স্টাফ রিপোর্টার ::
দুই উপজেলার সীমান্তে অবস্থিত হাসাউড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সদর উপজেলা এলাকায় এই বিদ্যালয়ের পূর্বদিকে রয়েছে দোয়ারাবাজার উপজেলা। সমাপনী শেষে দোয়ারাবাজার উপজেলার লিয়াকতগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে অথবা সদরের বনগাঁও এলাকায় চৌদ্দগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হয় শিক্ষার্থীদের। প্রতিদিন একজন শিক্ষার্থী সমান সমান দূরত্বের যেকোনো উপজেলার উচ্চ বিদ্যালয়ে যেতে হয় প্রায় ৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে। এতে সময় লাগে অনেক বেশি। যানবাহনে ভাড়াও লাগে বেশি। তাই বাধ্য হয়ে অনেক শিক্ষার্থী লেখাপড়া ছেড়ে দেন। এই কারণে প্রতিবছর সমাপনী শেষে বেশিরভাগ প্রাইমারি শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার রঙ্গারচর ইউনিয়নের হাসাউড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী ৫ম শ্রেণি পাস করেই পড়াশোনা শেষ করতে বাধ্য হচ্ছেন। এসব শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় এগিয়ে যেতে হাসাউড়ার আশপাশ এলাকায় কোনো উচ্চ বিদ্যালয় নেই। হাসাউড়া থেকে অন্য এলাকার কোনো উচ্চ বিদ্যালয়ে বেশিরভাগ মেয়ে শিক্ষার্থীদের নানা প্রতিবন্ধকতা নিয়ে অধ্যয়ন করতে হয়। তাছাড়া দৈনন্দিন বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়া খরচ যোগান দিতে পরিবারের আর্থিক সামর্থ্য না থাকায় লেখাপড়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হন অনেকে।
সরেজমিনে গেলে স্থানীয় বাসিন্দাগণ জানান, ১৯৫০ সালে প্রায় ২২ কেয়ার জায়গার উপর প্রতিষ্ঠিত হয় হাসাউড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয়ে হাসাউড়া, দর্পগ্রাম, বাংলাভিটা, রসুলপুর, শাহপুর, প্যাচাকোণাসহ কয়েকটি গ্রামের শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে আসছেন। কিন্তু হাসাউড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫ম শ্রেণী পাস করে উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে যেতে হয় প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরের বনগাঁও এলাকায়। বনগাঁও বাজারের পাশে চৌদ্দগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয় না হলে যেতে হয় প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরের দোয়ারাবাজার উপজেলার লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের বাংলাবাজারের লিয়াকতগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে। শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়ায় সময়মত যানবাহন পাওয়া যায় না। যানবাহন পেলে পকেটে টাকা থাকে না। বর্ষায় বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়ায় নানা ভোগান্তিতে পড়তে হয় শিক্ষার্থীদের।
হাসাউড়া গ্রামের শিক্ষার্থী অভিভাবক আনোয়ার হোসেন, সোহা মিয়া, আকবর আলী, নিতাই চান দাস, মাসুক মিয়া ও আরব আলী জানান, একজন শিক্ষার্থী বনগাঁও এলাকার চৌদ্দগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়া যানবাহন খরচ হয় কমপক্ষে ৮০ টাকা, বাংলাবাজারের লিয়াকতগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে যেতেও খরচ হয় কমপক্ষে ৮০ টাকা। আছে একজন শিক্ষার্থীর প্রতিদিনের দুপুরের নাস্তা খরচ। পরিবারের আর্থিক অসচ্ছলতা, যানবাহনে যাতায়াত ঝুঁকিপূর্ণ, হেঁটে যাওয়া খুবই কষ্টকর এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা দুর্ভোগের কারণে এসব এলাকার শিক্ষার্থীরা হাসাউড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫ম শ্রেণী পাস করেই পড়াশোনা শেষ করতে বাধ্য হচ্ছেন।
হাসাউড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক এমদাদুল হক, ছালেতুন নেছা, লিপি রাণী চৌধুরী, কনিকা দাস, মনোহর আলী জানান, প্রতিবছর সমাপনী পরীক্ষায় পাস করে অর্ধ শতাধিক শিক্ষার্থী বিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে যায়। এদের মধ্য থেকে গুটি কয়েক স্বচ্ছল পরিবারের শিক্ষার্থী উচ্চ বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করার সুযোগ পায়। তাও কোনো আত্মীয়ের বাড়িতে বা লজিং থেকে লেখাপড়া করতে হয় তাদের। কোনো কোনো শিক্ষার্থী আমাদের স্কুলে আসলে এসব তথ্য জানা যায়।
