1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
শুক্রবার, ২৪ মার্চ ২০২৩, ১০:৫০ অপরাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

শুভ বড়দিন

  • আপডেট সময় রবিবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০২২

প্রফেসর ন্যাথানায়েল এডউইন ফেয়ারক্রস
আগামী ২৫ ডিসেম্বর বিশ্বব্যাপী খ্রিস্টমাস অর্থাৎ বড়দিন মহাসমারোহে উদযাপিত হবে। দু’হাজার বছরের পূর্বে এমনি একদিনে কুমারী মাতা মরিয়মের গর্ভে প্রভু যীশু জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। এই পৃথিবীর পাপী মানবজাতির পরিত্রাণের জন্যই তাঁর পৃথিবীতে আগমন।
স্রষ্টা ঈশ্বর অনেক সাধ ও পরিকল্পনা করে পৃথিবী সৃষ্টি করেছিলেন। প্রথম পাঁচদিন তিনি কেবল মানুষ ব্যতীত পৃথিবীর সবকিছুই সৃষ্টি করেছিলেন। ষষ্ঠদিনে তাঁর নিজ প্রতিমূর্তিতে মানুষ নির্মাণ করলেন। আর সপ্তম দিনে ঈশ্বর বিশ্রাম নিলেন। স্রষ্টার একান্ত ইচ্ছা ছিল মানুষ কেবল ঈশ্বরের গৌরব করবে, তাঁরই প্রশংসা করবে। কিন্তু আদি পিতা-মাতা আদম ও হাওয়ার অবাধ্যতা এবং লোভের কারণে মানবজাতির মধ্যে পাপ প্রবেশ করলো। এই পরম সত্য আমরা সবাই জানি পাপের বেতন মৃত্যু। কেবল শারীরিক মৃত্যু নয় আত্মিক মৃত্যুও বটে। ঈশ্বর কখনোই চান না তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষের অনন্ত মৃত্যু হোক। তাই তিনি যুগে যুগে অনেক নবী, তাঁর প্রতিনিধিদের মানবজাতির মুক্তির জন্য পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন। তাঁরা অনেক বিধি বিধান, অনেক নিয়ম স্থাপন করে গিয়েছেন। পশুর রক্তের বিনিময়েও পাপের মুক্তি নিয়ম স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু অনন্ত মৃত্যুর হাত থেকে মুক্তির কোন পথ পাওয়া গেল না।
অবশেষে ঈশ্বর এক মহাপরিকলপনা গ্রহণ করলেন। পিতা ঈশ্বর পুত্র যীশু হয়ে কুমারী মরিয়মের কোলে জন্ম গ্রহণ করলেন। যীশু খ্রিস্ট মানবজাত নন, কিন্তু তিনি ঈশ^রজাত। নর নারীর মিলন বা জাগতিক নিয়মে তাঁর জন্ম হয়নি। বরং ঈশ^রের ইচ্ছা ও পরিকল্পনায় তাঁর জন্ম হয়েছিল বলেই তিনি ঈশ^র জাত। তিনি তেত্রিশ বছর এই পৃথিবীতে ছিলেন। এরপর ইহুদী ও রোমান শাসন কর্তাদের ষড়যন্ত্রের ফলে ক্রুশের উপর বিদ্ধ করে তাঁকে হত্যা করা হয়। তিনদিন কবরে থাকার পর তিনি পুনরুত্থিত হন এবং আরো চল্লিশ দিন পৃথিবীতে ছিলেন। হাজার হাজার মানুষকে দেখা দেন এবং এরপর তাদের সামনেই উর্ধ্বাকাশে স্বর্গারোহণ করেন। তখন তিনি উপস্থিত লোকদের বলে যান-শেষ বিচারদিনে তিনি আবার আসবেন এবং মানুষের বিচার করবেন।
ঈশ^রজাত পুত্র যীশু খ্রিস্টের জন্মদিন সমগ্র খ্রিস্টিয় জগতে তথা পৃথিবীতে প্রতিবছর ২৫ ডিসেম্বর পালিত হয়। বাংলাদেশেও এই দিনটি অনেক আনন্দ ও গুরুত্বের সাথে উদযাপন করা হয়। দিনটি সরকারি ছুটির দিন।
আমাদের দেশে খ্রিস্টমাসকে কেন বড়দিন বলা হয়? খ্রিস্টমাস শব্দটি প্রথম বাংলাকরণ করেন ভোলানাথ শর্মা। তাঁর মতে খ্রিস্টমাসের বাংলা “খ্রিস্টাষ্টমী”। অনেকের কাছেই এই নামটি মনোপুত: হলো না। এরপর কবি ঈশ^র চন্দ্র গুপ্ত খ্রিস্টাষ্টমী নামটি পালটে নতুন নামকরণ করলে “বড়দিন”। গোটা বাংলা ভাষাভাষিদের হৃদয়ে এই নামটি গভীর রেখাপাত করলো।
