ফারজানা ইয়াসমিন
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও করোনার ঝাপটায় সবকিছু ওলট-পালট হয়ে গেছে। বিশেষ করে পিছিয়ে পড়েছে শিক্ষার মতো জাতি গড়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত। করোনাকালে প্রায় দেড় বছর শিক্ষাঙ্গন বন্ধ থাকায় অনেক শিক্ষার্থী আর স্কুলে ফিরতে পারেনি। কত সংখ্যক শিক্ষার্থী আর স্কুলে ফিরতে পারেনি পরিসংখ্যানও আমাদের জানা নেই। দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করতে না পেরে অনেক শিক্ষার্থী বিভিন্ন কাজে জড়িয়েছে। জোর করে অনেক মেয়েকে বাল্যবিয়ে দেওয়া হয়েছে। যদিও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ার বিষয়টি নতুন নয়। প্রতি বছর প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার আগে প্রায় ১৭ শতাংশ শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে। কিন্তু এখন ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর চিত্র যেভাবে ফুলেফেঁপে উঠছে, তা আমাদের উদ্বিগ্ন না করে পারে না। এবার এসএসসি ও সমমান পরীক্ষা কেন্দ্রে অনুপস্থিত সংখ্যাও তা আবার প্রমাণ করল।
বর্তমান সরকারের শিক্ষা খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে নানামুখী কর্মকা-, শিক্ষকদের আন্তরিক প্রচেষ্টা ও অভিভাবকদের সচেতনতায় ঝরে পড়া হারও কমে এসেছিল। কিন্তু করোনা ও দুর্যোগ- এই ক্ষেত্রেই হতাশার ছায়া প্রলম্বিত করেছে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেটরি রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, প্রাথমিক পর্যায়ে ১৯ শতাংশ ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী পড়াশোনার বাইরে চলে গেছে। ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২১ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত এ জরিপ পরিচালিত হয়। আগের বছর এর হার ছিল প্রাথমিকে ১৪ শতাংশ ও মাধ্যমিকে ২১ শতাংশ। গত ১২ সেপ্টেম্বর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার দিন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি আশানুরূপ ছিল না। ধারণা করা হয়েছিল, ধীরে ধীরে উপস্থিতি বাড়বে। কিন্তু মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য খুবই হতাশাজনক। এ পর্যায়ে ঝরে পড়াদের প্রকৃত সংখ্যা যাচাই করে তাদের মূলধারার শিক্ষায় নিয়ে আসার সুপারিশ করেছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় স¤পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। ‘আউট অব স্কুল চিলড্রেন’ কর্মসূচির লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ৮ থেকে ১৪ বছর বয়সি বিদ্যালয়বহির্ভূত ১০ লাখ শিশুকে উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষা প্রদান করার কথা। কিন্তু ১ সেপ্টেম্বর থেকে এ কর্মসূচির মাধ্যমে এক লাখ বিদ্যালয়বহির্ভূত শিশুর জন্য চলমান কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। করোনাকালে অতীতের তুলনায় শিশুরা প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বেশি ঝরে পড়ছে। মূলধারা থেকে ছিটকে যাওয়া শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় ফিরিয়ে আনতে এ কর্মসূচি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। কিন্তু এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন না হলে এর সঙ্গে যুক্ত সবার ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। সে ক্ষেত্রে আমাদের প্রত্যাশা হচ্ছে, সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এ অন্ধকার দূর করতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিসহ দরিদ্রবান্ধব সব কার্যক্রমের পরিসর বাড়ানোও দরকার। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে ঝরেপড়া রোধে শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য নিরসনও জরুরি। দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টার পর শিক্ষায় যে গতি আজ দৃশ্যমান, তা নি¤œমুখী হোক, শুভবোধ স¤পন্ন কারোরই এমনটি কাম্য হতে পারে না।
[লেখক: ফারজানা ইয়াসমিন, সহকারী শিক্ষক, রঙ্গারচর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, সুনামগঞ্জ]