এই বিদ্যালয়ের গত সমাপনী পরীক্ষায় পাস করে লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়েছেন হাসাউড়া গ্রামের আব্দুল কাদির সুমন। তিনি জানান, আমার লেখাপড়া করার ইচ্ছে থাকলেও অনেক দূরে উচ্চ বিদ্যালয় থাকায় লেখাপড়া করতে পারিনি। কারণ যাতায়াত খরচ বেশি। বর্ষায় ঝুঁকিপূর্ণ যাতায়াত। বর্তমানে সে ভাড়া মোটরসাইকেল দিয়ে যাত্রী বহন করে টাকা উপার্জন করছে।’ একই কথা বলেন নুর মোহাম্মদ নামের আরেক শিক্ষার্থী। সেও সমাপনী শেষে লেখাপড়া বাদ দিয়ে এখন কৃষি কাজে যুক্ত আছে।
একই বিদ্যালয় থেকে গত সমাপনী পরীক্ষায় পাস করেন হাসাউড়া গ্রামের বাসিন্দা রফিকা বেগম। তাঁর স্বপ্ন ছিল লেখাপড়া করে অনেক উচ্চ পর্যায়ে অধিষ্ঠিত হতে। কিন্তু আশপাশে উচ্চ বিদ্যালয় না থাকায় তিনি লেখাপড়া করতে পারেননি। বর্তমানে সে পারিবারিক কাজে যুক্ত রয়েছেন।’
ডা. আরাধন নন্দী বলেন, আমাদের হাসাউড়া এলাকায় ১০ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো উচ্চ বিদ্যালয় নেই। যুগ যুগ ধরে শিক্ষার কোনো অগ্রগতি নেই। এটা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য খুবই ক্ষতিকর। ডিজিটাল যুগে আমাদের এলাকার শিক্ষার্থীরা পাল্লা দিয়ে উঠা মুশকিল।
স্থানীয় বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা করুণাসিন্ধু তালুকদার বলেন, হাসাউড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২২ কেয়ার জায়গা রয়েছে। এই জায়গার একটি অংশে হাইস্কুল গড়ে তোলা সম্ভব। তবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে জায়গা সংক্রান্ত আইনী জটিলতার অবসান ঘটিয়ে হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা সম্ভব। আমরা জীবদ্দশায় একটি হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা দেখে যেতে চাই।
বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি পৌরব তালুকদার বলেন, আমার এলাকায় একাধিক গ্রামের শিক্ষার্থীর জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি উচ্চ বিদ্যালয়। এই জন্য প্রতিবছর শিক্ষার্থীরা সমাপনী পাস করে লেখাপড়া শেষ করে দিতে বাধ্য হন। কারণ দুইটি উচ্চ বিদ্যালয় পড়েছে হাসাউড়া গ্রাম থেকে উভয় দিকে ৫ কিলোমিটার করে প্রায় ১০ কিলোমিটার করে দূরে। যানবাহনে চলাচলে ঝুঁকি এবং খরচ বেশি। তাই অনেক শিক্ষার্থী লেখাপড়া বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। এলাকায় শিক্ষার হার বৃদ্ধিতে এবং উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য উচ্চ বিদ্যালয় দরকার।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সন্তোষ চন্দ বলেন, হাসাউড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে গত সমাপনী পরীক্ষায় পাস করেছে ৪৬ জন। এসব শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছেন বলে কেউ কেউ আমাকে বলেছেন। প্রাথমিক পাস করে এইভাবে শিক্ষার্থীরা ঝরে পড়লে শিক্ষার অগ্রগতি হবে না। তাই এই এলাকায় একটি উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা জরুরি প্রয়োজন।
রঙ্গারচর ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ড সদস্য হিরণ মিয়া বলেন, আমাদের এলাকায় হাসাউড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ২২ কেয়ার জায়গা ছাড়া হাইস্কুল প্রতিষ্ঠায় আর কোনো জায়গা নেই। সরকারের সংশ্লিষ্টমহলের সদিচ্ছা থাকলে অবশ্যই আমাদের এলাকায় একটি হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা সম্ভব।
জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, হাসাউড়া এলাকায় উচ্চ বিদ্যালয় না থাকায় শিক্ষার্থীরা বছর বছর ঝরে পড়ছে। আমি একটি উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য একাধিকবার আমাদের সুনামগঞ্জের সন্তান তৎকালীন মুখ্যসচিব মুজিবুর রহমান মহোদয়ের সাথে কথা বলেছি। কোনো কাজ হয়নি। এখন এমপি অথবা মন্ত্রী মহোদয়দের সাথে কথা বলতে হবে।