যীশু খ্রিস্টের জন্মের বিষয়টি তাঁর জন্মেরও শত শত বছর পূর্বে ভবিষ্যৎবাণী করা হয়েছিল। মীখা ও যিশাইর নবীর পুস্তক গুলিতে আমরা তাঁর জন্ম বিষয়ে জানতে পারি। যীশু রাজাধিরাজ, প্রভুদের প্রভু। কিন্তু তিনি অতি দীন বেশে দীনভাবে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। যেন পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ তাঁর কাছে পৌঁছাতে পারে। যীশুর জন্মের সুখবর প্রথম পৌঁছলো ভেড়া চরানো মেঠো রাখালদের কাছে। শীতের রাত, আকাশে অজ¯্র তারার আলোক ছটা। পবিত্র বাইবেল গ্রন্থে লেখা আছে- “প্রভুর প্রতাপ চারিদিকে দেদিপ্যমান হইবে, চারিদিকে স্বর্গীয় জ্যোতিতে ভরে উঠবে। স্বর্গদূতদের গানে মুখরিত ঊর্ধ্বলোকের আলোক বন্যায় রাখালেরা ভয়ে পাথর হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু স্বর্গদূতরা বললেন- “ভয় করোনা, কেননা দেখ আমি তোমাদের মহাআনন্দের সুসমাচার জানাচ্ছি, সেই আনন্দ সমুদয় লোকেরই হবে, কারণ আজ দায়ুদের নগরে তোমাদের জন্য ত্রাণকর্তা জন্মেছেন তিনি খ্রিস্ট প্রভু।” (লুক-২:৯-১১)
আসুন, এবার একটু কল্পনা করি। রাখালদের শিশু যীশুকে দেখার প্রথম সৌভাগ্য হয়েছিল। গোশালায় মাটির যাবপাত্রে কাপড়ে জড়ানো শিশু যীশুকে দেখে তারা আনন্দ উল্লাসে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। আনন্দে সবাইকে জানিয়ে দিল; স্বর্গদূতেরা কী বলেছেন- আমাদের রাজা মুক্তিদাতা জন্মেছেন- এই শিশুই আমাদের রাজা রাজেশ^র। রাখালদের একজন মা মরিয়মকে বলে উঠলেন রাজাকে আমার কোলে দাও। রাখালের পোশাক ছিন্ন, হাতে পায়ে ধুলোমাটি মাখা। তবুও মা মরিয়ম বিশ^ ভুবনের রাজাকে একজন রাখালের কোলে তুলে দিলেন। তাইতো প্রভু যীশু হয়েছেন “উত্তম রাখাল” (যোহন ১০:১৪)। উত্তম মেষ পালক হয়ে তিনি মেষদের জন্য আপন প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন (যোহন ১:২৯)।
যীশুর জীবনীকার মথি প্রথম বড়দিনের কাহিনী বর্ণনা করেছেন একটি পূর্ব আকাশের তারা দেখে। পূর্বদেশ থেকে তিনজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী প-িত বেথলেহমে এসে বলেছিলেন “যে শিশু রাজা জন্মেছেন তিনি কোথায়? কারণ পূর্বদেশে আমরা তারা দেখেছি। তাঁকে প্রণাম করতে এসেছি।” দীর্ঘ মরুপথ পাড়ি দিয়ে প-িতেরা উটে চড়ে এলেন বেথলেহমে। তাঁদের সুস্পষ্ট ও সহজ প্রশ্ন গোটা জেরুজালেমকে কাঁপিয়ে দিল। একথা শুনে হেরোদ রাজা ও তাঁর সাথে গোটা জেরুজালেম নিবাসী উদ্বিগ্ন হলো। রাজা দেশের সকল পুরোহিত, প-িত ও অধ্যাপকদের ডাকলেন। তন্ন তন্ন করে তাদের সত্য অনুসন্ধান করতে বললেন। সমস্ত শাস্ত্র ধ্যান করে তারা বললেন, মীখা নবী সাত শত বছর আগে বলেছেন, এই বেথলেহমেই নবজাত রাজার জন্ম হবে (মীখা ৫:২) এ জন্যেই এই শহরটি পৃথিবীর একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর। খ্রিস্টের জন্মভূমি বেললেহমে যান দেখবেন অগণিত মানুষ আজ তাঁর আরাধনার জন্য সেখানে মিলিত হয়েছেন। ‘বেথলেহম’ হিব্রু শব্দ। এই নামের অর্থ “খাদ্যের ভা-ার”। বেথলেহম অর্থাৎ খাদ্যের আবাসে জন্মেছেন প্রভু যীশু। তাইতো তিনি নিজেকে দাবি করেছেন- “আমিই জীবন খাদ্য” (যোহন ৬:৩৫)। যীশু খ্রিস্ট মানুষের আত্মিক খাদ্যের উৎস। তিনিই পারেন মানুষের অন্তরের ক্ষুধা মিটাতে।
