল স্থানে এসব ইঞ্জিনচালিত নৌকার প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসন।
উন্নয়নকর্মী ইলিমেন্ট হাজং বলেন, রাষ্ট্রীয়ভাবে অতিথি পাখি শিকার করা দ-নীয় অপরাধ হলেও স্থানীয় কিছু পাখি শিকারি ও ব্যবসায়ী টাকার বিনিময়ে হাওরে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কমিউনিটি গার্ড ও আনসার সদস্যদের সহযোগিতায় অতিথি পাখি শিকার করে। যার জন্য পাখির সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে।
জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী বলেন, আমি এখানে নতুন এসেছি। শুধু টাঙ্গুয়ার হাওরের পাখি শিকার বন্ধ করাই নয় পুরো সুনামগঞ্জের সব ধরনের উন্নয়নসহ হাওরের প্রতিবেশ-পরিবেশ রক্ষায় সর্বাত্মক চেষ্টা করব। যদি কোনো পাখি শিকারি পাখি শিকার করে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। হাওরের দায়িত্ব পালনে কোনো প্রকার অনিয়ম হলে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।