যীশু খ্রিস্টের আহ্বান ছিল “তোমরা মন ফিরাও। পাপের, অন্যায়ের পথে আর যেয়ো না। কারণ শেষ বিচার দিন সন্নিকট” (মথি ৪:১৭)। ঈশ^র চান তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষ তাঁর একজাত পুত্র যীশু খ্রিস্টের মাধ্যমে অনন্ত ধ্বংস থেকে রক্ষা পাক। যীশু নির্দোষ, নিষ্পাপ হওয়া সত্বেও আমাদের পাপী মানুষের রক্ষার জন্য, পাপের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করার জন্য তাঁর নিজের জীবন ক্রুশের উপর উৎসর্গ করেছিলেন। তাই খ্রিস্টের উপর বিশ্বাস দ্বারা তাঁর পবিত্র রক্ত ও জীবনের বিনিময়ে আমরা পাপী মানুষ আত্মিক অনন্ত মৃত্যু হতে রক্ষা পেতে পারি। যীশু দু’হাত প্রসারিত করে অপেক্ষা করছেন ও আহ্বান জানাচ্ছেন- “হে পরিশ্রান্ত ভারাক্রান্ত লোক সকল আমার কাছে এসো, আমি তোমাদের বিশ্রাম দেবো’ (মথি ১১:২৮)। যীশুর মূল শিক্ষাই হচ্ছে- আমরা যেন পরস্পরকে ভালবাসি, ক্ষমা করি, সেবা করি। পবিত্র বাইবেল শাস্ত্রে লেখা আছে- “ঈশ^র জগৎকে এমন প্রেম করলেন যে, আপনার একজাত পুত্রকে দান করলেন, যেন যে কেউ তাঁকে বিশ্বাস করে, সে বিনষ্ট না হয়, কিন্তু অনন্ত জীবন পায়” (যোহন ৩:১৬)।
আজ যদি আমরা বেথলেহমে যাই, তবে সেই গোয়ালঘর আর খুঁজে পাব না। সেই মাটির যাবপাত্রও আজ নেই। যেখানে যীশু ভূমিষ্ট হয়েছিলেন, সেখানে তিন ফুট ব্যাস বিশিষ্ট স্বর্ণ নির্মিত এক তারকা। শুভ বড়দিনে হাজার হাজার লোক এই স্বর্ণ তারকা চুম্বন করবেন। আর গোশালা খুঁজতে যান- সেখানে পাবেন তিনটি গির্জাঘর। একটি ল্যাটিন, একটি সিরিয়ান আর একটি আর্মেনিয়ান। ঠিক সেখানে যীশু জন্মেছিলেন সেখানে যে চার্চটি আছে, তার নাম “যীশুর জন্মের গির্জা”। এই গির্জার তিনটি বৈশিষ্ট্য আছে; ১। গির্জার চূড়ায় একটি বিদ্যুৎ চালিত ঘণ্টা আছে, যে ঘণ্টার নাম বড়দিনের ঘণ্টা। বছরে মাত্র একবার ২৫ ডিসেম্বর বড়দিনে এই ঘণ্টা বাজে। ২। এই গির্জাঘরে কোন আসন নেই। উপসনার সময় দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করতে হয়। রাজাধিরাজ ত্রাণকর্তা মুক্তিদাতা খ্রিস্টের প্রতি শ্রদ্ধা ভক্তি কৃতজ্ঞতার নিদর্শন স্বরূপ সকলেই দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করেন। ৩। এই গির্জাঘরের দরজা সংকীর্ণ। মাথা নিচু করে প্রবেশ করতে হয়। বিন¤্রতায় নতশির হয়ে ত্রাণকর্তা যীশুর সাক্ষাতে প্রবেশ করতে হয়।
বিশ্বকবি রবীন্দ্র্রনাথ ঠাকুর তাঁর বড়দিন লেখার শেষাংশে বলেছিলেন, “আজ পরিতাপ করার দিন। আনন্দ করার নয়। আজ আমাদের উদ্ধত মাথা ধুলোয় নত হোক। চোখ দিয়ে অশ্রু বয়ে যাক। বড় দিন নিজেকে পরীক্ষা করার দিন। নিজেকে ন¤্র করার দিন।
সকলকে শুভ বড়দিনের আন্তরিক শুভেচ্ছা। ইম্মানূয়েল।
[লেখক: সভাপতি-সুনামগঞ্জ প্রেসবিটেরিয়ান চার্চ, হাছননগর, সুনামগঞ্জ]

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com